পবিত্র আশুরার তাৎপর্য: করণীয় ও বর্জনীয়
একুশে জার্নাল ডটকম
আগস্ট ২৭ ২০২০, ১৪:২২

মাওলানা হাফিজ আবদুর রহমান বিয়ানীবাজারী: আশুরা আরবি শব্দ। এর অর্থ দশম দিন। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিনের গুরুত্ব মুসলমানদের নিকটে অন্যান্য মাস থেকে ব্যতিক্রম। মহররম মাসের দশ তারিখ পবিত্র আশুরা নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মে ১০ মহররম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় একটি দিন। পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে এই উম্মতের ওপর এদিনের রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এই রোজা নফলে পরিণত হয়ে যায়। ইসলামে এমন কিছু দিবস আছে যেগুলোতে ইবাদত-বন্দেগী বা নেক আমল করলে অন্যান্য দিন বা সময়ের তুলনায় অধিক ছাওয়াব পাওয়া যায়। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। মুসলিম উম্মাহর দ্বারে এ দিবসটি কড়া নাড়ে প্রতি বছর।
পবিত্র ১০ই ‘মহররম’ আশুরার ঐতিহাসিক কিছু তাৎপর্য্য।
• আল্লাহ পাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।
• আল্লাহ তায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)- কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।
• মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এই ১০ ই মহররম।
• ১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল গভীরে ডুবে মারা যায়, আর হযরত মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির উপর দিয়ে নদী পার হয়ে যান।
• হযরত ইউনুছ (আঃ) ৪০ দিন মাছের পেটে (দিন সম্পর্কে মত পার্থক্য রয়েছে) অবস্থানের পর ১০ ই মহররম নাজাত পেয়েছিলেন।
• হযরত নূহ (আঃ) ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর ১০ মহররম নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।
• হযরত ঈসা (আঃ) ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন শূলদণ্ড থেকে মুক্তি লাভের জন্য সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন এি ১০ ই মহররম।
• হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ (আঃ)- কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি আবার লাভ করেন ১০ ই মহররম।
• ধৈর্য্য, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হযরত আইয়ুব (আঃ) ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত থেকে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় ১০ মহররম আকস্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করেন।
• কাবাঘরের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এ তারিখেই সংগঠিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। নবী করীম (সাঃ) এর প্রিয় নাতি হযরত হুসাইন (রাঃ) কে ইয়াজিদ বাহিনী কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। আজও সেই স্মৃতিতে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
আশুরার দিনটি শুকরিয়া আদায়ের দিন: আশুরার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে এ দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুসা আ. ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরাউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ ডুবিয়ে মেরেছেন। হাদীসে এসেছে- সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনায় আগমন করলেন তিনি আশুরার দিনে ইহুদীদের সাওম পালন করতে দেখলেন। যেমন হাদীসে এসেছে “ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ স. মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা সওম পালন করছ? তারা বললঃ এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুসা আ. ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা আ. শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে সাওম পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও সাওম পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ স. বললেনঃ “তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আ. এর অধিকতর নিকটবর্তী।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ স. সাওম পালন করলেন ও অন্যদেরকে পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। আর শুকরিয়া আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হলো সাওম পালন করা। সেজন্য আল্লাহর নবী নূহ আ. এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়ায় সওম পালন করার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, ‘এ দিনেই (আশুরায়) নূহ আ. এর কিস্তি জুদি পাহাড়ে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ. শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে সে দিন সিয়াম পালন করেছিলেন।’ (মুসনাদে আহমদ, ফাতহুল বারী)। শুকরিয়া আদায়ের বিষয়ে কুরআনে কারীমে এসেছে ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের মাঝে আমার নিয়ামত বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চই আমার আযাব বড়ই কঠিন।’ (সূরা ইব্রাহিম:০৭) আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আ. এর পরিবারকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়ে বলেন ‘হে দাউদ পরিবার! শুকরিয়া হিসেবে তোমরা নেক আমল করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শুকরিয়া আদায়কারী রয়েছে।’ (সূরা সাবা: ১৩)
আশুরার রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত: আশুরার সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে সওম পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে। যেমন হাদীসে এসেছে, “আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম সওম হল আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মাস মুহাররম মাসের সওম এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত।” (সহীহ মুসলিম)। এ দিনে সাওম পালনের ফজিলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কে আশুরার সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেনঃ “ বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” (সহীহ মুসলিম ও তিরমিজি) অন্য বর্ণনায় এসেছে” আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আশুরার দিনের সাওমকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।” (সহীহ মুসলিম) হাদীসে আরো এসেছে “যে আশুরার সওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।” (মুসনাদুল বাযযার)। ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, “এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল- যে সওম পালনকারীর গুনাহ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার গুনাহ নেই আশুরার সাওম তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী) মোট কথা আশুরার দিনের সাওম হল এক বছরের রোজার সমতুল্য। রাসূলে কারীম স. এ সওমকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করতেন। রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনাতে আগমন করলেন তিনি ইহুদীদের সওম পালন করতে দেখলেন তখন তিনি সাওম পালন করলেন অন্যদের সওম পালন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনকি যারা আশুরার দিনে আহার করেছিলেন তাদের দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতীয় বছরে। কেননা তিনি হিজরতের প্রথম বছর মুহাররম মাস শেষ হওয়ার একমাস পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে মদীনাতে আগমন করেছিলেন।‘ অাম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার সওম পালন করত এবং রাসূলুল্লাহও স. সওম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ সওম পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমজান মাসের সওম ফরজ হল তখন তিনি আশুরার সওম সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশুরার সওম পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) তবে
আমরা দেখতে পাই আল্লাহর রাসূল স. প্রত্যেক আশুরাতে সওম পালন করতেন। এমনকি ইন্তেকালের বছরও তিনি বলেছিলেনঃ ‘যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আগামী বছর মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে সওম পালন করব এবং এ সওম পালন দ্বারা এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হয়।’ (সহীহ মুসলিম)। এ সকল হাদীস দ্বারা আশুরার সওমের গুরুত্ব উপলদ্ধি করা যায়।
আশুরার সওমের ব্যাপারে ইহুদীদের বিরোধীতা করার নির্দেশ: যে সকল বিষয়ে কোন শরয়ী হুকুম অবতীর্ণ হয়নি মদীনায় আসার পর সে সকল বিষয়ে নবী কারীম স. ইহুদীদের অনুরূপ আমল করা পছন্দ করতেন। যেমন তিনি মসজিদুল আকসাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীরা যেন ইসলামকে নিজেদের ধর্মের মতই মনে করে, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে যখন সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদীদের অবাধ্যতা, হিংসা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা,বর্ণবাদী নীতি ও চরম সামপ্রদায়িকতা প্রকাশ পেল তখন সকল ব্যাপারে তাদের বিরোধীতা করার নির্দেশ দেয়া হল এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যাপারে তাদের সাথে সাদৃশ্যতাপূর্ণ সকল আমল ও আচরণ করতে নিষেধ করা হল। তাই রাসূলুল্লাহ স. সংকল্প করলেন আশুরার দিনে তিনি ইহুদীদের মত আর একটি করে সাওম পালন করবেন না। বরং এ সওমের সাথে মুহাররম মাসের নবম অথবা একাদশ তারিখে একটি সাওম বাড়িয়ে রাখার মাধ্যমে ইহুদীদের ধর্ম ও সাংস্কৃতির বিরোধীতা করবেন। এর প্রমাণ হিসেবে বহু হাদীস এসেছে। যেমন- ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ স. আশুরার সওম পালন করলেন ও অন্যকে পালন করার নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেনঃ “এটা তো এমন এক দিন যাকে ইহুদী ও খৃষ্টানরা সম্মান করে থাকে।” তখন রাসূলুল্লাহ স. বললেন, আগামী বছর আসলে ইনশাআল্লাহ আমরা নবম তারিখে সওম পালন করব। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই রাসূলে কারীম স. ইন্তেকাল করলেন।” (সহীহ মুসলিম)। এ হাদীস থেকে এ কথা বুঝে নেয়ার অবকাশ নেই যে, রাসূলুল্লাহ স. আশুরার সওমটা মুহাররম মাসের দশ তারিখের পরিবর্তে নবম তারিখে পালনের সংকল্প করেছিলেন। বরং তিনি সংকল্প করেছিলেন নবম ও দশম দু দিন সাওম পালন করার। কেননা আশুরা হল দশম তারিখ। সেদিন বাদ দিয়ে সওম পালন করলে তা আশুরার সাওম বলে গণ্য হবেনা। হাদীসে এসেছে রাসুলুল্লাহ স. আশুরার সওম পালন করতে বলেছেন দশম তারিখে”।। আশুরা উপলক্ষে অপসংস্কৃতি বা কুসংস্কার: এ উপলক্ষে আমাদের সমাজে অনেক প্রকারের বেহায়াপনা শরীয়ত গর্হিত কাজ দেখা যায়। বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায় ও হুজুগীমনা মুসলমানেরা যা করে, তা অনেক ক্ষেত্রে বেদ্বীনরাও হার মানবে। যেমন তাজিয়া মিছিল বের করা,জারী পিটানো, মর্সিয়া করা, ইয়া আলী ও হাসান হুসাইন বলে শরীর রক্তাক্ত করা, শিরকী কথাবার্তা সহ ঢোল তবলা বাজিয়ে হারাম গান পরিবেশন করা, নকল কারবালার ময়দান কায়েম করা, হাসান হুসাইন ও ইয়াজিদ সহ বাহিনী বানিয়ে নাটক করা, রুটি হালুয়া বাড়ি বাড়ি বন্টন করে দেয়া ইত্যাদি সব হারাম ও ঈমান বিধ্বংসী কাজ। ঈমান রক্ষার্তে এসব থেকে আমাদের বিরত থেকে ত্যাগের শিক্ষা নিতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বলেছিলেন তার একটি ফিরে এল মুহররম কবিতার অংশে ” ফিরে এল আজ সেই মুহররম মাহিনা, ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা”।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমাদেরকে এই পবিত্র দিন সহ সদা সর্বদা সকল প্রকার অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার ও বিদআত থেকে বিরত থেকে ইবাদত বন্দেগী করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।।