দুবাই বসে ঢাকার অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণকারী কে এই জিসান?
একুশে জার্নাল
সেপ্টেম্বর ২৯ ২০১৯, ১৪:৪৬
আবির আবরার: রাজধানীতে ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, জবর-দখলসহ নানা অপরাধের হোতা যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এবং জি কে শামীম। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ছায়ায় একপর্যায়ে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। একপর্যায়ে অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব হয় দুবাইয়ে অবস্থানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে। এরই একপর্যায়ে খালেদ-শামীমকে শেষ করে দিতে দুবাই থেকে ঢাকায় একে-২২ এর একটি চালান পাঠান জিসান। গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ঢাকার অপরাধ জগতের ভাড়াটে কিলার, চাঁদাবাজসহ অপরাধীদের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এবং জি কে শামীমের। টাকার ভাগবাটোয়ারা এবং অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র করে দুবাইয়ে অবস্থানকারী শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তারা। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে কয়েক মাস আগে দুবাইতে জিসানের সঙ্গে খালেদ ও শামীমের বৈঠক হয়। তবে বৈঠকে কোনো সমঝোতা হয়নি। পরে খালেদ ও শামীমকে হত্যা করতে পরিকল্পনা করে জিসান। মিশন বাস্তবায়ন করতে একে-২২ এর একটি অস্ত্রের চালানও ঢাকায় পাঠায় জিসান। যা ২৬ জুলাই রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি বাসা থেকে একে-২২ এবং গুলিসহ জিসানের দুই সহযোগী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। । পরে তারা ডিবির কাছে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জিসানের সাপোর্ট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার, চাঁদা এবং ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন শামীম। এরই মধ্যে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এরপর জিসানকে বাদ দিয়ে সম্রাট ও খালেদের সহায়তায় ঠিকাদারি ব্যবসা করেন শামীম। এ নিয়ে জিসান এই সিন্ডিকেটের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। খবর পেয়ে জিসানের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখেন শামীম। কোনো ইস্যুতে সম্প্রতি খালেদের সঙ্গেও জিসানের সম্পর্কের অবনতি হয়।
একাধিক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মতিঝিল পল্টন এলাকার ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনোতে জুয়াড়িদের পাশাপাশি অপরাধ জগতের লোকজনের আনাগোনাও ছিল। সেখানে পেশাদার কিলার, সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খুনের পরিকল্পনাও হতো সেখানে। এরই অংশ হিসেবে জিসান, সম্রাট, খালেদ, জি কে শামীমের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়।
কে এই জিসান?
রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শীর্ষসন্ত্রাসী জিসান ওরফে মন্টি এখন ফের আলোচনায়। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া এবং যুবলীগ নেতা জিকে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর আলোচনা হচ্ছে জিসানকে নিয়েও। দীর্ঘদিন ধরে দুবাই অবস্থানরত এ শীর্ষসন্ত্রাসী সেখানে বসেই ঢাকার অপরাধ জগতের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
এ ক্ষেত্রে দুবাইয়ে অবস্থানের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন জিসান। নাম-ধাম এমনকি দেশ পর্যন্ত পাল্টে ফেলায় দুবাইয়ে আইনি ঝঞ্ঝাটমুক্ত জীবন কাটছে তার। আর সেখান থেকেই চলছে ঢাকায় তার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ। তার বিষয়ে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন জিকে শামীম ও খালেদ মাহমুদ। ঢাকার অপরাধ জগৎ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মাধ্যমে জিসানের ১০ বছর মেয়াদি ভারতীয় পাসপোর্টের একটি কপি মিডিয়ার হাতে এসেছে।
পাসপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে আলী আকবর চৌধুরী। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঠিকানা দেখানো হয়েছে সারদা পল্লী, ঘানাইলা, মালুগ্রাম শিলচর, চাষার, আসাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী। মায়ের নাম শাফিতুন্নেছা চৌধুরী। আর স্ত্রীর নামের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে রিনাজ বেগম চৌধুরী। পাসপোর্ট ইস্যুর স্থান দুবাই হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৭ জুন প্রদান করা পাসপোর্টটির মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২০১৯ সালের ৬ জুন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের খবর, চলতি বছরের ৬ জুন পাসপোর্টটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর ফের ভারতীয় পাসপোর্টটি ১০ বছর মেয়াদের নবায়ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাইয়ে শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের দুটি রেস্টুরেন্ট আছে; আছে গাড়ির ব্যবসাও। এসব দেখভাল করেন তার ছোট ভাই শামীম এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাকিল মাজহার। এর মধ্যে শাকিল মাজহার যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সহসম্পাদক রাজিব হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে দুবাই চলে যান তিনি।
এদিকে শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর যুবলীগ নেতা জিকে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানকে ঘিরে ঢাকার অপরাধ জগতের চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।
সূত্র জানায়, জিকে শামীমকে ঘিরে ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে জিসানের বিরোধ তৈরি হয়। এ সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বিরোধের একপর্যায়ে জিসান খুবই ক্ষুব্ধ হন তাদের ওপর। অবস্থা ভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় জিসানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করেন খালেদ। গত জুনের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরে যান জিকে শামীম, মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতা ও খালেদ। আর জিসান দুবাই থেকে সেখানে যান। সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। যদিও বৈঠকে শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে কিলিং মিশনে অংশ নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় জিসানের সহযোগীদের।
র্যাবের হাতের ৭ জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার হন জিকে শামীম। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, আগে কখনো এত দেহরক্ষী রাখেননি তিনি। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে ‘ভয়ে’ বড় নিরাপত্তা টিম গঠন করেন জিকে শামীম।
সরকারের পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষসন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম জিসান। এ তালিকার অন্যরা, যারা এক সময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপাত, তাদের কেউ এখন বিদেশে, কেউবা কারাগারে।