পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার করা ও তাদের হক্ব আদায় করা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ০৪ ২০২০, ১৮:৪৮

আব্দুল কাদির আল মাহদি: পিতা-মাতা হচ্ছেন আমাদের দুনিয়াতে আসার মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলার আহকামাতের মাঝে সবচেয়ে উপরের অন্যতম হুকুম হচ্ছে তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া। আল্লাহ তা’আলা নিজেই অনেক আয়াতে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে এবং রাসুল (সা) এর অসংখ্য হাদিসও এ বিষয়ের উপর খুব বেশি গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। এমনকি আম্বিয়ায়ে কেরামের পর সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহিনগন বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন-

۞ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর। (আল কোরআন ৪/৩৬)

তিনি আরও বলেন –

۞ وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا

তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। (আল কোরআন ১৭/২৩)

উপরোক্ত আয়াতসমূহে লক্ষ করলে দেখবেন! আল্লাহ তা’আলা কীভাবে তাঁর একত্ববাদ ও তাঁর এবাদতের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছেন। যেটা তাঁর বান্দা হিসেবে আমাদের উপর সবচেয়ে বড় হক্ব। তারপর সাথে সাথে মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব-ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন। একাথা বুঝাতে যে তাঁর তাওহিদ ও তাঁর এবাদতের পর মাতা-পিতা প্রতি সদ্ব-ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আর এমন নির্দেশ কোরআনে পাকে আল্লাহ তা’আলা বারবার ভিবিন্নভাবে পুনরাবৃত্তি করেছেন।

রাসুল (সা) বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাস করা হল। আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তি হওয়ার সবচেয়ে প্রিয় আমাল কোনটি? দেখেন, রাসুল (সা) কী উত্তর দিয়েছিলেন?

وعن عبدالله بن مسعودٍ، قال: سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم: أي العمل أفضل؟ قال: (الصلاة لوقتها)، قال: قلت: ثم أي؟ قال: (بر الوالدين)، قال: قلت: ثم أي؟ قال: (الجهاد في سبيل الله)،

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, আমি নবী (সা) -কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ্‌র নিকট কোন কাজ সব থেকে অধিক পছন্দনীয়? তিনি বললেনঃসময় মত সালাত আদায় করা। (‘আবদুল্লাহ) জিজ্ঞেস করলেন: তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃপিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। ‘আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন: তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃআল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করা। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)

পিতা-মাতার অনুমতি ছাড়া ইয়েমেন থেকে এক লোক রাসুল (সা) এর কাছে জিহাদে শরিক হওয়ার জন্য আসল। রাসুল (সা) কী নির্দেশ করলেন!

وعن أبي سعيد رضي الله عنه أن رجلا من أهل اليمن هاجر إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال هل لك أحد باليمن قال أبواي قال أذنا لك قال لا

قال فارجع إليهما فاستأذنهما فإن أذنا لك فجاهد وإلا فبرهما

আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা) হতে বর্ণিত। এক লোক জিহাদে শরিক হতে ইয়েমেন থেকে হিজরত করে রাসুল (সা) এর দরবারে হাজির হল। রাসুল (সা) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়েমেনে তুমার কি কেউ আছে? লোকটি জবাব দিল হ্যাঁ আমার মাতা-পিতা আছেন।

রাসুল (সা) বললেন, তুমি কি তাদের অনুমতি নিয়ে এসেছ? লকটি জবাব দিল, না অনুমতি নেইনি। রাসুল (সা) নির্দেশ করলেন। যাও, তাদের কাছে অনুমতি চাও। যদি অনুমতি পাও জিহাদে শরিক হবে নতুবা তাদের খেদমত করতে থাকবে। (আবু দাউদ)

মাতা-পিতার সাথে ভাল ব্যবহার করা অনেক বড় আমাল। আল্লাহর নৈকঠ্য লাভের মাধ্যম এবং জান্নাতে যাওয়ার কারন।

وعن عبد الله بن عمرو رضي الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم رضا الله في رضا الوالد وسخط الله في سخط الوالد

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বর্ণনা করেন যে রাসুল (সা) বলেছেনঃ পিতা-মাতার সন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি এবং পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই আল্লাহ্ তা‘আলার অসন্তুষ্টি। (জামে’ আত-তিরমিজি)

***পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও সদ্ব-ব্যবহারের হক্ব রাখেন-

মাতা-পিতা যদি ননমুসলিম হন তারপরও তাদের সাথে সদ্ব-ব্যবহার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যদি তারা দ্বীন ছাড়তে পীড়াপীড়ি না করেন। যদি কোন কারনে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ পালনে তারা বাঁধা হয়ে দাঁড়ান তখন তাদের নির্দেশ না মানলে কোন অসুবিধা নেই কিন্ত্ব ভাল ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ তা’আলার বাণী-

وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا ۖ وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। (আল কোরআন ৩১/১৫)

وعن أسماء بنت أبي بكر رضي الله عنهما قالت قدمت علي أمي وهي مشركة في عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فاستفتيت رسول الله صلى الله عليه وسلم قلت قدمت علي أمي وهي راغبة أفأصل أمي قال نعم صلي أمك

আসমা বিনতে আবু বকর (রা) তিনি বলেনঃ কুরাইশরা যে সময়ে রাসুল (সা) এর সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করেছিল, ঐ চুক্তিবদ্ধ সময়ে আমার মা তাঁর পিতার সঙ্গে এলেন। আমি নবী (সা) -এর কাছে জিজ্ঞেস করলামঃ আমার মা এসেছেন, তবে সে অমুসলিম। আমি কি তাঁর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করবো? তিনি বললেনঃ হাঁ। তোমার মায়ের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)

***আরেকটি বিষয় হচ্ছে সন্তান-সন্ততি উপর মা’দের স্পেশাল হক্ব রয়েছে। যেটি হাদিস থেকে পাওয়া যায়।

عن أبي هريرة رضي الله عنه: قال: جاء رجل إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول الله من أحق الناس بحسن صحابتي؟

«قال: أمك، قال: ثم من؟ قال: ثم أمك، قال ثم من؟ قال: ثم أمك، قال: ثم من؟ قال: ثم أبوك». البخاري:

আবু হুরায়রা (রা) তিনি বলেন, এক লোক রসুল (সা) -এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহ্‌র রসুল! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেনঃতোমার মা। লোকটি বললোঃ অতঃপর কে? নবী (সা) বললেনঃতোমার মা। সে বললোঃ অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বললোঃ অতঃপর কে? তিনি বললেনঃঅতঃপর তোমার বাবা।(সহিহ বুখারী ও মুসলিম)

কিন্তু এর মানে এই নয় যে পিতাদের হক্ব কম করে ফেলবে, বরং পিতার হক্বকে না কমিয়ে মা’র হক্বের প্রতিও গুরুত্ব দেবে।

**পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব-ব্যবহারের কিছু উদাহরণ-

আবু হুরায়রা (রা) যখন ঘর থেকে বাহির হতেন অথবা ঘরে আসতেন তখন তিনি তার মায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিতেন। এমন আমল তাঁর নিয়মতান্ত্রিক ছিল।

আলী ইবনে হুসাইন (রা) তিনি তাঁর মা’র সাথে এক প্লেইটে খানা খেতেন না এই ভয়ে, যদি না তার হাত মা’র হাতের আগে প্লেইটে চলে যায়!

আওন ইবনে আব্দুল্লাহ (র) তার মা’র ডাকে উঁচু আওয়াজে সাড়া দিতেন এই চিন্তা করে, হয়ত নিচু আওয়াজে সাড়া দিলে মায়ের শুনতে কষ্ঠ পেতে হবে।

মিস’আর বিন হাবিবুল জারামী (র) এর মা একদা রাত পানি পান করতে চাইলেন। ঘরে পানি না থাকায় তিনি বাহিরে পানি আনতে গিয়ে দেখলেন মা ঘুমিয়ে পডেছেন। তিনি ফজর পর্যন্ত তার মা’য়ের পাশে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, এই ভয়ে কখন যেন মা সজাগ হয়ে পানি চেয়ে বসেন।

এসব থেকে যাহা শিখলাম বুঝলাম। মাতা-পিতার সাথে এরকম সর্বাবস্থায় ভাল ব্যবহার জরুরী। আর এটা তো সবচেয়ে বড় এবাদত। তাছাড়া আখেরাতে এর সাওয়াব অনেক কিন্তু দুনিয়াতে তার আছর পরিলক্ষিত। কেননা বলা হয়ে থাকে (ان الله جعل الجزاء من جنس العمل) আল্লাহ তা’আলা বদলা দিয়ে থাকেন কাজের ধরন অনুযায়ী।

তাদের সাথে দুনিয়াতে ভাল ব্যবহার করলে আমার থেকে জন্ম নেয়া সন্তান-সন্ততি আমার সাথে ভাল ব্যবহার করবে। এটা দুনিয়াতে আমার প্রতিদান।

পিতা-মাতার প্রতি ভাল ব্যবহারের ভিবিন্ন দিক আছে। ভিবিন্ন পদ্ধতি আছে। সর্বশেষ চূড়ান্ত কথা হচ্ছে- পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সাথে নরম সুরে কথা বলতে হবে। সম্মানসূচক শব্দমালা দিয়ে তাদের সম্বোধন করতে হবে। তাদের প্রয়োজন মিটানোর চেষ্টা করতে হবে। তাদের বেশি বেশি সহচর্য গ্রহন নিজের জন্য ভাগ্যের মনে করতে হবে। তাদের সাথে ভাল ব্যবহারের জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তানদের উপদেশ করতে হবে।

**মৃত্যুর পর যেভাবে মাতা-পিতার হক্ব আদায় করব-

মাতা-পিতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার তাদের মৃত্যুর দ্বারা সমাপ্ত হয়ে যায় না। মৃত্যু পরবর্তিও বলবৎ থাকে। রাসুল (সা) এর হাদিস হচ্ছে-

‎عن أبي أُسيد الساعدي  قال: بينا نحن جلوس عند رسول الله ﷺ إذ جاءه رجل من بني سلمة فقال: يا رسول الله، هل بقي من بر أبويّ شيء أبرهما به بعد موتهما؟ فقال: نعم، الصلاة عليهما، والاستغفار لهما، وإنفاذ عهدهما من بعدهما، وصلة الرحم التي لا توصل إلا بهما، وإكرام صديقهما[1]

আবু উসাইদ আস সা’ঈদী তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুল (সা) –এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এ সময় বনী সালিমার এক লোক তাঁর নিকট এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের প্রতি হক রয়েছে যা আমি পালন করবো? তিনি বললেনঃ হাঁ, তাদের জন্য রহমতের দু’আ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের ওয়াদা পূরণ করা, তাদের উভয়ের মাধ্যমে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে তা রক্ষা করা এবং তাদের বন্ধুদের সম্মান করা (খোঁজ-খবর রাখা)।(সুনানে আবু দাউদ)

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে আমাদের মাতা-পিতার সাথে সদ্ব-ব্যবহারের তাওফিক দান করুন। আমিন

দারুল কোরআন ইসলামিক সেন্টার বার্সেলোনা স্পেন থেকে প্রদত্ত জুম্মার খুতবা।