ডাক্তারের গায়ে হাত তুলল ফার্মেসি মালিক, ব্যবস্থা নেয়নি সিভিল সার্জন
একুশে জার্নাল
মে ০৯ ২০২০, ১০:২৭
রেজওয়ান উল্লাহ, কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের অপোজিটে এসএমএসে কর্তৃক সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: তৈবুর রহমান গালিবের গায়ে হাত তুলেছে। অভিযোগ উঠেছে যে, বারবার বিচার চাওয়া সত্ত্বেও সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
৮(মে) শুক্রবার রাত ১০ টা ৪৫ মিনিটে ডাঃ তৈবুর রহমান গালিব তার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এমন অভিযোগ করেন। নিচে তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
“ইমার্জেন্সিতে ছিলাম। ছয়মাস বাড়ি যাই না। সেই যে সরকারি চাকরি পেলাম, আর ছুটি নেই। করোনার সময় থেকে একদিন জীবনের নিরাপত্তা পেলাম না। সাতক্ষিরা সদর হাসপাতালে আমার পোস্টিং। আজ টানা আঠারো ঘন্টা ডিউটি ছিলো। বিকাল তিনটা থেকে পরদিন সকাল নয়টা। এক রোগি এসে বললো, স্যার একটা ঔষধ একটা লিখছে, দোকানি আরেকটা দিছে। নার্সরা চেঞ্জ করে আনতে বলছে। চেঞ্জ করতে গেলে দোকানি বললো, বিক্রি জিনিস ফেরত হয় না।
আমি বললাম, আবার যান, বলেন ইমার্জেন্সি ডাক্তার বলছেন।
অই গরীব রোগি আবার গিয়েও ঔষধ চেঞ্জ বা টাকা ফেরত পেল না। আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। নিতান্ত গরীব মানুষ। কত কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছে।
আমি বললাম, এটা ত ঠিক না। চলেন ত দেখি।
হাসপাতালের অপোসিটেই দোকান। ইমার্জেন্সিতে একজনকে বসিয়ে অই দোকানে গেলাম।
দোকানে একজন লম্বা মানুষ। পাশে আরেকজন। জিজ্ঞেস করলাম, ঔষধটা সম্ভব হলে চেঞ্জ করে দেন।
দোকানের মালিক বললেন, বিক্রি জিনিস আমরা ফেরত নেই না।
আমি বললাম, দেখেন গরীব মানুষ। আর যে অসুধ লিখেছে, অইটা ত দেন নাই।
দোকানি চেতে গেলেন, আপনি কে?
— আমি ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার।
উনি তাচ্ছিল্য করে বললেন, ও কমিশন খেতে আসছেন?
আমি বললাম, দেখেন টাকাটা ফেরত দেন অসুধ না থাকলে।
দোকানি চিৎকার করে উঠলেন, বাড়ি কই আপনার?
আমি বললাম, ফরিদপুর।
— ফরিদপুর হয়ে সাতক্ষিরায় রংবাজি করেন!
বলেই আমাকে বুকে একটা ধাক্কা দিলেন।
এরপর বললেন, আমাকে চিনেন? যান যান। ক্যাশে টাকা নাই।
আমি বললাম, এত বড় দোকানে ক্যাশে টাকা নেই? দ্বিতীয়বার ধাক্কা দেয়ায় আমার একটা শার্টের বোতাম ছিড়ে গেলো।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধকে বললাম চলেন যাই। তখন বাজে পাঁচটা। আমি ইমার্জেন্সিতে এসে সাড়ে পাঁচটায় সিভিল সার্জন স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন ইফতার শেষে কথা বলবেন।
ইফতার শেষে আবার ফোন দিলাম, উনি বললেন দোকানি বেশ ক্ষমতাশালি।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
স্যারকে বললাম, তাই বলে আমাকে মারবে!
উনি বললেন তুমি থাকো। আমি দেখতেছি।
আমি এরপর আরো কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু নয়টায় আমার ইভিনিং ডিউটি শেষ হবার আগ পর্যন্ত তিনি আমাকে দেখতে আসেননি।
আমার প্রতিষ্ঠানের আরএমও হাসপাতালেই ছিলেন। তিনিও একবারও আমাকে দেখতে আসেন নি।
আমি আহত হৃদয়ে ইমার্জেন্সি থেকে নয়টায় বের হয়ে আসি। এরপর খেয়াল করলাম, জামার দুইটা বোতাম ছিড়ে গেছে।
আমি ছোট একজন মেডিকেল অফিসার। এজন্য আমার খোঁজ নিলো না। জানি একজন বড় সিভিল সার্জন আমি নই। তাকে মারলে হয়ত দুনিয়া উল্টে যেত। হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেত। আমার জন্য কিছুই হয়নি। সবই চলছে। হয়ত কালও চলবে।
তার আবেগঘন স্ট্যাটাসে তিনি আরো লেখেন-
“এই তো সেদিনও মা ফোন দিয়ে বললেন, তুমি বাসায় চলে আসো।
আমি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে বলি, আর যে কবে দেখা হবে!
আম্মা আবেগি কন্ঠে বলেন, কাজ করতে হবে না। তুমি বেচে থাকো। ছোট ছেলেটা দেশের বাইরে। তোমার কিছু হয়ে গেলে…
শুনি আর হাসি। এক জীবনে এমন কতো ভালোবাসা যে আমাদের ঘিরে থাকে, আমরা তা টেরও পাই না।
আমি ধরা গলায় বলি, চলে আসবো ঠিক একদিন দেইখেন। বলেই বুকে ধক করে ওঠে। মনে ভয় জাগে, যদি না ফিরতে পারি! যদি এমন হয় আমার কাছে আমার মা কে আসতে না দেয়া হয়! আঞ্জুমানের কাছে চলে যায় দেহটা! বাবার সাথে শেষ দেখাটা নাও তো হতে পারে।
কিন্তু শত ভয়ের মধ্যেও আমরা ডিউটি করি।
আমার একজন বড়ভাই ছিলো। দুই বছর বয়সে হাইড্রোকেফালাস নিয়ে মারা গেছেন। আজ ভাবি, তিনি বেচে থাকলে হয়ত এভাবে মার খেতে হতো না। দুঃখ একটা আমার ঢাকা মেডিকেলের বড় ভাই যিনি আমার সিভিল সার্জন তাকে আমি বড় ভাই বলতে পারলাম না। চারঘন্টায় তিনি এক কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে বসে আমাকে দেখতে আসেন নি।
আমার জীবনে আমি প্রথমবারের মত নিজের বড়ভাইকে মিস করলাম।
একসময় দেখেছিলাম, বাংলাদেশ নামের দেশটির বেশিরভাগ শিশুরই রাস্তায় জন্ম হয়। কোন পিতামাতা থাকে না।
আজ জানলাম, আমি একজন সরকারি মেডিকেল অফিসার। আমারও কোন পিতামাতা নাই।
হয়ত করোনার এই দিনে আর কোনদিন বেচে থাকবো না। কিন্তু জেনে গেলাম এদেশের সবার জীবনের মূল্য আছে বলেই আমি ঈদের ছুটি পাইনি। কিন্তু আমার জীবনের মূল্য নেই।”