বইমেলার পরিবেশ ও প্রকাশক প্রসঙ্গে কিছু কথা
একুশে জার্নাল ডটকম
অক্টোবর ২৯ ২০২২, ১৫:০৭
সৈয়দ শামছুল হুদা: গতকাল বাদজুমআ কিছু সময় বায়তুল মুকাররম আয়োজিত বইমেলায় ছিলাম। উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক। কযেকজন প্রকাশক ও প্রকাশনার সাথে জড়িত ভাইয়ের সাথে দেখা- সাক্ষাত হয়েছে। কয়েক জায়গায় দেখলাম প্রকাশনা উৎসবও হচ্ছে। সেখানে আমাদের তুমুল জনপ্রিয় বক্তাদের খুব দাপুটে উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। মুহতারাম খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবি ও আলী হাসান উসামার ভক্তদের উচ্ছাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন মাগরিবের আজান হচ্ছে, তখন হঠাৎ করেই দক্ষিণ পাশের গেইটে মনে হলো মিছিল এর আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, একদল মানুষ জটলা বেধে পূর্ব থেকে বসে থাকা মুসুল্লিদের ছিটকে ফেলে হই-হুল্লোড় করে মসজিদে প্রবেশ করছে। কী ঘটছে জানতে চেষ্টা করলে জানতে পারলাম যে, আলী হাসান উসামা এসেছে।
নামাযের পর যখন মেলার পশ্চিমমুখি গলিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, তখনও দেখলাম, প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে, ধাক্কাধাক্কি করে কিছূ লোকের ছুটে আসা দেখে নিজেদের সামলে নিয়ে উৎসুখ নজরে যখন বিষয়টি দেখতে গেলাম, জানতে পারলাম, মেলার কোনো একটি স্টলে এসেছেন আলী হাসান উসামা। বিষয়টি খুবই দৃষ্টিকটু লাগলো। আমরা আবেগ দেখাতে গিয়ে মসজিদের প্রবেশ পথে, মেলার প্রচন্ড ভীড় ঠেলে এই যে অতি উৎসাহ প্রদর্শন করলাম, ভক্তদের বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করলাম এটা কতটা ঠিক হয়েছে বা হচ্ছে তা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার হয়নি। এটাতো ছিল বইমেলা, এটাতো জিহাদের ময়দান না যে, শত্রুকে কুপোকাত করে এগিয়ে যেতে হবে। একটু ধৈর্য, একটু সহনশীলতা, অন্যদের কোনো কষ্ট হচ্ছে কী না সে দিকটায় কেউ কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপও করে না। দোষটা অবশ্যই আলী হাসান উসামার নয়, এটা অতি আবেগি ভক্তদের। একজনকে সম্মান দেখাতে গিয়ে অন্য কারো কষ্ট হচ্ছে কী না সে বিষয়টি ভক্তদের মাথায় রাখা উচিত। যাক গে…
যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম দুয়েকজন প্রকাশক ও প্রকাশনার সাথে জড়িত ভাইদের কথায় বুঝলাম, মেলায় লোক বেশি, ভীড় প্রচন্ড, জায়গা নেই, জায়গা নেই অবস্থা। কিন্তু বেচা-কেনা খুব একটা ভালো না। তুলনামূলক অনেক কম। বইমেলা ঘুরে আমার কাছে মনে হয়েছে, বই বিক্রি কম হওয়ার পেছনে প্রকাশকদের চালাকিও কম দায়ী নয়। তারা আসলে পাঠকদের প্রচন্ডভাবে ঠকাচ্ছে। প্রথম বিষয় হচ্ছে বইয়ের মূল্য আকাশচুম্বি। দ্বিতীয়ত: বইগুলোকে অহেতুক টেনে-টুনে পৃষ্টার সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয়ত: কমগুরুত্বপূর্ণ বইকে খুব সুন্দর কভার ডিজাইন, ম্যাকাপ, গেটাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এসব কারণে পাঠক আসলে বই কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
৪শ’ পৃষ্ঠার একটি গল্পের বইয়ের দাম ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। ইতিহাসের বইগুলোকে এত বেশি বড় করা হয়েছে যেটা চাইলেই আরো ছোট আকারে প্রকাশ করা যেতো। এতে পাঠক অল্পদামে ভালো কিছূ বই পেতো। বর্তমানে প্রকাশকরা ওভার কমার্শিয়াল। তারা সত্যিকার জ্ঞান-পিপাসুদের চিন্তা করে বই প্রকাশ করে না। তারা দুর্নীতিগ্রস্থ সৌখিন ব্যক্তিদের পকেট দেখে বই বাজারে নিয়ে আসে। যারা বই কিনে পড়বে না, শো-কেস সাজাবে। বইয়ের প্রদর্শনী করবে। তাদের কিছু ভারি বই থাকলে ড্রয়িং রুমটা দেখতে সুন্দর লাগবে। কিন্তু সাধারণ অনুসন্ধানী পাঠক চাইলেও বই কিনতে পারছে না।
এটাতো যেন মেলা নয়, মাছ বাজার। এখানে দাঁড়িয়ে কোনো অবস্থাতেই বই যাছাই করে, দেখে, ভেবে-চিন্তে কিনার কোনো সুুযোগ নেই। পরিবেশ নেই। প্রতিটি প্রকাশনীতেই বইয়ের বিশাল সমাহার। কার বইটি কেমন এটা তফাৎ করার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া প্রকাশকদের অসততাতো আছেই। ‘লা তাহযান’ বইয়ের প্রায় ৩০টি অনুবাদ বাজারে। ‘আর রাহীকুল মাখতুম’ এরও প্রায় অনুরূপ সংখ্যা বাজারে। কার অনুবাদ কেমন? কে পাঠককে ধোকা দিয়েছে, কে ভালো অনুবাদ করেছে এগুলো পাঠকের বুঝার কোনোও সুযোগ নেই। আলী সাল্লামী, তাকী উসমানী, ইসমাইল রোহান প্রমুখদের বইগুলো নানাভাবে কাটছাট করে পাঠকদের কাছে পৌঁছানো হয়। কোনটা নতুন বই, কোনটা পুরাতন, কোনটা জুড়াতালি দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে বুঝাও খুব কঠিন। এভাবে প্রকাশক পাঠকদের ঠকাচ্ছে।
দ্রব্যমূল্যর চরম উর্ধ্বগতির এই সময়ে পাঠকদের প্রতি একটু সদয় হওয়ার জন্য, ভালো বইগুলো অহেতুক কলেবর না বাড়িয়ে পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য প্রকাশকদের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখবো। আর কোনো প্রকাশক একটি বই বাজারে আনলে সেটার পেছনেই হুমড়ি খেয়ে না পড়ে সকলেই চেষ্টা করেন নতুন কিছু উপহার দিতে। মান-সম্পন্ন অল্প বই বের করেন, দেশের ধর্মপ্রাণ শ্রেণিটির হাতে ভালো মানের গবেষণামূলক, শিক্ষামূলক আরো বেশি বই উপহার দিন। চটকদার বিজ্ঞাপন আর কভার দিয়ে আমাদের চমকে না দিয়ে ভেতরে ভালো কিছু কন্টেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করেন। একই বই নিয়ে সকলে কাড়াকাড়ি না করে হাজারো বই আছে আরবি, ইংরেজিতে, সেগুলো বাজারে নিয়ে আসেন। আর সত্যিকার লেখকদের পেছনে অর্থ খরচ করেন।
দয়া করে ইসলামপ্রিয় মানুষদের আবেগকে ধ্বংস করবেন না। তারা একসময় বই পড়তো না। আপনারাই তাদেরকে পাঠমুখি করেছেন। এখন তাদেরকে ধরে রাখার দায়িত্বও আপনাদের। ভালো মানের নিত্য-নতুন বই না পেলে তাদেরকে ধরে রাখতে পারবেন না। যোগ্য লেখকদের মূল্যায়ণ করুন। দেশের সেরা লেখকদের তুলে আনুন।