ভাতের_ঘ্রান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ২৫ ২০১৯, ১৩:৩৩

ভাতের_ঘ্রান
 বনশ্রী বড়ুয়া

সেমিনারে সবাইকে
আলাদা আলাদা টপিক দিয়েছিল লেখার জন্য;
এখানে টিকতে পারলেই আমার লেখালেখির একটা গতি হবে,,,,মানে কিছুটা জাতে উঠবো আমি;
দু’চার কলম লিখলেই হয়ত
সপ্তাহের শেষে একটা নোটের প্যাকেট হাতে পাবো,
বাবার বুকের ব্যাথাটা দিন দিন বাড়ছে,
টাকা পেলেই এবার
ঔষধ,পথ্যির একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

সকাল থেকেই বসে আছি,তেমন কেউ নেই,
যারা আছে তারা আমাকে দেখে নাক কুঁচকে রেখেছে, যেন চিড়িয়াখানা থেকে সদ্য আনা কোন প্রাণী।

বসে থাকতে থাকতে আমার হাত পা ম্যাচম্যাচ করছিল হঠাৎ রূপসী টাইপের মেয়ে এসে বলল;
অনির্বাণ কে?
কন্ঠে ছিল অদ্ভুত মাদকতা,আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম,,,,যেন স্বপ্নে হাঁটছিলাম,,,

চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে থাকলাম কে এই অনির্বান?
স্বম্বিত ফিরলো পাশের ছেলেটার ডাক শুনে,,দাদা,, আপনাকে ডাকছে।
আমার গলায় ঝুলানো নেইম কার্ডটা দেখিয়ে বলল,
মশাই,আপনিই তো অনির্বান,তাই না?
লজ্জাবনত দৃষ্টিতে সেমিনার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
সামনে বসা চারজন ভদ্রলোক আমাকে দেখে একে অপরের দিকে তাকালেন। একটা কাগজে কিছু একটা লিখে কাগজটা আমাকে দিয়ে বললেন,
মশাই আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হল।এই টপিক নিয়ে লিখুন।
নিম্নবিত্ত বেশভূষা দেখেই হয়ত ওরা আমাকে লেখার টপিক দিয়েছিল “ভাতের ঘ্রাণ”।

টপিক টা পেয়েই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল,,মা, আমার মা,,মৃত্যুশয্যায় খুব চেয়েছিল ভাতের ঘ্রান নিতে। কি ভীষণরকম ইচ্ছের দাহ করেন সেদিন আমার অসহায় বাবা।ঘরে একমুঠো চালও ছিল না,,থাকলেও আমার হাত কাটা বাবা ফুটিয়ে দিতে পারতেন না।

বরাবরেই আমার মায়ের ভাত ছিল ভীষণ রকম প্রিয়।হয়ত আমাদের ভাতের অভাব ছিল বলেই ।ভাত খেতাম আমরা কালেভদ্রে দু’একবার।ভাত দেখলেই মায়ের চোখজোড়া কেমন চকচক করে উঠত।বিশেষ করে যখন ভাত সিদ্ধ হত তখন মাকে দেখতাম চোখ বন্ধ করে ভাতের গন্ধ নিতেন।মাকে দেখে মনে হত, যেন ভাত নয় গন্ধেই তার ক্ষুধা মিটে যেতো। আমরা যখন খেতাম মা তাকিয়ে থাকত।যদি কখনো জানতে চাইতাম, তুমি খাবে না, মা?
মা বলত,বাছারে আমার ভাতের গন্ধে পেট ভরে যায়,,তোরা খেলেই আমার পেট ভরে যাবে।
পরে বুঝতাম,,আমার ভাত পাগল মা আমাদের খাওয়াতে এই মিথ্যেটা বলতেন।আমার সেই মা হুট করে মরে গেল দু’মুঠো ভাতের অভাবে।ভাতের ঘ্রান তার নেয়া হল না।
আমি তখন অনেক ছোট,বাবার দু’পা,,দু’হাত কাটা পড়েছিল ট্রাকের চাপায়,,,,
সেই থেকে আমাদের ভাতের ঘ্রাণ নেয়ার পালা চুকে যায়।ভাত চোখে দেখিনি বহুদিন।মা যেতেন দূরের গাঁয়ে,,শালুক তুলে এনে সিদ্ধ করে দিতেন।সেই আমাদের ভাত,,সেই আমাদের পেট ভরানোর একমাত্র উপায়। দিনের পর দিন শালুক খেতে খেতে আমরা ভাতের গন্ধ কি সেটা ভুলে যাই।
একদিন মা মহাজনের ছেলের বিয়েতে ফেলে দেয়া এঁটো ভাত নিয়ে আসে অনেকটা চুরি করেই,,
সেদিন ভাত খেয়ে মাকে বলেছিলাম,মা ভাত দিয়ে শালুক শালুক গন্ধ কেন,,,?
মা লুকিয়ে কাঁদতো,,,৷
সারাদিন অন্যের বাড়িতে কাজ করতো,,আমিও চলে যেতাম মা’র সাথে।একদিন মাকে দেখলাম, একমুঠো ভাত আঁচলে গিঁট দিয়ে রেখেছে,কাজ করছে আর একটু পর পর ভাতের পুটলিটা শুঁকে দেখছে।আমি প্রশ্ন করতেই মা বলল,,
“ভাতের ঘ্রান নিচ্ছি রে বাপ,,ভাতের ঘ্রান,,দুনিয়ায় এমন ঘ্রান আর নাই রে বাপ।”
সেদিন বুঝিনি আজ বুঝি,,,,, ভাতের ঘ্রান কাকে বলে।

এসব ভাবতে ভাবতে সময় শেষ হয়ে এল,,কিছুই লিখিনি,,,,

লেখার কাজটা বোধহয় হবে না।ঘড়িতে আর একমিনিট বাকি,,, তাড়াহুড়ো করেই লিখলাম,

“যদি সম্ভব হত মায়ের শ্মশানে ভাতের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতাম,,,,সেই অদ্ভুত ঘ্রান ছড়িয়ে পড়ত মেদিনীর হাজারো ক্ষুধার্ত গর্ভধারিণীর বুকে।”

কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম,,,,,, জানি কাজটা হবে না,,,,,কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে।
মায়ের জন্য হয়ত,,,,হয়ত শালুকের জন্য,,, নাকি ভাতের ঘ্রানের জন্য,,কিছুই জানি না।