তারাবীহ’র রাকাত সংখ্যা: একটি দালিলিক পর্যালোচনা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ০৩ ২০২২, ১২:১৯

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ:  রমজান মাসের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল তারাবীহ। তবে রোযার মতো উম্মতের উপর তারাবীহ’র নামাজ ফরয করা হয়নি।

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يرغب في قيام رمضان من غير أن يامرهم فيه بعزيمة: من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه.(مسلم شریف )

হযরত আবু হুরায়রা (রা.)বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা:) তারাবীহ নামাযকে আমাদের জন্য অপরিহার্য করেননি,তবে তিনি উৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রমযানের রাতে (নামাযে) দাঁড়ায় তার পূর্বকৃত গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (সহীহ মুসলিম :হাদীস,৭৫৯ )

তারাবীহ শরয়ী হুকুম:

২০ রাকা’আত তারাবীহ নামায পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।তবে পুরুষের জন্য তারাবীহর জামা’আত করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। মেয়েরা জামা’আত ছাড়াই নিজেরা পড়ে নিবে । ( ফাতাওয়া শামী ২/৪৫ , আহসানুল ফাতাওয়া ৩/৫২৪-৫২৫)

তারাবীহ রাকা’আত সংখ্যা:

তারাবীহ নামাজ বিশ রাকা’আত,আট রাকা’আত নয়। কেননা বিশ রাকা’আত তারাবীহর ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত,মহাজির এবং আনসারী সাহাবীগণের ইজমা,মারফু হুকমী সুন্নতে মুতাওয়ারাসা ও ফুকাহায়ে কেরামগণের ঐকমত্য বিদ্যমান। রাসুলুল্লাহ(সা:)নিজে বিশ রাকা’আত তারাবীহ’র নামাজ পড়েছেন,তা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সে বিষয়ে দলীল ভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ ।

সহীহ বুখারী কিতাবু-সালাতিত তারাবীহ এবং অন্যান্য হাদীসের কিতাবে এ বিষয়টি সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, রাসুলল্লাহ (সা:) কখনো কখনো তারাবীহ নামাজ জামা’আতে পড়িয়েছেন । আবার কখনো এমন হয়েছে যে কয়েক রাকা’আত জামাতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে গেছেন এবং একাকী নামায রত থেকেছেন । রাসুলুল্লাহ(সা:) তারাবীহ নিয়মিত জামাআতে পড়াননি, বরং অধিকাংশ সময়ই একাকী পড়তেন ।

রাসুলুল্লাহ (সা:) তিনি নিজে কেন জামাআতের সাথে নিয়মিত করেননি,তা উম্মতকে বলে গেছেন যে,যেহেতু উম্মতের মধ্যে তার উপস্থিতির সময়টি ওহী অবতীর্ণ হওয়া এবং শরীয়তের বিধানসমূহ বিধিবদ্ধ হওয়ার সময় ছিল,তাই জামা’আতের সাথে নিয়মিত নামাজ পড়লে তারাবীহ নামাযটিও উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল ।(তালখীসুল হাবীর ১/১১৯, লামে’উদদারারী শরহে বুখারী ১৫৫-১৫৬ পৃ:)

রাসুলুল্লাহ (সা:) এর যুগে এবং রাসুলের পরে খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)এর খেলাফত কালে ও উমর (রা) এর খেলাফত কালের শুরুতে এই অবস্থাই ছিল । অর্থাৎ এক ইমামের পেছনে ফরয নামাযের মত তারাবীর নামাজ জামাআতের সাথে আদায় করার ইহতেমাম ছিলনা । (বুখারী হাদীস নম্বর ২০০৯) পরবর্তীতে রমযানের কোন একরাতে হযরত উমর(রা) মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং সেখানে দেখতে পান যে,মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামা’আত হচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন সকল নামাযীকে একজন ইমামের পেছনে একত্র করে দেওয়া উচিত। তখন তিনি এই আদেশ জারি করেন এবং উবাই ইবনে কা’ব (রা:) কে ইমাম বানিয়ে দেন।

তারাবীহ বিশ রাকাআত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত দ্বারা প্রমাণিত :

হযরত ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা (রহ:) বলেন,হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযীদ (রা:) বলেছেন,তারা সাহাবা ও তাবেয়ীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) এর যুগে রমজান মাসে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়তেন । তিনি আরো বলেছেন যে, তারা নামাযে শতাধিক আয়াত বিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তেন । এবং উসমান (রা:) এর যুগে দীর্ঘ নামাযের কারণে তাদের কেউ কেউ লাঠিসমূহে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন ।

كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب رضي الله عنه في شهر رمضان بعشرين ركعة قال وكانوا يقرؤون بالمئين وكانوا يتوكؤن على عصيهم في عهد عثمان بن عفان رضي الله عنه من شدة القيام (আসসুনালুল কুবরা, বায়হাকি ২/৪৯৬ )

সাহাবী সায়েব ইবনে ইয়াযীদ(রা:)এর আরেক বর্ণনা, كنا نقوم في زمن عمر بن الخطاب رضي الله عنه بعشرين ركعة والوتر(আসসুনালুল কুবরা,বায়হাকি ১/২৬৭-২৬৮(মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার,বায়হাকি ২/৩০৫ )

বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আব্দুর রহমান আসসুলামী (রহ:) এর বিবরণ:

عن على دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة وكان علي رضي الله عنه يوتر بهم

হযরত আলী (রা)রমযানে কারীগণকে ডাকেন এবং তাদের একজনকে আদেশ করেন,তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়েন এবং আলী( রা:) তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়তেন । (আসসুনালুল কুবরা বায়হাকি, ২/৪৯৬-৪৯৭)

বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান(রহ:)এর বিবরণ, كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب رضي الله عنه في رمضان بثلاث وعشرين ركعة (মুয়াত্তা মালেক ৪০ আসসুনালুল কুবরা বায়হাকি, ২/৪৯৬)

বিশিষ্ট তাবেয়ী আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই (রহ:) এর বিবরণ كان أبي بن كعب يصلي بالناس في رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاث

হযরত উবাই ইবনে কাব (রা:) রমযান মাসে মদীনায় লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতর পড়তেন । (মুসান্নফে ইবনে আবি শাইবা ২/২৮৫ )

বিখ্যাত তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহা মক্কী (রাহ:) বলেন, أدركت الناس وهم يصلون ثلاثا وعشرين ركعة بالوتر

আমি লোকদেরকে(প্রথম সারির সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনকে)দেখেছি তারা বিতর সহ তেইশ রাকাআত পড়তেন।(মুসান্নফে আবি শাইবা ২/২৮৫)

আর আতা ইবনে আবী রাবাহা বলেছেন, আমি তো দুইশ সাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছি । (তাহযীবুল কামাল ১৩/৪৯ )

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন,

انه قد ثبت أن ابي ابن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث فراي كثير من العلماء أن زلك هو السنة لأنه أقامه بين المهاجرين والأنصار ولم ينكره منكر

এটা প্রমাণিত যে,উবাই ইবনে কা’ব (রা:) রমযানের তারাবীতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকা’আত পড়তেন এবং তিন রাকা’আত বিতির পড়তেন। তাই অনেক আলেম এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে এটিই সুন্নত । কেননা উবাই ইবনে কা’ব (রা:) মহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের উপস্থিতিতে বিশ রাকা’আত পড়িয়েছেন,এবং কোন একজনও তাতে আপত্তি করেননি । (মাজমাউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩)

তিনি আরো বলেন,ثبت من سنة خلفاء الراشدين وعمل المسلمين

খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত ও মুসলিমজাতির সম্মিলিত কর্ম দ্বারা এটি প্রমাণিত ।(মাজমাউল ফতোয়া ২৩/১১২-১১৩)

তাবেয়ী আবুল আলিয়া হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. এর উদ্ধৃতি বর্ণনা করেন,

ان عمر رضي الله عنه أبيا أن يصلي بالناس في رمضان فقال إن الناس يصومون النهار ولا يحسنون أن يقرأووا فلو قرأت القرآن عليهم بالليل فقال يا أمير المؤمنين هذا شيء لم يكن فقال قد علمت ولكنه حسن فصلي بهم عشرين ركعة

হযরত উমর (রা:) উবাই ইবনে কা’ব (রা:) কে রমজান মাসে লোকদের নিয়ে নামায পড়ার আদেশ করতে গিয়ে বলেন, লোকেরা দিনে রোযা রাখে কিন্তু রাতের বেলা উত্তম রূপে কুরআন পড়তে পারেনা । আপনি যদি রাতে তাদের সামনে কুরআন পড়তেন। উবাই ইবনে কা’ব (রা:) উত্তরে বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন, এ বিষয়টি তো আগে ছিলনা ? উত্তরে তিনি বলেন,তা আমি জানি কিন্তু এটা ভালো।এরপর হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা:) তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকা’আত তারাবীহ নামাজ পড়েন ।(কানযুল উম্মাল ৮/৪০৮)

জামাতবদ্ধ বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ প্রসঙ্গে,ইমাম আবু ইউসুফ(রাহ:) কর্তৃক প্রশ্নের উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (রাহ:) বলেন,তারাবীহ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ।

জামাতবদ্ধভাবে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ পড়ার যে নিয়ম হযরত উমর(রা:) চালু করে গেছেন,তা তিনি নিজে থেকে করেননি, বরং তিনি দলীল এবং রাসূলের স. প্রাপ্ত কোনো নির্দেশনার ভিত্তিতে গ্রহণ করেছেন । সুতারাং তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাআত বিদাত বলার কোনো সুযোগ নেই।

যদিও রাসুলের জামানায় জামাতবদ্ধভাবে তারাবীহ নামাজ দুই তিন দিন ব্যতীত আর কখনো পড়া হয়নি । কেন পড়া হয়নি তার কারণ স্বয়ং রাসুল স. নিজেই বলে গেছেন । অর্থাৎ তারাবীহ নামাজ উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসুল(সা:) দুই/তিন দিন ব্যতীত মসজিদে জামাতবদ্ধভাবে বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করাননি।কেননা তখন ওহী নাযিলের সময় ছিল।

وفي البحرالرائق سأل ابو يوسف أبا حنيفة رحمه الله تعالى. وما فعله عمر رضي الله عنه فقال التراويح سنة مؤكدة ولم يخرجه عمر رضي الله عنه من تلقاء نفسه ولم يكن فيه مبتدعا.

وفي التاتارخانيه. سأل أبو يوسف أبا حنيفة رحمه الله تعالى.هل كان لعمر رضي الله عنه عهد من النبي صلى الله عليه وسلم في عشرين ركعة؟ فقال له أبو حنيفة رحمه الله تعالى لم يكن عمر رضي الله عنه مبتدعا وبقي الوتر ثلاث ركعات كما كان ثم إن أئمة المذاهب الأربعة قلدوه على كون التراويح عشرين ركعة ومن ذاد عليها جعلها نفلا مطلقا وحالا انفراديا يصليها الرجل لنفسه أما العشرون فواضعو لها الجماعة(فيض الباري باب قيام النبي صلى الله عليه وسلم في رمضان وغيره ٥٦٧/٢)

ইমাম তিরমিযী (রাহ:) বলেন, তারাবীহ নামাজ নিয়ে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ হলেও অধিকাংশ আহলে ইলমরা হযরত উমর ও হযরত আলী (রা:)সহ প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত আমল তথা বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজের রিওয়ায়াত গ্রহণ করেছেন।এটা ইমাম সুফিয়ান ছাওরী,ইবনুল মোবারক ও ইমাম শাফী (রাহ:) এরও মত ।

অর্থাৎ তাদের মতেও তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাআত। শুধু তাদের মতই নয়,বরং তা মক্কাবাসীদের আমলও বটে। ইমাম শাফী (রাহ:) বলেন,আমি মক্কায় লোকদের বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করতে দেখেছি। তাছাড়া আনসার ও মহাজির সাহাবীগণ বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ পড়তেন ।

হযরত উমর(রা:) খেলাফতকালে তাঁরই নির্দেশে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এর ইমামতিতে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ আদায় করা হয়েছিল।

এসময় উপস্থিত ছিলেন হযরত আলী (রা:) ও হযরত উসমান,আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ,ইবনে আব্বাসসহ বড় বড় আনসার ও মহাজির সাহাবায়ে কেরাম (রা:)।তাদের কেউ এর বিরোধিতা করেননি । যার ফলে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ আদায়ের উপর সাহাবায়ে কেরামের ঐক্য হয়ে যায়।

وفي البحرالرائق سأل ابو يوسف أبا حنيفة رحمه الله تعالى. وما فعله عمر رضي الله عنه فقال التراويح سنة مؤكدة ولم يخرجه عمر رضي الله عنه من تلقاء نفسه ولم يكن فيه مبتدعا.

وفي التاتارخانيه. سأل أبو يوسف أبا حنيفة رحمه الله تعالى.هل كان لعمر رضي الله عنه عهد من النبي صلى الله عليه وسلم في عشرين ركعة؟ فقال له أبو حنيفة رحمه الله تعالى لم يكن عمر رضي الله عنه مبتدعا وبقي الوتر ثلاث ركعات كما كان ثم إن أئمة المذاهب الأربعة قلدوه على كون التراويح عشرين ركعة ومن ذاد عليها جعلها نفلا مطلقا وحالا انفراديا يصليها الرجل لنفسه أما العشرون فواضعو لها الجماعة(فيض الباري باب قيام النبي صلى الله عليه وسلم في رمضان وغيره ٥٦٧/٢)

ইমাম তিরমিযী (রাহ:) বলেন, তারাবীহ নামাজ নিয়ে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ হলেও অধিকাংশ আহলে ইলমরা হযরত উমর ও হযরত আলী (রা:)সহ প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত আমল তথা বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজের রিওয়ায়াত গ্রহণ করেছেন।এটা ইমাম সুফিয়ান ছাওরী,ইবনুল মোবারক ও ইমাম শাফী (রাহ:) এরও মত ।

অর্থাৎ তাদের মতেও তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাআত। শুধু তাদের মতই নয়,বরং তা মক্কাবাসীদের আমলও বটে। ইমাম শাফী (রাহ:) বলেন,আমি মক্কায় লোকদের বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করতে দেখেছি। তাছাড়া আনসার ও মহাজির সাহাবীগণ বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ পড়তেন ।

হযরত উমর (রা:) খেলাফতকালে তাঁরই নির্দেশে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এর ইমামতিতে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ আদায় করা হয়েছিল।

এসময় উপস্থিত ছিলেন হযরত আলী (রা:) ও হযরত উসমান,আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ,ইবনে আব্বাসসহ বড় বড় আনসার ও মহাজির সাহাবায়ে কেরাম (রা:)।তাদের কেউ এর বিরোধিতা করেননি । যার ফলে বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ আদায়ের উপর সাহাবায়ে কেরামের ঐক্য হয়ে যায়।

قال الترمذي اختلف أهل العلم في قيام رمضان فراي بعضهم أن يصلي إحدى وأربعين ركعة مع الوتر. وهو قول أهل المدينة.

وأكثر أهل العلم على ما روي عن على وعمر وغيرهما من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم عشرين ركعة وهو قول سفيان الثوري وابن المبارك والشافعي •

وقال الشافعي هكذا أدركت ببلدنا بمكة يصلون عشرين ركعة •

 

وقال أحمد روي في هذا ألوان لم نقض فيه بشيء .

وقال إسحاق بل نختار وأربعين ركعة على ما روي عن أبي ابن كعب.وتبين من هذا ما كان في الحرمين الشريفين وما كان مذهب السلف الصالحين فليصل المدعون بالعمل

بالحديث ثمانية أو دونها. فإن أكثر الصحابة لم يصلوا إلا عشرين ركعة. الخ. فيض الباري ٣٧٥/٣—نعم اتفقوا على ثبوتها عشرين ركعة عن عمر رضي الله عنه•

প্রিয় নবীজি (সা:) বিশ রাকাআত তারাবীহ নামাজ পড়েছেন,এব্যাপারে রঈসুল মুফাসসীরিন হযরত ইবনে আব্বাস (রা)থেকে বর্ণিত রিওয়ায়াতটি নিম্নরূপ,

ﺣﺪﺛﻨﺎ ﻳﺰﻳﺪ ﺑﻦ ﻫﺮﻭﻥ ﻗﺎﻝ ﺍﻧﺎ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﺑﻦ ﻋﺜﻤﺎﻥ ﻋﻦ ﺍﻟﺤﻜﻢ ﻋﻦ ﻣﻘﺴﻢ ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﺃﻥ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻛﺎﻥ ﻳﺼﻠﻲ ﻓﻲ ﺭﻣﻀﺎﻥ ﻋﺸﺮﻳﻦ ﺭﻛﻌﺔ ﻭﺍﻟﻮﺗﺮ

অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস (রা:)বলেন, রাসুলল্লাহ(সা:)রামাযান মাসে বিশ রাকাআত তারাবীহ এবং তিন রাকাআত বিতির পড়তেন । এ হাদীসটি যেসকল নির্ভরযোগ্য কিতাবে বিদ্যমান। যেমন: আলমুনতাখাব মিন মুসনাদি আবদ ইবনে হুমাহীদ ২১৮, হাদীস ৬৫৩ , আসসুনালুল কুবরা বায়হাকি ২/৪৯৬, আল মুজামুল কাবীর, তাবরানী ১১/৩১১, হাদীস ১২১০২ , আলমুজামুল আওসাত, তাবরানী ১/৪৪৪ , হাদীস ৮০২ , আততামহীদ, ইবনে আব্দুল বার ৮//১১৫, আলইসতিযকার ৫/১৫৬ মুসান্নফে ইবনে আবি শাইবা ২/৩৯৪ হাদীস ৭৭৭৪

হাদীসের পর্যালোচনা:

একদল মুহাদ্দীস এর সনদকে যয়ীফ/দুর্বল বলেছেন। তবে হ্যা হাদীসের মধ্যে ইব্রাহীম ইবনে উসমান নামক একজন রাবী ব্যতিত সবাই নির্ভরযোগ্য । মনে রাখতে হবে যে,অগ্রগন্য মতানুসারে ইব্রাহীম ইবনে উসমানকে চরম যয়ীফ বা মাতরূক পরিত্যাজ্য বলা যাবেনা । (দেখুন বিস্তারিত ইলাউস সুনান ৭/৮২-৮৪ আলকামিল ইবনে আদী ১/৩৮৯-৩৯২ )

উসুলে হাদীসের নির্ভরযোগ্য মূলনীতি হল যয়ীফ দুই প্রকার: (১) যে যয়ীফ সনদে বর্ণিত রিওয়ায়াতটির বক্তব্য শরী’আতের দৃষ্টিতে আপত্তিকর । অর্থাৎ এই বক্তব্যের অনুকূলে শরয়ী কোন দলীলের সমর্থন তো নেই বরং তার বিপরীতে দলীল বিদ্যমান রয়েছে । এধরনের যয়ীফ কোন অবস্থাতেই আমল যোগ্য নয়।

(২) যে রিওয়ায়াতটি যয়ীফ সনদে বর্ণিত, কিন্তু তার বক্তব্যের সমর্থনে শরী’আতের অন্য দলীল প্রমাণ রয়েছে । মুহাক্কিক,মুহাদ্দীস ও ফকীহগণের সিদ্ধান্ত হল এধরণের রিওয়ায়াতকে যয়ীফ বলা হলে তা হবে শুধু সনদ এর বিবেচনায় এবং ফর্মালিটিমুলক । অন্যথায় বক্তব্য ও মর্মের বিচারে এটি সহীহ ।

তাই বিশ রাকাত তারাবীহ ব্যাপারে উক্ত হাদীস আমল যোগ্য । অর্থাৎ শুধু সনদের বিবেচনায় দুর্বল কিন্তু এর বক্তব্যের সমর্থনে অনেক শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে। যেমন: বিশ রাকাআত তারাবীহ ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত মহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের ইজমা মারফু হুকমী সুন্নতে মুতাওয়ারাসা এবং ফুকাহায়ে কেরামের ইজমা ।

তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম (রা:) রাসুলুল্লাহ (সা:) এর আমল ও দিকনির্দেশনা ব্যতীত কোন কিছু বৃদ্ধি কিংবা কোন প্রকার কাট করেননি। দেখুন:-(আল-ইখতিয়ার লিতালীলিল মুখতার ১/৬৮-৭০) শাস্ত্রীয় পরিভাষায় এধরনের যয়ীফকে বলা হয়,

الضعف المتلقي بالقبول এমন হাদীস যার সনদ যয়ীফ কিন্তু মান ও এর বক্তব্য সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে নিয়ে গোটা উম্মতের আমলের মাধ্যমে অনুসৃত। যয়ীফ/দুর্বল হাদীসের এই প্রকারটির ব্যাপারে উসুলে হাদীসের সিদ্ধান্ত হল তা সহীহ এবং দু এক সুত্রে বর্ণিত সাধারণ সহীহ হাদীসের চেয়ে এর মাকাম ও মর্যাদা অনেক উপরে।

উসুলে হাদীসের এই নীতির ব্যাপারে হাদীস শাস্রের অনেক ইমামের এবং উসুলে হাদীসের কিতাব সমুহে অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে । একটি উদ্ধৃতি যেমন :- ইমাম বদরূদ্দীন যারকাশী(রহ:) উসুলে হাদীসের নির্ভরযোগ্য ও দলীল ভিত্তিক কিতাব আননুকাত এ লেখেন,

ان الحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول عمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر.(আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ ১/৩৯০)

তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত যে হাদীসটি গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুরা তারাবীর ব্যাপারে ফিট করেন,তা সহীহ বুখারী এবং হাদীসের অন্যান্য কিতাবে উম্মুল মুমিনিন আয়শা (রা:) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে ।সেখানে বলা হয়েছে রাসুল (সা:) রমযান ও এর বাইরে অন্যান্য মাসে চার রাকাআত করে আট রাকাআত এবং তিন রাকাআত বিতর এই এগারো রাকাআত পড়তেন এর চেয়ে বেশি পড়তেন না। অথচ এটা রাসুলের সবসময়ের আমল ছিলনা । কেননা খোদ আম্মাজান হযরত আয়শা (রা:) বর্ণিত অন্য রিওয়ায়ত থেকে প্রমাণিত যে, রাসুল (সা:) ফজরের সুন্নত ছাড়াও তের রাকাআত পড়েছেন । (সহীহ বুখারী ১১৬৪ ফাতহুল বারী ৩/২৬)

আমাদের গায়রে মুকাল্লিদ সেসব বন্ধুদের কর্মনীতির আশ্চর্যজনক দিক হল,তারা একদিকে বলেন তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাজ,অপরদিকে আবার বলছেন তারাবীহ আট রাকা’আতের বেশি পড়া নাজায়েয বা বিদাত । অথচ তাহাজ্জুদের ব্যাপারে সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে,এর নির্ধারিত কোন রাকাত সংখ্যা নেই ।

দুই রাকা’আত করে যত রাকা’আত ইচ্ছা পড়তে থাকুন এবং যখন সুবহে সাদেক হওয়ার আশংকা হবে তখন বিতর পড়ে নিন। ( দেখুন সহীহ বুখারী হাদীস ১১৩৭,সহীহ মুসলিম হাদীস ৭৪৯) তাছাড়া উম্মুলমুমিনিন আয়শা সিদ্দিকা(রা:) মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীর উপর আপত্তি কখনো উত্থাপন করেননি । করেছেন বলে এর কোন প্রমাণও দেখাতে পারবেনা ঐসব লামাযহাবী ভাইরা ।

যখন তারা এই হাদীস দ্বারা তারাবীহ নামাযের ব্যাপারে প্রমাণ করতে ব্যর্থ,তখন তাদের কেউ কেউ দেখা যায়, হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ:) এর কথা দ্বারা প্রমাণ করতে আরম্ভ করেছেন। অর্থাৎ তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদে কোনো ফরক ছিলনা,উভয়টি এক।পার্থক্য কেবল সময় ও বৈশিষ্টে।তাদের এসব নীতি যেন এই,যেখানে মানব না সেখানে খুলাফায়ে রাশেদীনকেও না। আর মতলবের জন্য যদি মানতে হয় তাহলে এযুগের কাশ্মীরীকে মানতে আপত্তি নেই ।

আল্লাহর বান্দারা কাশ্মীরীর দলীলহীন এ কথাটা মেনে নিয়েছে,কিন্তু তার উস্তাদগণের উস্তাদ ফকীহুন-নফস হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রাহ: ) যে,স্বতন্ত্র প্রবন্ধ এ বিষয়ে লিখেছেন এবং তাতে অনেক দলীলপ্রমাণ দ্বারা এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দুটো ভিন্ন ভিন্ন নামাজ । এটা তাদের নজরে পড়েনি । (দেখুন তালীফাতে রশীদিয়া ৩০৬-৩২৩) কথিত আহলে হাদীস লামাযহাবী ব্যতীত সমগ্র বিশ্বের হকপন্থী মুসলমান অদ্যাবধি বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ আদায় করে যাচ্ছেন ।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে কথিত আহলে হাদীস লামাযহাবী ফিতনা থেকে হেফাজত করত: সঠিকভাবে তারাবীহ নামাজ বিশ রাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন!!!

লেখক: শিক্ষা সচিব, জামিআ’ ফারুকিয়্যাহ, সিলেট।