বর্তমান প্রেক্ষাপটে সীরাত চর্চার গুরুত্ব

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ২১ ২০২০, ১৮:৩৮

মুফতি আহমদ যাকারিয়া
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক বিস্ময়কর মনীষার উদাহরণ পাওয়া যায়; যাদের চিন্তা-চেতনা ও দর্শন সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে এবং যাদেরকে তাদের স্বতন্ত্র আদর্শ ও কৃতিত্বের কারণে মানুষ আজও শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে স্মরণ করে থাকে। এইসব মহামানবদের কারো কারো জ্ঞান ও প্রতিভা সরাসরি ‘ওহিয়ে এলাহী’ থেকে আহরিত ও উৎসারিত আর কারো গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিভা তার নিজস্ব চিন্তা, দর্শন এবং রুচি ও হিকমতের ফসল। মুহাম্মাদ সা. এইসব মহান ব্যক্তিদের মাঝেও পরিপূর্ণ ও সুমহান ব্যক্তিত্ব। যার পূর্ণতা ও বিশ্বজনীনতা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, যা কোন যুগ, জীবন ও ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়ে আছে। জলে-স্থলে, আপন ও পর সকলে তার থেকে উপকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে বরং কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে। ইনশা আল্লাহ।
নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর জন্য এগুলো এক মু’জিযাস্বরূপ যে, আজ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উঠাবসা, চলাফেরা, জীবনযাপন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, খানা-পিনা ও চেহারা-সূরত ইত্যাদি সকল কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সীরাতের পাতায় পাতায় রয়েছে। সীরাত সংকলকগণ অত্যন্ত আমানতদারির সাথে তা সংরক্ষণ করেছেন এবং আজও পর্যন্ত  সীরাতের সংকলন, চর্চা ও অধ্যয়ন অব্যাহত রয়েছে।
সীরাত চর্চা কখন থেকে শুরু হয়?
রাসুল সা. -এর জীবনচরিত চর্চার দ্বারা প্রিয় নবীজির মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাঙ্গতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে রাসুল সা. এর সাহাবায়ে কেরামের পরিচয়ও জানা যাবে। আর এর মাধ্যমে ইমানি শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং অসংখ্য আয়াত ও হাদিসের মর্ম বুঝে আসবে।
এই গুরত্বের কথা অনুভব করে মুসলিম উম্মাহ প্রাথমিক যুগ থেকেই মহানবী সা. এর সীরাত সংরক্ষণ ও প্রচারে অক্লান্ত সাধনা করে আসছেন। তাদের ঐ সাধনার কথা বিশ্বে অমুসলিম মনীষীরাও অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। মারগোলিয়াথ-এর মত ইসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘মুহাম্মদের জীবনীকারদের দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে। এটা গুণে শেষ করা অসম্ভব। তবে ফিরিস্তিতে নিজের স্থান করে নেয়া গৌরবের ব্যাপার’।
(খুৎবাতে মাদ্রাজ: সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভী)
অসংখ্য মুসলমান সন্তান এটাকে নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই মহান ব্রত পালন করতে গিয়ে তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী নিজেদের নবী, ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনচরিত ও ইতিহাস লিখেছে। তবে তাদের কাছে তাদের আসমানী গ্রন্থ বা সহীফা সংরক্ষিত নেই। বরং তাদের এতটুকু জানা নেই যে, ঐ আসমানি গ্রন্থ কার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কী কী বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা যাকে নিজেদের ইমাম, পথপ্রদর্শক ও অনুসরণযোগ্য মনে করেন, তাদের জীবনের সামান্য তথ্যাদিও তাদের হাতে নেই। পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিত তো দূরর কথা। তারা তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের জীবনের একটি বাক্যও বিশুদ্ধভাবে পেশ করতে পারবে না, যা নির্ভরযোগ্য এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ ভিত্তিক বা যার ধারাবাহিতা আছে। কিন্তু মহান রাব্বুল আলামিনের লক্ষ-কোটি শুকরিয়া যে, এই গৌরব, এই মর্যাদা নবী সা. এর উম্মতদের রয়েছে। তারা তাদের নবী সা. এর প্রতিটি কথা, কর্ম ও মুহূর্তের বর্ণনা নির্ভরযোগ্য ধারাবাহিক সনদে উপস্থাপন করতে পারে।
রাসুল সা. বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ এবং তার আদর্শকে উম্মতের জন্য অনুসরণযোগ্য ঘোষণা করার পর থেকেই তার জীবনচরিত সংরক্ষিত হতে থাকে। এ কাজে তারা এতটা নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন যে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মপ্রবর্তক ও প্রচারকদের জীবন বৃত্তান্ত ও বাণী সংগ্রহ সংকলনের কাজে এমন সতর্কতা ও বর্ণনাকারীদের এমন ধারাবাহিকতা রক্ষা করার এত বিপুল আয়োজন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই। মহানবী সা. এর নবুওয়তের পর থেকে কোনো একটি মুহূর্ত এমন অতিবাহিত হয়নি, যার সঙ্গে এ উম্মতের সম্পর্ক নেই বা সে বিষয়ে তারা পরিচিত নয় কিংবা ধারাবাহিকতা শক্তিশালী নয়।
‘সীরাত’ একটি আরবী শব্দ। এ শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘সিয়ার’। এটির মূল শব্দ হচ্ছে ‘সাইরুন’। এর অর্থ চাল-চলন, গতি ইত্যাদি। ‘আল মু’জাম আল আ’জম’ ও ‘মিসবাহুল লুগাত’ নামক বিখ্যাত দু’টি আরবী অভিধানে ‘সীরাত’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে-
১. যাওয়া, প্রস্থান করা, চলা;
২. গতি, পথ, পদ্ধতি, ধারা;
৩. আকার, আকৃতি, মুখাবয়ব;
৪. চেহারা, আকৃতি;
৫. অবস্থা;
৬. কর্ম-নৈপুণ্য, ঢঙ, চাল;
৭. সুন্নাত;
৮. জীবন চলার ধরণ, প্রকৃতি, কাজকর্ম করার ধরণ, জীবন পরিচালনার ঢঙ,
৯. অভ্যাস;
১০. কাহিনী, পূর্ববর্তীদের গল্প বা কাহিনী এবং ঘটনাবলীর বর্ণনা ইত্যাদি।
অপরদিকে ইসলামী বিশ্বকোষ ‘সীরাত’-এর অর্থ লিখেছে;
১. যাওয়া, যাত্রা করা, চলা;
২. মাযহাব বা তরিকা;
৩. সুন্নাহ;
৪. আকৃতি;
৫. অবস্থা;
৬. কীর্তি;
৭. কাহিনী, প্রাচীনদের জীবন ও ঘটনাবলীর বর্ণনা;
৮. মুহাম্মদ সা. এর গাযওয়ার (যুদ্ধের) বর্ণনা;
৯. অ-মুসলিমগণের সাথে সম্পর্ক, যুদ্ধ এবং শান্তির সময়ে মুহাম্মদ সা. যা বৈধ মনে করতেন তার বর্ণনা কিংবা মুহাম্মদ সা. এর জীবন চরিত; সম্প্রসারিত অর্থে বীর পুরুষদের কীর্তির বর্ণনা।
আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলবির মতে: সীরাত হলো আরবি শব্দ। এর অর্থ নিয়মাবলী, জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, জীবনচরিত ইত্যাদি। সাধারণ অর্থে প্রিয়নবী সা.-এর আচার-আচরণ, জীবনযাপন প্রণালী তথা জীবনচরিতকে বোঝায়। মহানবী সা.-এর মূল সীরাত হলো, তার বিশাল হাদিস ভান্ডার। তবে প্রাথমিক যুগের মনীষীদের মতে রাসুল সা.-এর সরাসরি অংশগ্রহণ করা যুদ্ধসমূহ এবং মহানবীর প্রেরিত যুদ্ধাভিযানসমূহের সমষ্টিকে সীরাত বলে। বরং তাদের মতে সীরাত হলো, সীরাত, আদব, তাফসীর, আকাইদ ইত্যাদি আটটি বিদ্যার সমষ্টির নাম। সে হিসেবে সীরাত ইলমে হাদিসের একটি অংশ। তবে এখনকার সময়ের পন্ডিত মনীষীরা সীরাত বলতে মহানবী সা.-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনচরিতকে আখ্যায়িত করেছেন।
(সীরাতে মুস্তফা সা. : আল্লামা ইদরিস কান্ধলবী রহ.)
পবিত্র কুরআন মজীদে ‘সীরাত’ শব্দটি শুধুমাত্র একবারই ব্যবহৃত হয়েছে। সূরা ত্বাহা’র ঐ আয়াতে বলা হয়েছে “তুমি তাকে ধর এবং ভয় পেয়ো না। আমি তাকে  পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব, যেরূপ প্রথমে এটি ছিল”। এখানে ‘সীরাত’ শব্দটি আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মোটকথা ‘সীরাত’ এর আভিধানিক অর্থ হলো; কোন ভালো মানুষের বা নেককার মানুষের চাল-চলন, ওঠা-বসা, কাজ-কর্ম, মেজাজ-মর্জি। এক কথায় জীবন পদ্ধতি বা জীবন চরিত।
আর ‘সীরাত’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ বোঝানো হয়েছে মহানবী সা. এর সার্বিক জীবন চরিতকে। রাসূল সা. এর  বিখ্যাত জীবনী গ্রন্থগুলোর নামের সাথে এই ‘সীরাত’ শব্দটি সম্পৃক্ত দেখা যায়। যেমন-সীরাতে ইবনে ইসহাক, সীরাতে ইবনে হিশাম, সীরাতে হালবিয়া, সীরাতে রাসূল, সীরাতে মুগল তোয়াই, সীরাতে খাতিমুল আম্বিয়া, সীরাতে সারওয়ারে আলম, সীরাতে মুহাম্মদীয়া, সীরাতে মুবারক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. সীরাতে মুহসীনে কায়েনাত সা., সীরাতুন্নবী, সীরাতে মোস্তফা প্রভৃতি।
সীরাত চর্চায় সাধারণত কুরআন, হাদীস, মাগাজী গ্রন্থাবলী, রাসূল সা. কে নিবেদিত  কবিতা, প্রাচীন ইতিহাসমূলক (যেসব মক্কা-মদীনার ইতিহাস), সাহাবীদের শামায়েল প্রভৃতি সহায়ক হিসেবে বিবেচিত।
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায়ে রাসূল সা. সম্বন্ধে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য আছে। অন্যদিকে হাদীসে রাসূল সা. জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগের খুঁটিনাটি কথা পর্যন্ত রয়েছে।
নবী সা. এর সীরাত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সর্বপ্রথম অনুভব করেন সাহাবায়ে কেরাম ও শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ীরা। তারা সাহাবাদের জীবদ্দশাতেই দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষের প্রত্যেকের কাছ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে রাসুল সা. এর প্রতিটি বাণী, কাজকর্ম এবং তাদের সম্পর্ক সবগুলো ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হিজরীর দ্বিতীয় শতাব্দীর একেবারেই সূচনাতে হাদিস গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু হলে তখন থেকে আরম্ভ হয় সীরাত চর্চা। এ ক্ষেত্রে উমর বিন আবদুল আজিজ রা. হলেন সীরাত চর্চার রূপকার। সীরাত চর্চার সেই যে সূচনা হয়েছিলো তা অদ্যাবধি চলছে এবং চলবে। সীরাত চর্চার বহুমুখী বিশ্বস্ত আলো ছড়িয়ে পড়েছিলো ইমাম বোখারি রহ., ইমাম মুসলিম রহ., ইমাম তিরমিজি রহ., ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. প্রমুখ সংকলিত হাদিস গ্রন্থসমূহে।
রাসুল সা. এর সীরাত চর্চা তার নবুওয়াতের পর থেকেই অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতে থাকবে। তার সম্পর্কে কোনো প্রকার ভুল ব্যাখ্যা, অপব্যাখ্যা, সত্যের অপলাপ করতে পারবে না। মুসলিম সীরাত চর্চাকারীরা এ সুযোগ তাদের দিবেন না, বরং মহানবী সা. এর সীরাত সম্পর্কে লাখো গ্রন্থ মুসলিম লেখকরা রচনা করেছেন এবং করছেন। নবী সা. এর সীরাত বিষয়ক প্রতিটি গ্রন্থ অন্যান্য নবীর জীবনচরিত সংক্রান্ত গ্রন্থগুলোর তুলনায় অধিক স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও ঐতিহাসিক। তার জীবনচরিতকে অগণিত মানুষ শুনছে ও পাঠ করছে। এর ধারাবাহিকতাও অব্যাহত গতিতে চলে আসছে এবং চলতেই থাকবে।
রাসূল সা. এর সীরাত চর্চার ক্ষেত্রে যে সমস্ত সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীগণ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন (অবশ্য এসব কাজ ছিল বিচ্ছিন্ন, অগোছালো)
তাঁরা হলেন-
১- উরওয়া ইবনে যুবায়ের।
(জন্ম. ২৩ হি.-মৃ. ৯৪ হি.);
২- আবান ইবন উসমান (জন্ম : ২০ হি. মৃ-১০৫ হি.),
৩- ওয়াহাব ইবনে মুনাববাহ
(মৃ. ১১০ হি.).
৪- আসিম ইবনে ওমর। (মৃ. ১২১ হি.),
৫- সুরাহ বিন ইবন সাদ। (মৃ. ১২৩ হি.),
৬- আব্দুল্লাহ বিন আবু বকর।
(মৃ. ১৩০ হি.)
৭- মূসা ইবন উকবা (মৃ. ১৪১ হি.),
৮- হিশাম ইবন উরওয়া (মৃ. ১৪৬ হি.),
৯- ইবন শিহাব যুহরী।
(জন্ম. ৫১ হি.-মৃ. ১২৪ হি.)
১০- আবু আব্দুল্লাহ মাহমুদ ইবন ইসহাক
(জ. ৮৫ হি.-মৃত-১৫১ হি.)
১১- ইমাম শা’বি প্রমুখ।
ইসলামের পঞ্চম খলীফা হিসেবে খ্যাত হযরত ওমর ইবন আব্দুল আযীযের পরামর্শক্রমে রাসূল সা. এর ওফাতের পঁচাশি বছর পর ইমাম শিহাব আল যুহরী (জন্ম. ৫১ হি. মৃত-১২৪ হি.) সীরাত চর্চা শুরু করেন। তিনি যে সংক্ষেপ্ত জীবনীটি রচনা করেন সেটিই সীরাত বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ, যা বহুকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিহাব যুহরীর প্রিয় ছাত্র মূসা ইবনে উকমা
(মৃ. ১৪১ হি.) দ্বিতীয় সীরাত গ্রন্থটি রচনা করেন কিন্তু এ গ্রন্থটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর শিহাব যুহরীর আরও কয়েকজন ছাত্র-ইবন ইসহাক, ওমর ইবন রাশেদ, আবদুর রহমান ইবন আবদুল আযীয, ইবন সালেহ প্রমুখও সীরাত গ্রন্থ রচনা করেন।
তবে প্রথম সীরাতকার হিসেবে বর্তমান বিশ্বে যার নামটি সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবন ইসহাক (জ. ৮৫ হি.-মৃ-১৫১ হি.)। রাসূল সা. -এর ওফাতের মাত্র ৭৪ বছর পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী ইবন ইসহাকের রচিত ‘সীরাতু রাসূলুল্লাহ’ সীরাত বিষয়ক সর্বাধিক প্রাচীনতম এবং পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য গ্রন্থ। এরপর ইবন হিশাম তাঁর পূর্বসূরী ইবন ইসহাক রচিত ‘সীরাতু রাসূলুল্লাহ’ নামক গ্রন্থটির সংশোধিত, পরিমার্জিত, রূপ দিয়ে সংক্ষেপ্তাকারে ‘সীরাতে নবুবিয়্যা’ নামে প্রকাশ করেন যা সীরাতে ইবন হিশাম নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আজ পর্যন্ত এ গ্রন্থটি প্রামাণ্য সীরাত গ্রন্থ হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত।
নবী সা. এর সীরাত চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা:
সীরাত চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সর্বকালে, সর্বযুগে রয়েছে, এ কারণেই রয়েছে যে, তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী। মানবজাতির কল্যাণের প্রতীক হয়ে আগমন করেন এই ধরণীতে। বিশ্ববাসীকে আহ্বান করেন কল্যাণের পথে, বিরত রাখেন সমূহ অকল্যাণ থেকে। নবী সা. এর বিমূর্ত সত্তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তার অনুসারীদের সরাসরি আল্লাহর অনুসরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের বাস্তব ও সার্থক রূপায়ণ ছিলো মহানবীর গোটা জীবনচরিত।  অর্থাৎ আল-কুরআনে যেভাবে আচরণ করতে ও স্বভাব গঠন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে আচরণ ও স্বভাবের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। এ কারণেই আল্লাহ্ নবী সা. এর সীরাতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আল্লাহর রাসুলের জীবনই হলো তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা’।
(আহজাব: ২১)
পবিত্র কুরআনে যত সুন্দর, সত্য, সততা, মানবতা ও কল্যাণময় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে, তার নিখুঁত ও পরিপূর্ণ চিত্রায়ন ঘটেছিলো রাসুল সা. এর জীবনাদর্শে। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না।
সীরাতে মুহাম্মদীর অধ্যয়ন ও চর্চা জরুরি। সীরাতের বিষয় চির বসন্তকালের মতো। যার সজীবতা ও সতেজতা কখনো শেষ হয় না। আর না কিয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় নবীর সাথে উম্মতে মুহাম্মদীর সম্পর্ক একটু স্বতন্ত্র্য ও ভিন্নতর। তার অনেক কারণ রয়েছে, সবগুলো এখানে বলা সম্ভব হবে না; এক দু’টি কারণ বলি;
এক. অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ধর্মকে তাদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিদায় করে দিয়েছে। ইউরোপে রাষ্ট্র ও গীর্জার লড়াই শেষ পর্যন্ত এখানেই পরিসমাপ্ত হয় যে, মানুষের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের সাথে গির্জার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ধর্মের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ও তার সফলতা গোটা বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। ধর্মের সাথে মানুষের যে সুদৃঢ় বন্ধন ছিলো তা ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে। অন্যরা দূরে থাক, যেসব মুসলিম রাষ্ট্র ইউরোপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল কিংবা ইউরোপের উপনিবেশ ছিলো তারাও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এর ফল এই হয়েছে যে, ইউরোপিয়ান জাতিগোষ্ঠীর নিকট তাদের ধর্মীয় ব্যক্তিদের মর্যাদা ‘সম্মানীয় ব্যক্তি’ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তারা অনুসরণযোগ্য আর থাকেনি।
পক্ষান্তরে মুসলমানদের বিষয়টি সম্পূর্ণ এর থেকে ভিন্নতর ছিলো। মুসলিম সমাজে আলহামদুলিল্লাহ উলামা ও জনসাধারণের মধ্যে ক্ষমতার রশি নিয়ে কখনও টানাটানি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়নি এবং ওলামায়ে কেরামও তাদের ধর্মীয় অবস্থানকে সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। আর না বিরোধীদেরকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ কারণেই  উলামা ও  জনসাধারণের মাঝে কখনও এমন দ্বন্দ্ব-লড়াইয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপে গির্জা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিলো।
অতঃপর ইসলাম তার পয়গম্বরকে একজন আদর্শ মানব হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং তাঁর শিক্ষা-আদর্শ এতই সহজ-সরল ও মানব প্রকৃতির সাথে সাজুয্যপূর্ণ, যার ওপর আমল করা কোনই কঠিন বিষয় নয়। এজন্য এই উম্মতের সম্পর্ক তার পয়গাম্বরের সাথে শুধু সম্মান ও মর্যাদার সম্পর্ক নয়, বরং আনুগত্য ও অনুসরণেরও সম্পর্ক। ইসলামের অনুসরণ করাকে তিনি আমাদের জন্য আবশ্যকীয় ঘোষণা করেছেন। কুরআন আমাদেরকে বারবার আল্লাহর বিধি-নিষেধ ও রাসূলের শিক্ষা-আদর্শের উপর আমল করার নির্দেশ দেয় এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে কুফর আখ্যা দেয়।
সুতরাং রাসূলের সত্তার সাথে কারো আনুগত্য ও অনুসরণের সম্পর্কের অর্থ হলো তার সীরাত ও জীবনাদর্শের অধ্যয়ন ও চর্চা করা অপরিহার্য। কেননা এই অধ্যয়ন ও চর্চা ছাড়া তার আনুগত্য ও অনুসরণ সম্ভব নয়।
দুই. পয়গম্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনিবার্য প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। কেননা তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল ও তাঁর প্রিয় বান্দা। শুধু রাসূলের ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং সে ভালবাসা হতে হবে উম্মাদনা ও পাগলের মতো। এমন ভালবাসা যা নিজের জান-প্রাণ থেকেও বেশি হবে। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি থেকেও বেশি রাসূলকে ভালো না বাসবে।’
(বুখারী ও মুসলিম)
বাস্তব কথা হলো, আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের অন্তরে রাসূলের এমন ভালবাসা প্রোথিত করে দিয়েছেন যা অতি পবিত্র, সত্য, নিষ্কলুষ ও নির্মল, যার কোনো তুলনা পৃথিবীতে নেই। সুতরাং মুসলমানদের সম্মিলিত আকীদা-বিশ্বাস হলো, রাসূলের সম্মান ও ভালবাসা ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তার অবমাননা ও অসম্মান কুফর ও ইরতিদাদের (ধর্মান্তর) কারণ। এটি সর্বস্বীকৃত বিষয়।
রাসূলের প্রতি এই ভালবাসা ততক্ষণ সৃষ্টি হতে পারে না, যতক্ষণ তার জীবন ও সীরাতকে অধ্যয়ন ও চর্চা না করা হবে। কারণ যতক্ষণ মানুষ কারো ব্যক্তিত্ব, তার পবিত্র জীবন ও কীর্তি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল না হবে ততক্ষণ তার অন্তরে ওই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে না আযমত ও মুহাব্বত সৃষ্টি হবে আর না তার সত্য ভালবাসা তার অন্তরে বিকশিত হবে। এ বিষয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক ব্যক্তি রামের পূজা করেও হিন্দু হয় আবার রামের প্রতিকৃতি অগ্নিদগ্ধ করেও হিন্দু হয়। খৃস্টানদের সাথে ইহুদীদের উঞ্চ সম্পর্কের ধরনটিই দেখুন। ইহুদীরা আজও হযরত ঈসা মসীহকে জারজ সন্তান এবং হযরত মারিয়ামকে যিনাকারীনি আখ্যা দেয়। এখন চিন্তা করুন, হযরত ঈসার কতটুকু আযমত, মুহাব্বত ও ভালবাসা তাদের অন্তরে আছে?
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ও অনুসরণের জন্যে, তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুহাব্বত-ভালোবাসায় হৃদয়-মনকে সিক্ত করার জন্যে, ঈমানের সুরক্ষার জন্যে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কলম ও বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সহীহ সূত্রের সীরাতে নববী অধ্যয়ন করা সময়ের অপরিহার্য দাবী। যার প্রতি অবহেলা করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।
ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে তো আমরা সুন্নাতে নববীর দিকে প্রত্যাবর্তন করি অনেকেই, কিন্তু সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনকে আমরা সীরাতে নববীর আলোকে সজ্জিত করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। অথচ এগুলো ছাড়া ইসলামকে কল্পনাই করা যায় না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের ওপর ঈমান আনার সাথে সাথে তার পূর্ণাঙ্গতার ওপরও ঈমান ও আস্থা পোষণ করতে হবে। এমনিভাবে সীরাতে নববীর আলোকে আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে কোথায় মুসলমানদের অবস্থা মক্কী জীবনের মতো এবং সেখানে আমাদের ভূমিকা কী হবে আর কোথায় মুসলমানদের অবস্থা মাদানী জীবনের মতো এবং সেখানে আমাদের জন্য রাসূলের আদর্শ কী?
উপসংহার:
বর্তমান বিশ্বের অবস্থা এটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বর্তমান পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন সামনে আসছে। আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম সারা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। বস্ত্তবাদের সয়লাব। চারিদিকে ভোগ-সামগ্রীর ছড়াছড়ি। শহর তো শহর, গ্রামগঞ্জও আজ আধুনিকতার সাজে সজ্জিত। শুধু উন্নতি হয়নি মানবতার। চরিত্র ও নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নেই। শান্তি ও নিরাপত্তাও নেই। সর্বত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মানুষের অধিকার। চারিদিকে ভয় ও শংকা। কখন কোথায় কী হয়ে যায় কারোরই জানা নেই। নিরাপত্তাহীনতা একটি সমাধানহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নীতি-নৈতিকতা তো এভাবে নষ্ট হয়েছে যে, যেকোন সময় শক্তিশালী দল বা গোষ্ঠী দুর্বলের উপর চড়াও হয়ে বসে। হাসতে হাসতে কোনো রাষ্ট্রকে ইরাক, আফগানিস্তান বানিয়ে দেয়। শিল্পকলার নামে অশ্লীলতা বৈধ করা হচ্ছে। নারীর মান-সম্মান বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি অশান্তি ও অনিরাপত্তার এমন প্রাদুর্ভাব হয়েছে যে, শান্তির হাজার উপকরণ উদ্ভাবন করেও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের পূর্বে দুনিয়ার অবস্থা তো ইতিহাস সাক্ষী এমনই অবর্ণনীয় অবস্থা চৌদ্দশত বছর আগেও পৃথিবীতে বিরাজ করছিলো। যখন দুনিয়া থেকে মানবিকতা নিশ্চিহ্ন হতে চলেছিল। শুধু আরব ভূখন্ডে কেন সারা বিশ্বে অনিরাপত্তা আর অনিশ্চয়তা ছেয়ে গিয়েছিল। সর্বত্র ভয় ও আতংক বিরাজ করছিল। ন্যায়নীতি ও নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। মানুষের কোনো মূল্য মানুষের কাছে ছিল না। কন্যা সন্তানদের জ্যান্ত কবর দেওয়া হতো। দাস-দাসীদের সাথে জানোয়ারের মতো আচরণ করা হতো। মদ, জুয়া, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি এবং সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীলতা ছিল সাধারণ বিষয়। পৃথিবীর সেই কঠিনতম সময়েই মানবতার দিশারী, মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের মাটিতে আগমন করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় জীবন-পদ্ধতি ও শিক্ষা দেখতে দেখতেই মানবজাতির রূপ বদলে গিয়েছে। তেইশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে আরব ভূখন্ডের মূর্খ, অশিক্ষিত, উসৃঙ্খল, দ্বন্দ্ববাজ এবং  নারীদের জ্যান্ত কবর দানকারী মানুষেরা, একটি সুশৃঙ্খল, সুশিক্ষিত, চরিত্রবান, আদর্শবান, শান্তিপ্রিয় এবং মানুষের অধিকার রক্ষাকারী জাতিতে পরিণত হয়েছিল। আজও প্রয়োজন সেই সীরাতে নববীর বাণীকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। যদি বর্তমান বিশ্ব বাস্তবিক পক্ষেই বস্ত্তগত উন্নয়নের সাথে সাথে চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নতি চায় এবং মানুষকে একটি নিরাপদ ও সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে অবশ্যই রাসূলের আদর্শকে চোখের মণি বানিয়ে চলতে হবে। কারণ, বর্তমান সমস্যার সমাধান একমাত্র সীরাতে নববীর মধ্যেই রয়েছে। সীরাত সর্বকালের মানুষের জন্য কল্যাণময় এক আদর্শ।
তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী সা. এর সীরাত বা পবিত্র জীবনচরিত। সুতরাং সেই পথেই হোক আমাদের নবযাত্রা। আদর্শিক প্রত্যয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক আমাদের আগামীর সমাজিক জীবন।