মহামারিতেও যেন আমাদের নৈতিক পরিবর্তন ঘটেনি
একুশে জার্নাল ডটকম
জুলাই ১৮ ২০২০, ২০:০৫

মোঃ জাফর আলী>
করোনা! যেন এক আতঙ্কের নাম! ছোট্ট একটি অনুজীবের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় বা মহামারির এই ভয়াবহতা যেন বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও কোনো অংশেই কম নয়। এ মহামারিতে সর্বত্র যেন বুকফাটা হাহাকার বিরাজমান। করোনা ভাইরাস কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার কারণে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা ও ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই ব্যপারগুলোও পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আর ভাইরাসটি মানুষের জন্য যেন ভয়ঙ্কর এক মারণাস্ত্রে পরিণত হয়েছে।
সাধারণত মানুষ পৃথিবীর বুকে নিজের স্বার্থে ও নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য যুদ্ধাবস্থার মতো ভয়াবহ ক্ষতিকর মানবিক বিপর্যয় তৈরি করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু বর্তমানে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত যার যার অবস্থান থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও যেন কোন কূল পাচ্ছে না। এমনকি আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকেও ছোট্ট এই অনুজীবের ভয়াল থাবাকে শোচনীয়ভাবে বরণ করে নিতে হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত তারাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে খুব জোরালোভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই মহামারী।
ইতালির মতো দেশে যখন প্রতিদিনই লাশের স্তুপ দেখা যাচ্ছিল ঠিক তখনই সে দেশের প্রেসিডেন্ট কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গিয়েছি। আর কি করতে হবে তা আমরা জানিনা। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশের কাছে।” শক্তিধর একটি দেশের প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, বর্তমানে পৃথিবী কতটা বিপদের সম্মুখীন রয়েছে।
এ বিপদের কারণেই বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে অর্থনৈতিক ধ্বস, বৃদ্ধি পেয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নানামুখী অভাবসহ বহু সমস্যা। প্রতিটি দেশের সরকারই বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা ও কার্যকরী উদ্যোগের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারও খাদ্য,স্বাস্থ্য ও আর্থিক সহায়তাসহ জনগণের কল্যাণে বহু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একের পর এক তা বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভয়াবহ এই মহামারিতেও আমাদের দেশের বহু নাগরিকের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে বহু অপ্রীতিকর ঘটনা ও শাস্তিযোগ্য অসংখ্য অপরাধ। যেগুলো আপাতত এই সময়ের মধ্যে কল্পনাও করা যায় না।
আমরা পত্র-পত্রিকায় অনেক অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক হাজার-হাজার বস্তা ত্রাণের চাল আত্মসাতের ঘটনা দেখতে পেয়েছি। এমনকি ত্রাণের অন্যান্য সামগ্রীও কতিপয় ব্যক্তিদের নিজ বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে লুকিয়ে রাখার মত অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে খাটের নিচ থেকে কয়েকশ লিটার তেলের বোতল বের করাটা ছিল দেশব্যাপী সাড়া ফেলার মত। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধিকে পরবর্তীতে শাস্তিসরূপ সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ভাড়াটিয়াদের প্রতি বাড়িওয়ালাদের একটু মানবিক হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর মানবিক হওয়াটা উচিতও বটে।
তারপরও বাড়িওয়ালা কর্তৃক প্রতিনিয়ত ভাড়াটিয়াদের সাথে অশালীন আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভাড়া না দিতে পারার কারণে কয়েক মাসের নবজাতক শিশুসহ পুরো পরিবারকে রাতের আঁধারে বের করে দেওয়া এবং মেসের ছাত্রদের সার্টিফিকেট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ তাদের মালামাল ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়ার মত বহু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। যা খুবই দুঃখজনক।
ভয়াবহ এ মহামারীর কারণে সকলেরই অর্থ সংকট সৃষ্টির বিষয় একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এজন্য এ মুহূর্তে সকল দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বলা হলেও একদল অসাধু ব্যবসায়ী করোনাকে পুঁজি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি করে ফায়দা লুটার মতো ঘৃণিত কাজও করে যাচ্ছে। এমনকি একসময়কার ৩৫ টাকার স্যানিটাইজার বা হ্যান্ডওয়াশ ৭৫ টাকা ও ৫০০ টাকার প্লাস্টিকের চেয়ার হাজার টাকার ওপরেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে এরকম বহু পণ্যই অস্বাভাবিক দর দিয়ে জনগণকে ক্রয় করতে হয়েছে। যেটি আসলে কাম্য নয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ এর তথ্য অনুযায়ী এই করোনা সংকটের মধ্যে, শুধু গত জুন মাসেই দেশে ৩০৮ জন নারী ও শিশুর উপর নির্যাতনের কথা জানা গেছে। এর মধ্যে ১০১ জন নারী ও শিশু শুধু ধর্ষণেরই শিকার হয়েছে। এদের মধ্যকার মোট ৬৯ জন ধর্ষণ এবং ২৫ জন হয়েছে গণধর্ষণের স্বীকার। আর ৭ জনকে ধর্ষণের পর মেরেই ফেলা হয়েছে। তাছাড়াও অপ্রকাশিত ঘটনাবলী তো বাদই আছে। তারমধ্যে লক্ষীপুরের স্কুল ছাত্রী হিরামনি কে বাড়িতে একা পেয়ে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এভাবে দিনের পর দিন ধর্ষণের ঘটনা যেন বেড়েই চলছে। যেটি খুবই আশঙ্কাজনক।
এই সংকটের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। দৈনিক ইনকিলাবে মার্চের এক সংবাদ অনুযায়ী, সাভারের একটি স্কুলের জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামোগত কাজে কয়েকটি নারিকেল গাছের দাম ১৩ কোটি টাকা দেখানো হয়েছিল। আবার সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উপর হাজার-হাজার ভূয়া করোনার সার্টিফিকেট দিয়ে বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও এসেছে। এজন্য বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের নানা অসুবিধা ভোগের পাশাপাশি অপমানিতও হতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে দেশে এরকম দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা অহরহ ঘটছে। যেটি আসলেই হতাশাজনক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক ঘটমান বিভিন্ন অপরাধসমূহ আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার। দেশব্যাপী লকডাউনের জন্য মানুষকে অধিকাংশ সময়ই এখন ঘরে অবস্থান করতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে অধিকাংশরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সময় কাটানোর একটা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এমন অবস্থায় এই মাধ্যমগুলোকেই ব্যবহার করে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো, কটুক্তি করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, হত্যা বা প্রাণনাশের হুমকি দেয়া, বিভিন্ন একাউন্ট বা আইডি হ্যাকিং চেষ্টা, ভাইরাল হতে অশ্লীলতাকে বেছে নেয়া, ট্রলিং করা, বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করা ও অনলাইন ব্যবসার নামে বিভিন্ন অপ্রীতিকর অপরাধসহ নানাবিধ নীতি বিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।
ওপরে আলোচিত বিষয়সহ প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত হাজারো আইনবিরোধী বা অন্যায় কাজ এই মুহূর্তেও আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটেই যাচ্ছে। এখন এমন একটি সময়, যখন সর্বস্তরের মানুষ করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য প্রতিটি প্রহর গুনছে, যাদের ঘর-বাড়ি নেই, রাস্তাঘাট বা বস্তিতে যে খেটে খাওয়া মানুষদের বসবাস, তাদের অভাবজনিত বুকফাটা চিৎকারে যখন আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে দিনের পর দিন, যখন এই করোনা যুদ্ধে সত্যিকারের যোদ্ধা হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার ও নিজেকে সংশোধিত করার উপযুক্ত সময় এসেছে, যখন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই কথাটি বাস্তবে রূপ দেয়ার সময়, ঠিক তখনই আমরা কতিপয় লোক নিজেদের স্বার্থে, দেশ ও জাতির ক্ষতি করে ঘৃণ্যতম বিভিন্ন অপরাধ করতেও দ্বিধাবোধ করছিনা। বিবেকবোধ, মানবিকতা ও নৈতিকতার বিবেচনা তো দূরের কথা, আইনেরই কোন তোয়াক্কা আমরা করছিনা। এরকম ভয়াবহ মহামারিতেও যেন আমাদের নৈতিক পরিবর্তন ঘটেনি।
শিক্ষার্থী,শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।