তাওবা কীভাবে করতে হয় ও তাওবার গুরুত্ব ফজিলত
একুশে জার্নাল ডটকম
নভেম্বর ১১ ২০২০, ১৬:২৫
আব্দুল কাদির আল মাহদি: প্রত্যেক গুনাহ থেকে তাওবা করা একজন মুমিনের জন্য ফরজ। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ-
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (আল কোরাআন ২৪/৩১)
*তাওবার বলতে যা বুঝায়
তাওবার মূল কথা হচ্ছে এমন একটি অনুভূতি যে নিজের কৃত গুনাহসমূহের উপর অনুতপ্ত হওয়া। তাওবার অর্থ হচ্ছে الرجوع الي الله অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার দিকে ফিরে আসা। الرجوع من معصيته الي طاعته অর্থাৎ নাফরমানি থেকে আল্লাহ তা’আলার এতা’আতে ফিরে আসা। তাওবার দ্বারা বান্দার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। যেটি বান্দাকে তার সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে; শয়তান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ে।
*তওবা করলে আল্লাহ খুশি হন
গুনাহগার বান্দা তওবা করলে আল্লাহ তা’আলা কেমন খুশি হন রাসুল (সা) বিষয়টিকে একটি হাদিসে দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেন। হাদিস হচ্ছে-
عن أنس بن مالك قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ . (متفق عليه)
আনস বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করে তখন আল্লাহ ঐ লোকের চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে নিজ সওয়ারীর উপর আরোহিত ছিল। তারপর সাওয়ারীটি তার হতে হারিয়ে যায়। আর তার উপর ছিল তার খাদ্য ও পানীয়। এরপর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় এসে আরাম করে এবং তার উটটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎ উটটি তার কাছে এসে দাঁড়ায়। অমনিই সে তার লাগাম ধরে ফেলে। এরপর সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠে, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ভুল করে ফেলেছে। (সহিহ মুসলিম)
*তাওবা না করলে যে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়
মানুষ যেকোন গুনাহ করার পর তার ক্বলবে একটি দাগ পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি তাওবা না করলে সে দাগ বিস্তৃত হতে থাকে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ : ” إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ فَإِنْ تَابَ وَنَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ صُقِلَ قَلْبُهُ فَإِنْ زَادَ زَادَتْ فَذَلِكَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَهُ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ {كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ}
আবূ হুরায়রাহ্ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মু’মিন বান্দা যখন গুনাহ করে তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। এরপর সে ব্যক্তি তওবা্ করল ও ক্ষমা চাইল, তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে গেল (কালিমুক্ত হলো), আর যদি গুনাহ বেশি হয় তাহলে কালো দাগও বেশি হয়। অবশেষে তা তার অন্তরকে ঢেকে ফেলে। এটা সেই মরিচা যার ব্যাপারে কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘এটা কখনও নয়, বরং তাদের অন্তরের উপর (গুনাহের) মরিচা লেগে গেছে, যা তারা প্রতিনিয়ত উপার্জন করেছে’’- ( আল কোরআন ৮৩/১৪)। (আহমদ, তিরমিযী)
কাজেই মানুষ গুনাহ করার সাথে সাথে তাওবা করে নেয়া উচিত। তাওবা বিলম্ব হওয়ার কারনে বান্দার অন্তর মরীচিকায় দূর্বল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্ততকরণ বন্ধ করে দেন।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত তাবাররি (রাহ) বলেন কোন মুমিনের উচিত নয় তাওবার সুযোগকে বিলম্বিত করা যদিও একই গুনাহ বার বার করা হয়।
এছাড়া একজন মুমিন একবার তাওবা করার পর, এমন চিন্তা করাও কাম্য নয়। আমি কেমনে তাওবা করবো? আমি তো একই গুনাহ বার বার করেই যাচ্ছি। তিরমিযির হাদিস হচ্ছে-
كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءٌ، وخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ
প্রত্যেক আদম সন্তান গুনাহগার। আর গুনাহকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে- তওবাকারীগণ।
কোন মানুষের জন্য ছোট্র গুনাহকে তুচ্ছ মনে করে তাওবার কাজ ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। কেননা আল্লাহ তা’আলা এটা দেখেন না গুনাহ পরিমান কতটুক, বরং আল্লাহ তা’আলা গুনাহগারের অনুভূতিটা দেখেন।
সুতরাং সব ছোট, বড় গুনাহ থেকে তাওবা করা আবশ্যক। এবং যে সৃষ্টিকর্তা আমাকে এতো এতো নেয়ামতরাজি দিয়ে ধন্য করলেন যে নেয়ামত সমূহ গণনা করে শেষ করার নয়। তার কাছে নতিস্বীকার করা জরুরী।
*তাওবার শর্ত সমূহ
মানুষের দিলের ভিতর এমন দৃঢ়তা থাকা উচিত যে আমি মৃত্যুর আগে আর গুনাহের দিকে ফিরে যাব না। মৃত্যু এমন সত্য একটি বিষয় যেকোন মূহুর্তে এসে যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবা কর-আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। (আল কোরআন ৬৬/৮)
আর তাওবায়ে নাসুহার জন্য তিনটি শর্ত। এক. কৃত গুনাহ সাথে সাথে ছেড়ে দেয়া এবং আর গুনাহ করবেনা বলে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। দুই. কৃত গুনাহের উপর অনুতপ্ত হওয়া। তিন. আল্লাহ তা’আলাকে হাজির নাজির বিশ্বাস করে কৃত গুনাহের স্বীকৃতি দেয়া।
কিন্তু কৃত গুনাহ যদি বন্দার সাথে সম্পর্কিত হয়। অর্থাৎ কাউকে গালি দিয়েছে, জুলুম করেছে অথবা কারও কিছু বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করে নিয়েছে। তাহলে উপরোক্ত তিনটি শর্তের সাথে চতুর্থ আরেকটি শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে প্রথমে মাফ যেন চেয়ে নেয়ে।
مَنْ كَانتْ عِنْدَه مَظْلمَةٌ لأَخِيهِ مِنْ عِرْضِهِ أَوْ مِنْ شَيْءٍ فَلْيتَحَلَّلْه ِمِنْه الْيَوْمَ قَبْلَ أَلَّا يكُونَ دِينَارٌ وَلَا دِرْهَمٌ، إنْ كَانَ لَهُ عَمَلٌ صَالِحٌ أُخِذَ مِنْهُ بِقَدْرِ مَظْلَمتِهِ، وإنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ حسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ سيِّئَاتِ صاحِبِهِ، فَحُمِلَ عَلَيْهِ رواه البخاري.
আবুহুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত।,তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোন বিষয়ে যুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ হতে মাফ করিয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যে দিন তার কোন দীনার বা দিরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট থেকে নেয়া হবে আর তার কোন সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ হতে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। (বুখারী)
কাজেই সেদিবসের জন্য “ই্যায়াওমুল কিয়ামাহ, ই্যায়াওমুত তাগাবুন, ই্যায়াওমুল হা’ক্বাহ, ই্যায়াওমুল ক্বারিয়াহ” এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। যেদিবসকে কেউ কারও উপকারে আসবে না।
يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِنَفْسٍ شَيْئًا ۖ وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ
সেদিন কেউ কারও জন্য কিছু করার মালিক হবে না; আর সেদিন সব বিষয়ের কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর। (আল কোরআন ৮২/১৯)
*তাওবার ক্ষেত্রে নিরাশ হওয়া যাবে না
গুনাহগার বান্দা নিরাশ হলে চলবে না। কৃত গুনাহের পরিমান যত বেশি হওক। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আল কোরআন ৩৯/৫৩)
নিরাশ হয়ে এরকম ধারনা পোষণ করা যাবে না যে আল্লাহ তা’আলা আমাকে মাফ করবেন না। আল্লাহ তা’আলা আমাকে আজাবে নিপতিত করবেন। এসব ধারনা পোষণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। হ্যাঁ আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তি দাতা, কিন্তু অপর পক্ষে তিনি অনেক বেশি দয়ালূ। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ وَأَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
জেনে নাও, নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তি দাতা ও নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল-দয়ালূ। (আল কোরআন ৫/৯৮)
জেনে রাখুন! এমন হাদিস যেখানে আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত মায়া করে তার বান্দাদের তাওবার প্রতি আহবান করছেন।
قَالَ اللهُ تَعَالَى: يَا ابْنَ آَدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوتَنِيْ وَرَجَوتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ مِنْكَ وَلا أُبَالِيْ، يَا ابْنَ آَدَمَ لَو بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ استَغْفَرْتَنِيْ غَفَرْتُ لَكَ، يَا ابْنَ آَدَمَ إِنَّكَ لَو أَتَيْتَنِيْ بِقِرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لقِيْتَنِيْ لاَتُشْرِك بِيْ شَيْئَاً لأَتَيْتُكَ بِقِرَابِهَا مَغفِرَةً
রাসুলুল্লাহ (সা) হাদিসে কুদসিতে বর্ণনা করেন : আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে আদম সন্তান! যতক্ষণ আমাকে তুমি ডাকতে থাকবে এবং আমার হতে (ক্ষমা পাওয়ার) আশায় থাকবে, তোমার গুনাহ যত অধিক হোক, তোমাকে আমি ক্ষমা করব, এত কোন পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ্র পরিমাণ যদি আসমানের কিনারা বা মেঘমালা পর্যন্তও পৌছে যায়, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, এতে আমি পরওয়া করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি সম্পূর্ণ পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়েও আমার নিকট আস এবং আমার সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করে থাক, তাহলে তোমার কাছে আমিও পৃথিবী পূর্ণ ক্ষমা নিয়ে হাযির হব। (তিরমিযি)
আল্লাহ তা’আলা যেন সর্বদা আমাদের তাওবা করার তাওফিক দান করেন। আমিন
দারুল কোরআন ইসলামিক সেন্টার বার্সেলোনা স্পেনে আব্দুল কাদির মাহদি প্রদত্ত জুম্মার খুতবা