বিশ্ব ইজতিমা নিয়ে কিছু আনন্দানুভূতি
একুশে জার্নাল
জানুয়ারি ১৪ ২০২০, ০০:২৮
।। মুফতি আব্দুল্লাহ তালহা ।।
ময়দান থেকে আজ সকালে ফেরার তাওফিক হলো। আসার আগ থেকেই ভাবছিলাম, কিছু ভালো-লাগা, মন্দ-লাগার অনুভূতি লিখব। তাই লিখতে বসলাম।
গত বৃহস্পতিবার থেকে ইজতিমা শুরু হবার কথা থাকলেও আমরা কয়েকজন বুধবার গিয়ে হাজির হয়েছিলাম এলাকার সাথীদের জন্য জায়গা রাখতে। কিন্তু গিয়ে দেখি আমাদের চেয়েও চালাক-চতুর মানুষ আরো অনেক আছে। আমাদের রাজশাহীর বিভিন্ন থানা-ইউনিয়নের গোটা জামাত ময়দানে গিয়ে জায়গা দখল করে বসে আছে।
প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবে জায়গা নিয়ে সামান্য বিবাদ হলেও অনতিবিলম্বে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের জায়গার চতুর্দিকে এমন একটা থানার সাথীদের দ্বারা ভরপুর হয়ে গিয়েছিল যেখানে আলামিশুরার জামাত প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধ। আল্লাহর কী ফায়সালা! সেই থানা ইউনিয়ন থেকে হিউজ পরিমাণ সাথী এসেছে।
ইজতিমায় জায়গা নিয়ে কী হয়েছে সবাই জানেন, তবুও যখন বড়রা আমাদেরকে তারগীব দিলেন, এভাবেই একরাম আর কুরবানী-মুজাহাদার সাথে সাথীরা যেন ময়দানে থাকে আর সাথীরাও বড়দের হেদায়েত কায়মনোবাক্যে মেনে নিলেন তখন থেকে ময়দানে জায়গা নিয়ে আর কোনো বিবাদ বা মনোমালিন্য থাকল না। প্রথম দিন যে ঢাকার জামাত আরেক এলাকার জামাতের সাথে জায়গা নিয়ে কথা কাটাকাটি করল সেই জামাতই আবার লম্বা দস্তরখানে সেসব জেলার সাথীদের সাথে একত্রে পানাহার করল। এ এক আজীব পরিবেশ।
২.
ইজতিমার ময়দানের জায়গা না পেয়ে সাথীরা আশপাশের সব খালি মাঠ, গোডাউন, মসজিদ, স্কুলের মাঠ, নদীর তিরে অবস্থান নিতে বাধ্য হলো।
রাস্তার মানুষগুলো কতটা কষ্ট করে রাস্তায় ছিল তা গতরাতে গাড়ির জন্য তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই আমার বুঝে এসেছে।
কিন্তু যখন রাস্তায় আর এসব প্রতিকূল জায়গায় গিয়েছি সাথীদের দেখে মনে হয়েছে, খুব সুখে আছেন। মনে কোনো গ্লানি নেই। মুখে নেই অভিযোগ। রাঁধছেন, খাচ্ছেন, ঘুমুচ্ছেন। গল্প করছেন। এই আত্মিক প্রশান্তি খাসভাবে আল্লাহ-প্রদত্ত। নয়তো রাস্তায় অবস্থান করা কতটা যে মনকষ্টের তা বলে বুঝানো কঠিন। এসব সাথীদের মনে আল্লাহই প্রশান্তি ঢেলে দিয়েছেন।
৩.
বিশ্ব ইজতিমায় অত্যন্ত জযবার সাথে অংশগ্রহণের বয়স একেবারে কম নয়। এ পর্যন্ত প্রায় সবগুলো ইজতিমায় যে বিষয়টা অস্থিরতার কারণ ছিল মুরুব্বি সাথীদের তা হলো সাধারণ সাথীদের অমনযোগ ও ছোটাছুটি করা।
অন্যান্যবার যে বিষয়গুলো নজর এড়ায় না- বয়ান চলার মূহুর্তে সথীরা খাচ্ছেন বা গল্প করছেন। অথবা মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ময়দানে নাই।
আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর দরবারে হাজার শোকর। এবার মজমা পুরোটা সময় সুকুন ও জযবার সাথে ছিল।
আমাদের খেত্তায় এমন একটি জামাতও দেখিনি যারা বয়ান চলাকালে দস্তর বিছিয়েছে। সাথীরা গল্প করছে না। ঘোড়াঘুরি করছে না। সবসময় দেখলাম, সাথীরা অত্যন্ত শওক ও মনযোগের সাথে প্রতিটি বয়ান শুনছে। ফলে যা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় চিল্লা-তিনচিল্লার খুরুজের নিয়ত করা ছাড়া আমাদের দেখা কোনো সাথী ফেরেনি।
ময়দানের এই স্বস্তি ও শান্তির পরিবেশ প্রমাণ করে গোটা ময়দান আল্লাহ প্রদত্ত সাকিনাহ দ্বারা প্লাবিত হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ। আর মুনাজাত হয়ে যাবার পরও সাথীদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওনারা ময়দান ছেড়ে যেতে প্রস্তুত নন। এখানেই থেকে যেতে চান কাল নিরবধি।
৪.
আখেরি মুনাজাত। আশা করি মুনাজাত নিয়ে আমার যে অনুভূতি সব ভাইরই একই অনুভূতি।
দোয়া পরিচালনাকারী মাওলানা যুবায়ের সাহেবের চোখ যেন এক মূহুর্তের জন্যও অশ্রু বর্ষণ বন্ধ করতে পারেনি।
দোয়াকারীর ইনকিসারি-আজিজির আছর তার সাথে হস্ত উত্তলোনকারী সবার উপরে পড়ে।
এতো সুন্দর আর আবেগি দোয়া বহুদিন করা হয় না। আল্লাহ এবার তাওফিক দান করলেন।
এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা-মুযাকারার সময় সাথীদেরকে বললাম, এই তিনদিন বাংলাদেশের সকল এলাকার ওলামা-মাশায়েখ ও আল্লাহওয়ালা বুযুর্গবৃন্দ এই ময়দানে ছিলেন। এমনকি প্রায় সকল মুহাদ্দিস-মুফাসসিরগণ ছিলেন। এর তো অবশ্যই একটা বিরাট বড় তাছির-প্রভাব আছে।
৫.
আসার পরের একটা আপ্লুত হবার মতো কারগুজারি হলো, মসজিদের সভাপতি-সেক্রেটারি ও যেসব মুসুল্লিদের সাথে সালাম-কালাম করলাম, সবার মুখেই একই কথা- এবারের ইজতিমা তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে । এতো মানুষ এর আগে কখনো হয়নি। আমরা সব দেখেছি খবরে।
এটা অত্যন্ত খুশীর বিষয় না হলেও, কিছুটা খুশী ও আনন্দের তো বটেই। আগেই বলে নেই, সংখ্যাধিক্য হওয়া হক হবার আলামত নয়। তবে খুশী হলাম কেন? কারণ, আলমীশুরার ইজতিমায় যদি লোক-সংখ্যা কম হতো তাহলে এতাতিরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াত, আলেম-ওলামাদেরকে উম্মত প্রত্যখ্যান করেছে। গালি দিয়ে বলতো হেফাজতি-ওজাহাতি আলেমদের সাথে লোকজন নেই।
আল্লাহ তাদের সেই অপবাদ আরোপের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন।