নারী দিবস; ইসলাম নারী জাতিকে সম্মানিত করেছে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৮ ২০২০, ১৩:৫৭

•এহসান বিন মুজাহির•


আজ ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। বিশ্বজুড়ে এদিবসটি পালিত হয়। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও এদিবসটি উদযাপনে তৎপর। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নারী দিবসের সুচনা । ১৮৫৭সালের ৮ মার্চ আমেরিকার একটি সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ক’টি দাবি নিয়ে তারা আন্দোলন করে। তাদের শান্তিপুণ আন্দোলনে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীদের সদস্য নারীদের ওপর হামলা চালায়। গ্রেফতার করে নারীদের। এতে নারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতীবাদে ফুঁসে ওঠে। জার্মান নারীনেত্রী ক্লারা জেটকি জার্মানে এদিবসটি পালন করেন। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে নারী দিবস পালনকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে বিশ্যবাপী ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ইসলাম মানব প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবন বিধান। এখানে মানুষকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই মানুষ হিসেবে এই মর্যাদার অংশীদার। মানবকুল নারী-পুরুষ দ্বারা গঠিত। নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী কোনভাবেই আলাদা করার সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকতে হলে নারী-পুরুষের যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য। নারীর কাছে পুরুষ আর পুরুষের কাছে নারী ঋণী। এই দুই এর কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একদিকে যেমন একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্বই বিপন্ন অন্যদিকে একজনের কাছে আরেকজন অপরিহার্যভাবে ঋণী। সুতরাং ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সব জীবনেই একজনের কাছে আরেকজন দায়বদ্ধ। মা-বাবা বিশেষ কোন দিবসের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। তারা তো প্রতিদিনের মত। মা চাঁদের আলোরমত আর বাবা সূর্যের আলোরমত দরকারী। জাহেলি যুগে নারী জাতির কোনো মর্যাদা ছিল না। সে সময় নারীরা ছিল নিপীড়িত-নির্যাতিত ও অবহেলিত। নারীদের সঙ্গে করা হতো পশুর মতো আচরণ। পুরো নারী সত্ত্বাকে পরিবার, সমাজ ও বংশের জন্য অভিশাপ মনে করা হত। কন্যা সন্তান জন্মকে অসম্মান ও অপমানকর মনে করা হতো। শুধু কি তাই? নারীর অধিকার বলতে কিছুই ছিল না সমাজে। নারীরা যেমন মর্যাদা ও সম্মান পেতো না, ঠিক তেমনি তাদের ন্যায্য অধিকার (মিরাস)

উত্তরাধিকারী পেত না। কোন সম্পদের মালিকানাও লাভ করতে পারতো না। এমনকি একজন মানুষ হিসেবে যে অধিকারগুলো লাভ, তার কোনটিই বলতে গেলে নারীদের দেওয়া হত না। তাদের ইজ্জত-আব্রু নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ছিল নিম্নে। ছিল না স্বীকৃতি। বৌদ্ধ সমাজে নারীদের নিছক বিলাসিতার উপকরণ মনে করা হতো। এ ধর্মে নারী হচ্ছে ভোগের বস্তু এবং মানবতার নির্মাণ লাভের জন্য বিঘœস্বরূপ। ইয়াহুদি ধর্ম মতে নারীদের সকল পাপের উৎসমূল মনে করা হত। সেই তিমিরাচ্ছন্ন কলুষিত সমাজকে নিষ্কলুষ করার জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সত্যের বাণী নিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরার বুকে আবির্ভূত হলেন। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হল নারীর অধিকার ও মর্যাদা। বিশ্বনবীর কল্যাণে মহীয়সী নারী মর্যাদা পেয়েছে মাতা হিসেবে। পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বামীর সংসারে স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। নারী তার বৈবাহিক জীবনে খাদ্য উপার্জনের চিন্তা হতে মুক্ত হয়েছে। তেমনিভাবে সমাজের সর্বস্তরের নারীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে। নারীর মর্যাদা বলতে কী বুঝায়? মর্যাদা মানে পদ ও সম্মান। কারও পদ বা মর্যাদার অর্থ হচ্ছে যথাযথভাবে তার প্রাপ্য প্রদান করা। আর প্রাপ্য বলতে তাদের অধিকার স্বীকার করা, কর্তব্যের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানসমূহের মূল্যায়নকে বুঝায়। নারীর মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তার ন্যায্য অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যা ও তার অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন করা।

মুসলিম সভ্যতায় পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা, মূল্যায়ন, অধিকার কোনক্রমেই কম নয়। স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর জন্য ইসলাম মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। পুরুষের জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে স্ত্রীর মোহরানা আদায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, তোমরা স্ত্রীদের তার পারিবারিক জীবনে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। (সুরা নিসা: ৪)।

আল্লাহর রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান আছে যাদের সে লালন পালন করে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করে, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি দুটি মেয়ে থাকে? নবীজী বললেন, দুটি থাকলেও। (বুখারি শরিফ)।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যব্যহার করতে। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছে বড় কষ্টের সঙ্গে এবং তাকে প্রসব করেছে খুব কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভধারণ করতে এবং প্রসবান্ত দুধ ছাড়াতে ত্রিশ মাস সময় লেগেছে।’ (আহকাফ : ১৫)

নারীর মর্যাদা ইজ্জত সতিত্ব সুরক্ষার জন্য আল্লাহতায়ালা পর্দার বিধান ফরজ করেছেন। কুরআনে এরশাদ হয়েছে, হে নবী! মুমিনদের বলে দিন, তারা যেন পরস্ত্রী থেকে তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং নিজ যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তেমনি মুমিন নারীদের বলে দিন, পুরুষের থেকে তাদের দৃষ্টি যেন অবনমিত রাখে এবং স্বীয় যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। (সুরা নুর: ৩০)।

নারীরা পুরুষ থেকে পর্দা করবে। তার রূপ-সৌন্দর্য পরপুরুষ থেকে আবৃত রাখবে। পর্দার অর্থ এই নয় যে, নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা বরং প্রয়োজনে পর্দার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম। পর্দার মাধ্যমে খাঁচার পাখির মত বন্দি করে রাখা নয় বরং নারীর ইজ্জত ও সম্মান রক্ষার জন্য ইসলামের এ বিধান। মুসলিম সমাজে সভ্যতায় মেয়ে অপেক্ষা ছেলের দায়দায়িত্ব বেশি। নারী ও পুরুষ কার অধিকার বেশি? কার মর্যাদা বেশি? সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণ শেষে জবাব হবে- নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদা কোনো ক্ষেত্রে সমান আবার কোনো ক্ষেত্রে কমবেশি। ইসলাম ঢালাওভাবে সবাইকে সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়নি। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক’। (মুসলিম)। স্বামীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম’। (বুখারি)। মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ (তিরমিজি)।

ইসলাম নারীকে যে ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে পৃথিবীতে অন্য কোন ধর্ম আজও দিতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না ।

আফসোস! সমধিকারের স্লোগান তুলে নারীরাই আজ তাদের মান-জাত ক্ষুণ্ন করছে। ইসলামপূর্ব আরব যুগে নারীদের অধিকার-মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। সেকালে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়াকে অপমানজনক মনে করা হত । নিষ্পাপ-কোমলমতি শিশু কন্যা সন্তানদের জীবন্ত অবস্থায় মাটি চাপা দেয়া হত । নারীদেরকে দাস হিসেবে সকলে ব্যবহার করতো। নারীরা ছিল সকলের কাছে অবহেলার পাত্র।

নারীরা আজ রাজপথে নেমে এসেছে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। অধিকার কেন; ন্যায্য অধিকার এবং সর্বোচ্চ মর্যাদাই তো ইসলাম দিয়েছে তাদেরকে ।

নারী দিবস, মিছিল-মিটিং-সমাবেশ,বিবৃতি, মানববন্ধন ইত্যাদি ইত্যাদি করে কেন তারা অধিকার আদায় করবে? বৈধ প্রাপ্তি ও ন্যায্য অধিকার আজ থেকে প্রায় ১৫ শ’ বছর আগেই তো শান্তির ধর্ম ইসলাম দিয়েছে। ইসলামে দেয়া নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হোক এবারের নারী দিবসের অঙ্গিকার।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল