নবীন-প্রবীণ আলেমগণের চোখে মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১২ ২০২০, ২০:৪৫

আজন্ম রাজনীতিবিদ, বহু গুণের আধার, প্রাজ্ঞ আলেম মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

তাঁকে নিয়ে নবীন-প্রবীণ আলেমগণ নিজেদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই লেখাগুলো সংগ্রহ করে একুশে জার্নাল ডটকম -এর পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করেছেন জার্নালের নির্বাহী সম্পাদক ইলিয়াস সারোয়ার


একজন আবদুল লতীফ নেজামী

মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী

দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় একজন নির্ভীক ব্যক্তিত্ব, চড়াই-উৎরাইয়ে অবিচল, জ্ঞানে-গুণে ভরপুর, নিরহংকার সদাহাসির অনন্য ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুল লতীফ নেজামী ভাই আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। এভাবে সবাইকে চলে যেতে হবে। আল্লাহ্ প্রদত্ব যোগ্যতার বলে দেশ-জাতিকে কে কি দিয়ে গেলেন বা নিজের জন্যই কে কি নিয়ে গেলাম তাই বড় কথা। দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি কতটুকু সহযোগিতা করেছে এটা একটা বড় ব্যপার। জীবিতরা তার বিচার-বিশ্লেষণ করবে কিন্তু নিজের জন্য কি নিয়ে গেলাম, আমার কি হবে আজ তাই ভাবতে হচ্ছে নিজেকে। আমি বলব, নেজামী ভাই এতটুকু করেছেন— দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় রাজনীতিই ছিল তাঁর নেশা এবং পেশা। কোথায় ট্রান্সপোর্ট, কোথায় খাওয়া, পকেটের কি খবর, পুলিশ-জেল এসব নিয়ে তাঁর কোন ভাবনা ছিল না। যেন ভাবনার সময়ই ছিলনা। আজ তিনি চলে গেলেন। আর জিজ্ঞেস করতে পারবনা—- নেজামী ভাই! ঐ বিষয়টির তত্ব কি, তথ্য কি, ইতিহাস কি, সন তারিখ কি? উত্তর আসত মুখে না হয় প্রিন্টশর্টে। সেই ডকুমেন্টারি সহযোগিতা কি আর কোথাও পাওয়া যাবে? না, এটাই হওয়া স্বাভাবিক।

আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে মাগফিরাত করৃন, জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তাঁর পরিবার-পরিজন, বন্ধু মহল সকলের প্রতি রইল শোক ও সহমর্মিতা।


মাওলানা নেজামী ছিলেন শান্ত, সজ্জন, বিনয়ী ও পরোপকারী

আ ফ ম খালিদ হাসান

মাওলানা আবদুল লতিফ নিজামী সাহেবকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তিনি ছিলেন শান্ত, সজ্জন বিনয়ী ও পরোপকারী।


আল্লাহভীরু, মুখলিস, বিচক্ষণ দুরদর্শী আলেম মনিষী নেজামী

মুফতি ফয়জুল্লাহ

দেশের অন্যতম শীর্ষ আলেম দ্বীন, দীন-মিল্লাতের অতন্দ্রপ্রহরী, মাখদুমুল উলামা,আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন আবদুল লতিফ নেজামী সাহেব রহ, এর ইন্তেকালের খবরটি খুবই দুঃখ ও বেদনার। তাঁর মরহুম হয়ে যাওয়ার সংবাদে মনটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। স্মৃতির আয়নায় ভেসে উঠছে টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। আহ্ এত দ্রুত তাঁকে হারিয়ে ফেললাম।

মাওলানা নেজামী রহ. একজন হক্কানীআলেম এবং প্রচার বিমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালে দেশ একজন প্রতিথযশা মুরুব্বী হারাল। হযরতের ইন্তিকাল নিশ্চয় আলেম সমাজ ও দেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।

আমি মাওলানা নেজামী রহ’র বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্তসমূহ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। স্বরণ করছি,বহু ঈমানী আন্দোলনে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা।

প্রখ্যাত ও শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদ, ঈমানী সকল আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মাওলানা নেজামী সাহেব রহ. বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। আমি আমার জীবনে তাঁকে কোন দিন ভুলতে পারবো না। তাঁর চিন্তা ও প্রজ্ঞা অভিভূত হওয়ার মতো। তাঁর যুক্তিনির্ভর, গাম্ভীর্যপুর্ন উচ্চারন প্রতিবার অনুপ্রানিত হয়েছি, তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ দু’আ লাভ করেছি।তাঁর হাস্যোজ্জল মুখ ভুলতে পারবো না ।তাঁর পরম স্নেহ, মমতায় সিক্ত হয়েছি জীবনের বাকে বাকে। তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক আলেমে দীন।এদেশের এক পথনির্দেশক প্রাজ্ঞ আলেম। এ মুহূর্তে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অভিভাবকত্বের জায়গাটিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করার মতো আর কেও কি আছেন?

আমরা যা হারালাম তার সাথে কোন কিছুর তুলনা চলে না। আল্লাহভীরু, মুখলিস, বিচক্ষণ, সময়োপযোগী দুরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম , এই আলেম মনিষীর ইন্তেকালে আমি গভীর ভাবে শোকাহত। আমি তাঁর মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, আত্মীয়,স্বজন এবং সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমাবেদনা জানাচ্ছি।

দেশবরেন্য বিখ্যাত এই দরদী আলেম ও মুরুব্বীর জন্য আমরা মহান আল্লাহর শাহী দরবারে কায়মনোবাক্যে মুনাজাত করছি, আল্লাহ! আপনি আপনার এই প্রিয় মুখলিস, আলেম বান্দাহকে আপনার রহমতের চাদরে আবৃত করে চিরস্থায়ী জান্নাতের মেহমান করে নিন। আমীন।


নিরহংকার এক সজ্জন ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী

শরীফ মুহাম্মদ

একজন সহজ,সরল, সজ্জন মানুষ ছিলেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী। বিগত প্রায় ৮ বছর ধরে ইসলামী ঐক্যজোটের রাজনীতিতে সরব ছিলেন অমায়িক এমানুষটি। অনেক আগেই সত্তর পেরোনো এআলেম সাংবাদিককে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকে দেখে এসেছি। প্রাচুর্য ও ভাব ছিল না তাঁর মধ্যে। ফুটপাতের পাশে বসে দুই টাকা-পাঁচ টাকা দামের চা খেতে দেখেছি বহু। নিঃসঙ্গ পথচারির মতো ফুটপাত ধরে হাঁটতে দেখেছি। রাস্তায় চলতে গিয়ে পাঁচ টাকার বাদাম কিনে আয়েশ করে খেতে দেখেছি।

নব্বইয়ের দশকে দৈনিক শক্তি নামের একটি পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। নেজামে ইসলামের সঙ্গে সম্ভবত বহু আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন। প্রতিকূল মুহূর্ত এবং বেকায়দা সময়ে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন ও কথাবার্তার সময়েও হাসিমুখে উত্তর দিতে দেখেছি। খোঁচা দিয়ে কথা বলে দেখেছি, ঘরোয়া মানুষের মতো লাজুক ভঙ্গিতে কথার উত্তর দিয়েছেন।

তাঁর লেখার হাত সুন্দর ছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তার কোনো কোনো প্রবন্ধ পড়ে বুঝা যেতো, বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি, রাজনীতির ইসলামীকরণ, রাজনীতিতে বি- ইসলামীকরণ প্রকল্প, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চোরাবালি- এসব ব্যাপার তিনি ভালো বুঝতেন।

ময়দানের ইসলামী রাজনীতিক। পথচারী ও পদচারী রাজনীতিক। আলাপি ও নির্বিরোধ মানুষ। কর্মপন্থা ও সিদ্ধান্তে হয়তো কিছু ভুল ত্রুটি ছিল, কিন্তু একজন সদালাপী ভদ্র সজ্জন মানুষ ছিলেন। সারল্যের কারণেই তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে।

আজ মাগরিবের পর ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করুন।


খুবই সাদাসিধে মানুষ ছিলেন মাওলানা নেজামী

রুহুল আমিন সাদী

মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের সাথে কথা বলে কনফার্ম হলাম, মাওলানা আবদুল লতীফ নিজামী সাহেব কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল করেছেন।

ইফতারের আগে হঠাৎ করে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।এবং সেখানেই কিছুক্ষণ আগে ইন্তেকাল করেন।

সর্বশেষ চব্বিশে মার্চ নিজামী সাহেবের সাথে নোয়াখালী টাওয়ারের সামনে বসে চা খেয়েছিলাম। সাথে আবদুল গাফফার ভাই এবং ইনকিলাবের সাংবাদিক শামসুল ইসলাম ভাই ছিলেন।

চা খেয়ে বিলটাও উনিই দিলেন। আমাদেরকে দিতে দেননি।

বয়সের কত পার্থক্য অথচ কত অবলীলায় বসে আছেন, গল্প করছেন আমাদের সাথে! এমনই একজন মানুষ ছিলেন মাওলানা আবদুল লতীফ নিজামী।

আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন মাওলানা নিজামীকে।


স্রোতের বিপরীতে কিছু কথা: আমারে কেউ গালি দিয়েন না

সৈয়দ শামছুল হুদা

গতকালের কিছু কষ্টের কথা এখানে শেয়ার করতে চাই। হয়তো এ কথাগুলো অনেকেরই ভালো লাগবে না। পছন্দ হবে না। কারণ কথাগুলো হয়ে যাবে স্রোতের বিপরীত। আমরা সবসময় স্রোতের তালে তালে কথা বলে অভ্যস্ত।

আমি খুব গভীর মনযোগ দিয়ে গত দু’দিনের অনেক স্টেটাস পড়েছি। আমি লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের আচরণ কত বিপরীতমুখি। আজ মরহুম আব্দুল লতিফ নেজামী সাহেব এর গুণকীর্তন প্রকাশ করে অনেক লেখা উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই মুহুর্তে নেজামী সাহেব আমাদের মাঝে নেই। উনাকে নিয়ে আজকে যা লেখা হচ্ছে তা থেকে বাছাই করে মাত্র দুটি লাইন লিখে গতকাল দুপুরেও যদি কেউ এভাবে স্টেটাস দিতো, আর এভাবে বলতো যে,
“আব্দুল লতিফ নেজামী একজন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, তিনি একজন অভিজ্ঞ মানুষ। উনার মতো সৎ ও নির্লোভ মানুষ বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না।”

তাহলে তাৎক্ষণিক যে স্টেটাস দিতো তাকে এই সোস্যাল মিডিয়ার সৈনিকেরা আধা পাগল বানিয়ে ফেলতো। আমাদের অভ্যাস হলো কোন জীবন্ত মানুষের প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত নই। একশ একটা কারণ বের করতো আবদুল লতিফ নেজামী সাহেব কতটা খারাপ মানুষ তা প্রমাণ করার জন্য। যে তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেও কিছু বলার চেষ্টা করতো। এটাই আমাদের বর্তমানে আচরিত বাস্তব চরিত্র।

আমরা কোন মানুষকেই গালি দিতে ভুল করি না। আমাদের সমাজে কারো প্রশংসা করা যেন এক ধরণের মহা অপরাধ। এক সময় নাস্তিকরা ডানপন্থীদের সাথে তর্কে না পারলে গালির অস্ত্র ব্যবহার করতো। এখন আমরা সেই অস্ত্র ব্যবহার করি। খুব ভালোভাবেই ব্যবহার করা শিখেছি। মানুষ মাত্রই ভুল থাকা স্বাভাবিক। ভালো গুণের পাশাপাশি দোষ থাকা, ভুল থাকা, সিদ্ধান্তে কোন ভুল করা এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত আমরা একটা ভুলের জন্য হাজারটা ভালো কাজকেও অস্বীকার করতে সামান্য দেরি করি না।

আজকে যারা আলেম হিসেবে পরিচিত, যারা ভালো ভালো মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেছে এমন অনেক লোককেও দেখি এসব ট্রলবাজিকে সামান্য ডালভাত মনে করে। এতে একটা মানুষ কষ্ট পায় কী না তা সামান্য চিন্তা করে না। আজ নেজামী সাহেব নেই তাঁর গুণকীর্তনের ঢল উপচে পড়ছে।


ইসলামী রাজনীতির উৎসর্গ প্রাণ মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী

মুফতী খন্দকার মুজাম্মিল হক

তিনি ছিলেন মুরুব্বি আলেমদের সোহবত ধন্য ও রাজপথের ধুলি কনা মাখা নিরলস আত্মত্যাগী একজন সহজ সরল ইসলামের কান্ডারী। আজীবন তিনি ইসলামের পতাকা ধরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দল ও মঞ্চে। সাড়া দিয়েছেন ছোট বড় সকলের আহ্বানে। অতঃপর স্বীকৃতি পেয়েছেন বর্ষীয়ান আলেম ও রাজনীতিবিদ হিসেবে মহা সম্মাননা। ছিলনা অহংকার কিংবা আমিত্ব ব্যাক্তিত্বের আস্ফালন।ফুটপাতে হেঁটে চলতেন সাধারণ মানুষ হিসেবে। শুধু কি তাই বহুবার দেখেছি বাইতুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে পড়নের কাপড় কিনেছেন নিজের জন্য। ছিলনা বিলাসিতা নামক কোন আত্মব্মরিতা।আকাবের আসলাফের অশ্রুসিক্ত প্রাণের সংগঠন নেজামে ইসলাম পার্টির ঝান্ডা উত্তোলন করতে করতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তবু মুরুব্বিদের নাম হাতছাড়া করেননি। গণভবন কিংবা বঙ্গভবন, শেখ হাসিনা কিংবা বেগম খালেদা জিয়া ,শাইখুল হাদিস ও মুফতি আমিনী সকলের সাথেই ছিল রাজনৈতিক দল ও জোট বদ্ধ পথচলা,বৈঠক , সমাবেশ, আলোচনা সভায় দেশ ও ইসলাম নিয়ে ভাবনা। এককথায় বলা যায় দেশের উন্নয়ন ও ইসলামী শাসনের জন্য আজীবন লড়াকু সৈনিক। ইসলামী রাজনীতির জন্য জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন বহুবার তবু ছিটকে পড়েননি এ পথ থেকে।ছাত্র জীবনেই মুরুব্বি আলেমদের হাতে শপথ দীপ্ত জনাব নেজামী জালিমের কারাগার ও অত্যাচারে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন না কখনো।সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলা ও বিনয়ী আচরণের জন্য তিনি ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকবে অনেক দিন। তার সাথে উঠা বসায় আমরা নবীন হয়ে ও প্রবীণের মতো পেয়েছি মূল্যায়ন। তিনি ছিলেন নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, একজন বিদগ্ধ লেখক ও গবেষক। তিনি ইংরেজি দৈনিক #পিপলস্ এ সাব এডিটর হিসেবে কাজ করছেন, দৈনিক #সরকার পত্রিকার সম্পাদক। জাতীয় লেখক পরিষদের একজন সম্মানিত অভিভাবক। তার মৃত্যুতে আমি ও আমরা সীমাহীন শোকাহত।দেশ ও জাতি হারালো একজন মুসলিম মনীষী এবং দেশের উন্নয়নে আত্ম উৎসর্গকারী প্রবীণ রাজনীতিবিদ। আল্লাহ তায়ালা তার সকল গোনাহ মাফ করে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। #ইসলামী #কালচারাল #মুভমেন্ট ও #জাতীয় #লেখক #পরিষদের পক্ষ থেকে তার জন্য গভীর শোক প্রকাশ ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং তার মাগফিরাত কামনা করছি।


চলে গেলেন মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামি

এহসানুল হক

পৃথিবী থেকে এক সময় সবাইকেই চলে যেতে হবে। তবুও কিছু মৃত্যু আকস্মিক। যা হতবিহ্বল করে দেয় সবাইকে। মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামির মৃত্যু তেমনি অপ্রত্যাশিত। তিনি সিনিয়র রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ ছিলেন না। তিনি অসুস্থ এমন খবরও শুনিনি। সদাতৎপর কর্মউদ্দমী সক্রিয় এই মানুষটা এভাবে চলে যাবে কেউ কল্পনাও করেনি। আজ সন্ধ্যায় যখন শুনলাম তিনি আর নেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে।

মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামি ইসলামি রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন পাকিস্তান আমল থেকে। হাফেজ্জি হুজুরের ছায়ায় খেলাফত আন্দোলন করেছেন। শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ইসলামি ঐক্যজোটের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। আর মুফতি আমিনীর ছিলেন মহাসচিব। সর্বশেষ তিনি ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পরিচয়গুলো সবার জানা।

কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, ইসলামি রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। এক সময় সাংবাদিকতা করেছেন। ইংরেজি দৈনিক পিপলসে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া সাপ্তাহিক বাংলার মুখ, দৈনিক শক্তিসহ বেশ ক’টি পত্রিকায় তিনি সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে রাজনীতি সক্রিয় হলে সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন।

আব্দুল লতিফ নেজামি সাহেব শাইখুল হাদীস রহ. এর স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি সব সময়ই বলতেন-আমার নাম নেজামি রেখেছেন শাইখুল হাদীস রহ.। একবার শাইখুল হাদীস সাহেবসহ একটা মিটিং এ আমরা বসেছি। সেখানে আব্দুল লতিফ নামে বেশ কয়েকজন ছিলেন। ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের একজন আব্দুল লতিফ চৌধুরি। কৃষক শ্রমিক পার্টির ছিলেন আব্দুল লতিফ মজুমদার। আরেকজন ছিলেন জমিয়তুল মুদাররিসিনের আব্দুল লতিফ নামে। এরপর আব্দুল লতিফ হাওলাদার নামে আরেকজন ছিল। তাই শাইখুল হাদীস সাহেব আমার নামের শেষে নেজামি লাগিয়ে দেন। আমি যেহেতু নেজামে ইসলাম পার্টি করতাম তাই নেজামি নামটা দিয়ে ছিলেন। হুজুর এই নামে আমাকে ডাকা শুরু করলেন। তারপর থেকে আমি এই নামে পরিচিত হতে শুরু করি।

শাইখুল হাদীস রহ. এর জীবনি সংকলনের কাজে আমি মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামি সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কাছ থেকে দেখেছি শাইখুল হাদীস রহ. এর প্রতি তার মুগ্ধতা ও ভালোবাসা। আমি প্রায় পঞ্চাশজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। শাইখুল হাদীস রহ. এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে কয়জনের চোখ আমি অশ্রুসজল দেখেছি তার মধ্যে একজন হলেন মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামি। শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে তার কারাবরণের সেই গল্প সম্ভব হলে আগামীকাল শুনাবো। বরেণ্যদের চোখে শাইখুল হাদীস নামক প্রকাশিতব্য গ্রন্থে সবগুলো সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামির শেষ সময়ের রাজনীতি নিয়ে যত প্রশ্ন- এক্ষেত্রে আমি মনে করি ব্যক্তি নেজামি সাহেবের চেয়ে তার দলের ভুমিকা বেশি। ভালো মন্দ যেটাই হোক তার কৃতিত্ব বা ব্যর্থতা তার দলের। তিনি দলের প্রধান থাকলেও তার হাতে কতটুকু ক্ষমতা ছিল তা কারো অজানা নয়। সুবিধাভোগের রাজনীতি করতে চাইলে অনেক বিত্তবৈভবের মালিক তিনি হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সারা জীবন সৎ রাজনীতি করলেও শেষ সময়ে তার দলের প্রশ্নবিদ্ধ ভুমিকা থেকে তিনি কেনো বের হয়ে আসতে পারলেন না সেই প্রশ্নের উত্তর অজানাই থাকলো। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি তার ত্রিশবছরের সচ্ছ সৎ রাজনৈতিক ভুমিকার বিচারেই মূল্যায়িত হবেন এই কামনা করি। আল্লাহ পাক তার সমস্ত ভুলত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করেন এই দোয়া করি।


একজন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও কর্মবীর রাজনীতিক

আব্দুল্লাহ আল আমিন

বড় কাটারা লালবাগ পড়ার সুবাদে ঘন ঘনই মিছিল সমাবেশে যাওয়ার সুযোগ হতো। সভা সমাবেশে অামিনী সাহেবের পাশেই অাসন পেতেন মাওলানা অাব্দুল লতিফ নেজামী। মাথায় থাকতো কালো রংয়ের একটি টুপি। পরনে সাদামাটা এক পাঞ্জাবি। প্রথম প্রথম তাকে নন অালেম মনে হতো।

সাধারণত তার বক্তৃতার পালা অাসতো অামিনী সাহেবের অাগে। তিনি খুব শান্ত কণ্ঠে বক্তৃতা করতেন। ফলে উজ্জীবিত শ্রোতারা মনোযোগ দিত না। বিরক্তি নিয়ে ফিসফিস করতো, শেষ করে না কেন? অামিনী সাহেবকে দেয়া হোক! অথচ গভীর শ্রোতা যারা তারাই বুঝতেন তার বক্তৃতার মর্ম। ধীরগতিতে গণতান্ত্রিক ধারায় সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের কথা বলে যেতেন।

অাব্দুল লতিফ নেজামী একজন প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক ছিলেন। তার লেখা পড়ে এবং ব্যাক্তিগতভাবে কথা বলে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। সরকারের ভিত কাঁপানো ব্যক্তিত্ব মুফতী ফজলুল হক অামিনী রহ. নিয়মিত তার পরামর্শ নিতেন। অামিনী সাহেবের মতো সময়ের মূল্যায়নকারী ব্যক্তি প্রায়ই তাকে লালবাগে ডেকে এনে নিবিড়ভাবে রাজনৈতিক অালাপ করতেন। খেদমতের তাগিদে অামিনী সাহেবের কক্ষে ক্ষণে ক্ষণে যাওয়া লাগতো। যেই না অামি দরজা ধাক্কা দিতাম অমনি নেজামী সাহেব কথা বন্ধ করে দিতেন। এই ঘটনা দেখার পর থেকে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ চরিত্রটিও ধরা পড়ে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কাটানোর পরও অার্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। লালবাগ থেকে যাওয়ার সময় দেখতাম, অামিনী সাহেব তার হাতে দুশো টাকা গুঁজে দিচ্ছেন।

তার লেখার হাতও ছিলো বেশ পাকা। দৈনিক সরকার নামে নিবন্ধিত একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মাসিক নতুন ডাকে কাজ করাকালীন তার সাথে পত্রিকাকেন্দ্রিক যোগাযোগ ছিল। বেশ স্নেহ করতেন। লেখাও দিয়েছেন অামাদের নতুন ডাকে।

শুনেছি, জোট ছাড়ার প্রশ্নে তিনি ‘না’ এর উপর অনড় ছিলেন। সর্বশেষ তাকে রাজি করানো হয়েছে এবং বহু কষ্টে তাকে রাজি করানো গেছে। মহিমান্বিত মাসে তার মৃত্যু ভালো কিছুর বার্তা দেয়। অাল্লাহ কর্মবীর এই মানুষটিকে জান্নাতের অা’লা মাকাম দান করুন।