ভাইরাস রোধে অন্ধবিশ্বাস নয়, বিজ্ঞানীদের পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত থিউরির অনুসরণই ইসলামের দাবি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৪ ২০২০, ০২:৫৩


ড. মাওলানা শামসুল হক সিদ্দিক


ইরানের পবিত্র অঞ্চল থেকে যেভাবে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস

চীনের তুলনায় ইরানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে অতি দ্রুত। এর জন্য ইরান সরকার আমেরিকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করেছেন। অবশ্য বিশ্লেষকদের অধিকাংশই দায় চাপাচ্ছেন ইরান সরকারের কাঁধে। বলছেন সরকারের অস্বচ্ছতা, ও ভাইরাস বিষয়ে লুকোচুরি খেলাই এর জন্য দায়ী। কেউ-কেউ আবার ইরানিদের অবহেলা-ঔদাসীন্য ও নীরসতায় এর কারণ খোঁজে বেড়াচ্ছেন। কারো কাছে আবার শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসই এর জন্য দায়ী।
মাহদি খালজি, ইরানি বংশোদ্ভুত আমেরিকান গবেষক। ইরানের পবিত্র নগরী ‘কোম’-এ তিনি ধর্মতত্ত্ব ও শিয়া- আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। ইরানিদের ধর্মবিশ্বাস তিনি গভীর থেকে জানেন। খালজির কাছে, অন্যসব কারণকে ছাপিয়ে, ধর্মীয় বিশ্বাসগত কারণেই ইরানের ভূমিতে উর্বরতা পেয়েছে কোভিড-১৯ এবং ছড়িয়েছে বৈশাখী ঝড়ের প্রবল ক্ষিপ্রতায়।
খালজির বর্ণানায়, ১৯ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ইরান সরকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি মেনে নেয়ার পূর্বে জনৈক ভাইরাস আক্রান্ত ইরানি ব্যবসায়ী চীন থেকে ফিরে আসেন দেশে, পবিত্র নগরী কোম-এ। কয়েকদিন পর তিনি জ্বর ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুর পূর্বে যে কয়দিন জীবিত ছিলেন, নিজের অজান্তেই দেশ-বিদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের মধ্যে তিনি ছড়িয়ে দেন প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনা।
খালজি ‍(arabpost) এ প্রকাশিত তার এক প্রবন্ধে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব তেহরানের মতো বড়ো কোনো শহওর ঘটেনি। ঘটেছে বরং ‘কোম’ শহরে, যা অবস্থিত মরুভূমির মধ্যখানে। ধর্মীয় নেতারা এই নগরীর ওপর চড়িয়ে রেখেছেন পবিত্রতার স্বর্গীয় চাদর, মানুষের মধ্যে তৈরী করেছেন এমন ব্শ্বিাস যে এই নগরী প্লেগ, মহামারী ও আপদ-বিপদ থেকে দুর্পার ‘স্বর্গীয় সুরক্ষায়’ সুরক্ষিত। এ কারণেই সর্বোচ্চ ইরানি ধর্মীয় নেতা আলী খামেনেয়ী বলেন এই নগরীকে কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়ার আওতায় আনার বিরোধিতা করেছেন। উল্টো বরং তিনি হযরত ফাতিমা (রা) এর পবিত্র চত্বরে নামাজ আদায় করে রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘কোম’ নগরীর পবিত্রতা শিয়া মুসলিমদের অন্তরে এতোই অধিক যে, তারা কিছুতেই মানতে রাজি নন, এই নগরী কখনো কোনো মহামারীতে আক্রান্ত হতে পারে। যদিও ইতিহাস সাক্ষী, এই নগরী বেশ কয়েকবার জনশূন্য করতে হয়েছিল, কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে, আবার কখনো মনুষ্য বিগ্রহের জের ধরে। উদাহরণত, ১৮৭০-১৮৭২- এ প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে পবিত্র কোম। ফলে জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ কমে যায়। তা সত্ত্বেও এই নগরীর প্রতি ইরানিদের বিশ্বাসে সামান্যতম চিড় ধরেনি। কারণ অলৌকিক কল্পকাহিনী, মিথ, রাজনীতি, ধর্মীয় স্বার্থান্ধতার আলেখ্যে ‘কোম’-কে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে এক কিংবদন্তিচিত্র। যা যেকোনো বিকল্প চিন্তাকে পরাহত করতে বাধ্য।
কোম ইরানি বিপ্লবের আইডিওলজিক্যাল রাজধানী। এই পবিত্র রাজধানী থেকেই ছড়িয়েছে কোভিড-১৯ ইরানের প্রতিটি অঞ্চলে এবং বাইরের আরও সাতটি রাষ্ট্রে। ভিত্তিহীন বিশ্বাসে নিজদের আরোপিত করার ফলে, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনেয়ী সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ডেকে এনেছে সমূহ বিপদ। মারা যাচ্ছে প্রতি ১০ মিনিট অন্তর-অন্তর একজন করে মানুষ।
একসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় খোদ ফাতিমা চত্বরকে কোয়ারেন্টিনের আওতায় আনার জোর দাবি জানায়। বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায় চত্বরের মুতাওয়াল্লি মুহাম্মদ সা-ঈ-দী। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিনীধিদের সাথে একত্র হয়ে গড়ে তোলেন তিনি প্রতিরোধ দুর্গ, ফলে পিছিয়ে যায় কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়া আরও।
ভাইরাস রোধে অন্ধ বিশ্বাস নয়, ‘স্বর্গীয় সুরক্ষা’র ধুম্রজাল ছড়ানো নয়, বরং বিজ্ঞানীদের শত পরীক্ষায় পরিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত থিউরির অনুসরণই হলো ইসলামের অমোঘ দাবি। যারা এই সত্যটি মানতে নারাজ তাদের পরিণতি ইরানিদের মতো হতে বাধ্য।