পরনিন্দা ইসলামে নিষিদ্ধ -আহমদ যাকারিয়া
একুশে জার্নাল
সেপ্টেম্বর ০১ ২০১৮, ০০:০৫
আহমদ যাকারিয়া: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন ছাড়া একাকী জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে সহজ নয়, তেমনটি কেউ কামনাও করে না। আবার পরিচিত সমাজের বাইরেও মানুষের পক্ষে চলা খুবই কঠিন। পৃথিবীর সমাজবদ্ধ কোনো মানুষই সামাজিক বিপর্যয় কামনা করতে পারেন না। মানুষ সব সময় সুখ ও শান্তি চায়। শান্তি মানুষের একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু এই প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এসব পার্থক্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যই এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ সূরা হুজরাতে এরশাদ করেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿13﴾
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
সুতরাং মানব সমাজের এই পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তেই। যেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গীবত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে। তাই তো মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এই নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন।
গীবত বা দোষচর্চা করা সমাজে এখন একটি জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ গীবত করতে আল্লাহ পাক কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। সর্বোপরি তিনি গীবতকে এমন ঘৃণ্যভাবে চিত্রিত করেছেন, যেকোন মনই তার প্রতি বিতৃষ্ণ হবে। তিনি বলেছেন,
وَلاَ يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ–
‘তোমরা একে অপরের যেন গীবত না কর। তোমাদের কেউ কি স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ পসন্দ করে? অনন্তর তোমরা তা অপসন্দ কর’ (হুজুরাত ১২)।
‘গীবত’-এর পরিচয় প্রসঙ্গে নবী করীম (সঃ) সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ؟ قَالُوا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ : ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ. قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِى أَخِى مَا أَقُولُ؟ قَالَ : إِنْ كَانَ فِيْهِ مَا تَقُولُ فَقَدِ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيْهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ–
‘তোমরা কি জান ‘গীবত’ কী? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, তোমার ভাই যে কথা অপসন্দ করে তার সম্পর্কে সে কথা বলার নামই হলো গীবত। জিজ্ঞেস করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবেই তুমি তার ‘গীবত’ করলে। আর যদি না থাকে তাহলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে’।
সুতরাং মানুষের মধ্যে যে দোষ আছে এবং যার চর্চা সে অপসন্দ করে তা আলোচনা করাই গীবত। চাই সে দোষ তার শরীর সংক্রান্ত হোক কিংবা দ্বীন ও চরিত্র বিষয়ক হোক কিংবা আকার-আকৃতি বিষয়ক হোক।
আল্লাহ পাকের নিকটে গীবত বড়ই কদর্য ও খারাপ কাজ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ গীবতের ব্যাপারে খুবই উদাসীনতা দেখিয়ে থাকে। এজন্য গীবতের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে নবী করীম (সঃ) বলেছেন,
اَلرِّبَا اثْنَانِ وَسَبْعُونَ بَابًا أَدْنَاهَا مِثْلُ إِتْيَانِ الرَّجُلِ أُمَّهُ وَأَرْبَا الرِّبَا اسْتِطَالَةُ الرَّجُلِ فِيْ عِرْضِ أَخِيهِ–
‘সূদের (পাপের) ৭২টি দরজা বা স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নতম স্তর হচ্ছে স্বীয় মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া তুল্য পাপ এবং ঊর্ধ্বতম স্তর হ’ল কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার এক ভাইয়ের মান-সম্ভ্রমের হানি ঘটান তুল্য পাপ’।
যে মজলিসে কারও গীবত করা হয় সেখানে যে ব্যক্তিই উপস্থিত থাকুক তাকে তা নিষেধ করা ওয়াজিব। যে ভাইয়ের গীবত করা হয় তার পক্ষ নিয়ে সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করাও আবশ্যক। সম্ভব হলে ঐ মজলিসেই গীবতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নবী করীম (সঃ) বলেছেন,
مَنْ رَدَّ عَنْ عِرْضِ أَخِيهِ رَدَّ اللهُ عَنْ وَجْهِهِ النَّارَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ–
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মান-সম্ভ্রমের বিরুদ্ধে কৃত হামলাকে প্রতিহত করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার থেকে জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত করবেন’।
একদা ‘আয়শা (রাঃ) সাফিয়্যাহ (রাঃ) এর পেছনে তার শারীরিক খর্বাকৃতির ব্যাপারটি রাসূল (সাঃ) এর সামনে তুলে ধরলে তিনি তাঁকে বলেন:
لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَتْ بِمَاءِ الْبَحْرِ لَمَزَجَتْهُ، قَالَتْ: وَحَكَيْتُ لَهُ إِنْسَانًا فَقَالَ: مَا أُحِبُّ أَنِّيْ حَكَيْتُ إِنْسَانًا وَأَنَّ لِيْ كَذَا وَكَذَا.
‘‘তুমি এমন কথা বললে যা এক সাগর পানির সাথে মিশালেও তা মিশে যাবে বরং তা বাড়তি বলেও মনে হবে। ‘আয়িশা রাঃ বলেন: আমি রাসূল (সাঃ) এর সামনে জনৈক ব্যক্তির অভিনয় করলে তিনি আমাকে বলেন: আমি এটা পছন্দ করি না যে, আমি কারোর অভিনয় করবো আর আমি এতো এতো কিছুর মালিক হবো’’। (আবূ দাউদ ৪৮৭৫)
রাসূল সাঃ মি’রাজে গীবতকারীদের শাস্তি স্বচক্ষে দেখেছেন।
আনাস বিন মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন: রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন:
لَمَّا عُرِجَ بِيْ مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَـهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُوْنَ وُجُوْهَهُمْ وَصُدُوْرَهُمْ، فَقُلْتُ: مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيْلُ ؟ قَالَ: هَؤُلَاءِ الَّذِيْنَيَأْكُلُوْنَ لُـحُوْمَ النَّاسِ وَيَقَعُوْنَ فِيْ أَعْرَاضِهِمْ.
‘‘যখন আমি মি’রাজে গেলাম তখন এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম যারা তামার নখ দিয়ে নিজেদের বক্ষ ও মুখমন্ডল ক্ষতবিক্ষত করছে। আমি বললাম: এরা কারা হে জিবরাঈল! তিনি বললেন: এরা ওরা যারা মানুষের গোস্ত খায় এবং তাদের ইজ্জত লুটায়’’। (আবূ দাউদ ৪৮৭৮)
গীবত নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।
‘গীবত” এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- অপবাদ, অসাক্ষাতে নিন্দা করা, অপরের কুৎসা রটনা করা, কারো চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা ইত্যাদি। আর ইসলামী পরিষাভায় গীবত হচ্ছে কারো ব্যাপারে তার অনুপস্থিতিতে এমন কোনো কথা বলা, যা শুনলে সে মনোকষ্টে ভুগবে এবং এটাকে অপ্রিয় মনে করবে। অপরের দোষের দিকে দৃষ্টি রেখে যে কথা বলা হয় তাই মূলত গীবত। মোটকথা যা মানুষের সম্মুখে বললে মনে বিরক্তি ও কষ্ট আসে, মানুষের অগোচরে তা বলাই হলো গীবত। মানুষের অগোচরে তার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা অধিকাংশ সময়-ই আলোচনা- পর্যালোচনা করে থাকি; এসব আলোচনায় সংশোধনের দিকটি যতটুকু না গুরুত্ব পায় তারচেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে পারষ্পরিক দোষচর্চা। এই দোষ চর্চায় মেতে থাকা এখন আমাদের সমাজের একটা বড় রুগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দোষচর্চায় লিপ্ত হতে হতে অবস্থা এমন হয়েছে যে, এটা যে অপরাধ এই বোধটুকুই এখন জন্ম নেয় না আমাদের অন্তরে। অপরের দোষ দেখার আগে নিজের সাড়ে তিন হাত শরীরের মধ্যে যে কত ধরনের দোষ রয়েছে সেদিকে খেয়াল দেয়ার ফুরসতটুকুও যেন নেই আমাদের। আত্মসমালোচনা করে নিজেকে আত্মসংশোধন করে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ অথচ আমরা এই মূল কাজ রেখে অযথা অপরের দোষচর্চায় লিপ্ত হয়ে নিজেকে তো উন্নত করছি-ই না বরং নিজের যে অবস্থান ছিল সেই অবস্থান থেকে সরে নিজেকে দিন দিন অধঃপতনের শেষ সীমায় পতিত করতেছি। অপরের দোষচর্চা করে যদি তার প্রাত্যহিক জীবনের কোন উপকার বয়ে আনতো তাহলে তো কিছু বলার ছিল না; কিন্তু এই দোষচর্চার কারণে পারষ্পরিক বোঝাপড়া, চলাচলের মধ্যে মতবিরোধ সহ অনেক মতভিন্নতা তৈরী হয়। সমাজে যত ধরনের অনাচার আর বিশৃঙ্খলা এসবের পেছনে মূল কারন হচ্ছে এই “দোষচর্চা”। দোষচর্চা একসময় নোংরা আলোচনায় গড়ায়। আর পরে তা ঝগড়ার কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
পরনিন্দা সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেছেন, ‘পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও ঘৃণ্য ও জঘন্যতম।পরনিন্দাকারী এবং পরনিন্দা শ্রবণকারী উভয়ই সমান অপরাধী।’
অথচ কুৎসিত এই পরনিন্দা আজকে মহামারী আকারে আমাদের সমাজে বিষ ছড়াচ্ছে। পরনিন্দার মূল উৎস হলো “গর্ব ও অহংকার”। অনেক সময় আমরা এর জোরে মানুষকে খাটো করে দেখি, দোষ-গুণ বিচার না করেই মিথ্যার আলোকে পরচর্চা করি। অন্যদিকে বংশ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রূপ, সৌন্দর্য্য ও বিদ্যা-বুদ্ধির জোরেও মানুষকে নির্বোধ ও বোকা ভাবি এবং পরনিন্দায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতে চাই।
ইসলাম সব ধরনের অশ্লীলতা ও অশালীন উক্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যে কথা শুনলে মানুষ কষ্ট পাবে, তাই অশালীন। “কারো সম্পর্কে অপ্রীতিকর বাক্য না বলাই হলো শালীনতা”। ইসলামের আগমনই হয়েছে মানুষকে শালীনতা ও পারষ্পরিক সৌহার্দ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তাই শালীনতাকে ইসলাম মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হিসাবেও নির্ধারণ করেছে। কুরআনে এসেছে ‘আল্লাহ তা’য়ালার নিকট ওই ব্যক্তি বেশি মর্যাদাবান যে বেশি শালীন ও পরহেজগার।’
সমাজের অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে যে, পাপীর পাপ সম্পর্কে আলোচনা করলে অথবা যার যে দোষ আছে তা অন্যকে বললে গীবত হবে না; বরং এ ধরনের গর্হিত কাজের নিন্দা করা পুণ্যের কাজ। এই ধারণা ঠিক নয়, বিভ্রান্তিমূলক। যার মধ্যে যে দোষ নেই, তা যদি বলা হয়, তাহলে তা হবে মিথ্যা অপবাদ। আর যদি দোষ থেকে থাকে তখন তা হবে গীবত। এই প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কারো সম্বন্ধে তার অগোচরে এমন কোনো কথা যদি বলা হয়, যা শুনলে তার নিকট অপ্রীতিকর বোধ হয়, তবে সে কথা সত্য হলেও গীবত।’
ইমাম গাযযালী (রা.) তার ‘কিমিয়ায়ে সা’দাত’ গ্রন্থে গীবতের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, অন্যের দেহ, বংশ, বসন-ভূষণ, ভাবভঙ্গি, ক্রিয়াকলাপ, কথোপকথন ও গৃহের কোনো দোষ বের করে কিছু বললেই তাকে গীবত বলে।
দীর্ঘ দেহবিশিষ্ট লোককে লম্বু, খর্ব লোককে বামুন, কালো লোককে নিগ্রো, উজ্জ্বল লোককে সাদা, টেরা ইত্যাদি বললে দেহ সম্পর্কে গীবত হয়ে যায়। কোনো ব্যক্তিকে কোনো হীন পেশাদারের সন্তান বললে তার বংশ সম্বন্ধে গীবত হয়ে যায়। কাউকে নিন্দুক, মিথ্যাবাদী, গর্বিত, কাপুরুষ, অলস ইত্যাদি বললে তার প্রকৃতি সম্পর্কে গীবত করা হয়। কাউকে বিশ্বাসঘাতক, আমানতের খেয়ানতকারী, অসংযমী ইত্যাদি তার ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে গীবত। কারো সম্পর্কে যদি বলা হয়, তার পোশাক বেসামাল, আস্তিন ঢিলা, আচল দীর্ঘ তা হলে তার বসন-ভূষণ সম্পর্কে গীবত করা হলো। গীবত কেবল মুখ দ্বারাই হয় না। চোখ, হাত এবং ইঙ্গিত দ্বারাও গীবত হয়ে থাকে। সব ধরনের গীবতই হারাম। গীবত করা যেমন নিষেধ তেমনি গীবত শোনাও নিষেধ। যে গীবত শুনে, সেও গীবতের পাপের অংশীদার হয়ে যায়।
গীবত বা পরনিন্দাকে রাসূল (সা.) অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং এর পরিণাম সম্পর্কে তার উম্মাহকে অবহিত করেছেন। গীবতের পরিণাম সম্পর্কে নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘আগুন যেমন শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে, গীবতও তদ্রূপ মানুষের সওয়াবসমূহ ধ্বংস করে ফেলে।’
গীবত পরিহার করে চলা কঠিন কোনো কাজ নয়। নবি করিম (সা.) এটাকে কোনো কঠিন কাজ বলে মনে করেননি।
ইমাম গাযযালী (রা) তার রচিত কিমিয়ায়ে সাদাত নামক গ্রন্থে গীবত থেকে বাঁচার কিছু উপায় ও প্রতিষেধক বর্ণনা করেছেন। তিনি গীবতকে একটি রোগ বা অসুখ বলে আখ্যায়িত করে এ রোগের জ্ঞানমূলক ও অনুষ্ঠানমূলক দুটি ওষুধের কথা বলেছেন-
এক. জ্ঞানমূলক ওষুধ হচ্ছে- পবিত্র কুরআন ও হাদিসে গীবতের ক্ষতি ও অনিষ্ট সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার মর্ম উপলব্ধি করে তার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। দ্বিতীয়ত নিজের দোষ অনুসন্ধান করা। নিজের দোষ বের হওয়ার পর মনে করতে হবে, আমার ন্যায় অন্যেরও দোষ থাকা অসম্ভব নয়। নিজে যেহেতু দোষ থেকে বাঁচতে পারিনি, সেহেতু অন্যের দোষ দেখে এতো বিস্মিত হওয়ার কি আছ।
দুই. মানুষ যেসব কারণে গীবত করে তার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মানুষ যেসব কারণে গীবত করে ইমাম গাযযালী (রা.) এর সংখ্যা আটটি উল্লেখ করেছেন-
১. ক্রোধ, কেউ কারো প্রতি ক্রোধাম্বিত হলে সে তার গীবতে লিপ্ত হয়। সুতরাং ক্রোধ দমন করলেই এসব গীবত থেকে বাঁচা যায়।
২. কারো সন্তুষ্টি লাভের জন্য ওই ব্যক্তির শত্রুদের গীবত করা হয়। এ অবস্থায় মনে করতে হবে কোনো মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য আল্লাহতালার অসন্তুষ্টি অর্জন করা নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।
৩. নিজের দোষ হতে বাঁচার জন্য অপরের দোষ উদঘাটন, নিজের দোষ ঢাকার জন্য অপরের দোষ প্রকাশ করে আল্লাহতালার অসন্তুষ্টি অর্জন করা কখনো সঙ্গত হতে পারে না। এটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
৪. নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য অন্যের নিন্দা করা। অনেকে নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে উপস্থাপনের জন্য বলে থাকে, অমুকে এ ব্যাপারে কিছুই বোঝে না। এসব উক্তিতে মূর্খ ও দুর্বলেরা তার ভক্ত হলেও জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা তার ভক্ত হয় না। মূর্খ ও দুর্বলদের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্য পরম পরাক্রমশালী আল্লাহতা’আলার বিরাগভাজন হওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
৫. নিজের যোগ্যতা দিয়ে যারা মান-সম্মান অর্জন করেছে, ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তির কাছে তা সহ্য হয় না। কারণে-অকারণে সে ওই সম্মানিত ব্যক্তির দোষ অম্বেষণ করতে থাকে এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। এসব ব্যক্তি দুনিয়াতে ঈর্ষার অনলে দগ্ধ হয়, আর আখিরাতে জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হয়। হিংসুকের হিংসায় সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান এতোটুকুও লাঘব হয় না। ক্ষতি হিংসুকেরই হয়।
(৬) অনেক সময় মানুষ মজা করা কিংবা অন্যকে অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাসে মত্ত হয়। উপহাসকারী যদি বুঝত যে তার এই উপহাস তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা হলে সে উপহাসকারী না হয়ে হাস্যাস্পদ হওয়ার প্রত্যাশা করতো, কেনো না হাশরের দিন হাস্যাস্পদের পাপের বোঝা উপহাসকারীর কাঁধে চড়িয়ে দেয়া হবে।
(৭) অনেক সময় পরহেজগার ব্যক্তিরাও পাপের আলোচনা করতে গিয়ে পাপীর নামও উল্লেখ করে ফেলেন। লক্ষ্য করেন না যে, এটা গীবতের মধ্যে গণ্য হয়ে যায়। সুতরাং পাপাচার নিয়ে আলোচনা করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কখনো কারো নাম উচ্চারিত না হয় এবং কারো প্রতি ইঙ্গিত করা না হয়।
(৮) মূর্খতা মানুষের জন্য বড় অভিশাপ। অনেকে জানেই না যে, কোন্ কথা গীবতের মধ্যে পড়ে, আর কোন্ কথা গীবতের মধ্যে পড়ে না। তবে অনিষ্টকর ব্যক্তির ক্ষতি হতে জনসাধারণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে অনিষ্টকারীর নাম নেয়া বৈধ। এটা গীবতের মধ্যে পড়ে না। অনুরূপভাবে বিচারকের সামনে সাক্ষী হিসেবে পাপীর নাম নেয়া গীবত নয়। যারা প্রকাশ্যভাবে পাপ করে এবং পাপকে দোষের মনে করে না তাদের নাম নেয়া গীবত নয়।