জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশক, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য
একুশে জার্নাল
জুলাই ২১ ২০২০, ১৩:১৫
মুফতি আহমদ যাকারিয়া
আরবি বারো মাসের মধ্যে জিলহজ্ব মাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ।এটা হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় মিলন হজ্ব ও কোরবানির মাস। এ মাসে বেশ কিছু ইবাদত রয়েছে। যেসব ইবাদত আমরা খুব সহজেই করে অনেক সওয়াব অর্জন করতে পারি। এবং রবের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করতে পারি। বিশেষকরে, এ মাসের প্রথম দশ দিন মুমিনের জন্য অত্যন্ত ফযিলতের।
জিলহজ্বের প্রথম দশকের গুরুত্ব:
যিলহজ্বের প্রথম দশ দিন অতি ফযিলতপূর্ণ। এই দশ দিনের আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়।
কুরআন ও হাদিসে জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ রাতের সবিশেষ ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
আল্লাহ পাক কুরআনে এ দশ রাতের কসম খেয়েছেন।
وَالْفَجْرِ (১) وَلَيَالٍ عَشْرٍ (২) وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ (৩) وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ (৪)
(১) শপথ ফজরের
(২) শপথ দশ রাত্রির, শপথ তার,
(৩) যা জোড় ও যা বেজোড়
(৪) এবং শপথ রাত্রির যখন তা গত হতে থাকে।
এ চার আয়াতের মধ্যে আল্লাহ পাক পাঁচটি জিনিসের কসম খেয়েছেন।
১. ফজরের।
২. দশ রাত্রির।
৩. জোড়ের।
৪. বেজোড়ের।
৫. এবং রাতের।
ইবনে আব্বাস, ইবনে যুবায়ের, এখানে ১০ রাত্রি বলতে জিলহজ্বের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে বলে মত দিয়েছেন। ঠিক তেমনিভাবে অধিকাংশ তাফসিরবিদ যেমন- কাতাদা, মুজাহিদ, সুদ্দি, যাহ্হাক, কালবি রহ. প্রমুখ ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা জিলহজ্বের প্রথম দশরাত উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
এই মতামতের সত্যায়ন একটি মারফু হাদিস দিয়েও হয়। যা হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাজরের তাফসিরে বলেন-
عن أبي الزبير عن جابر قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : { والفجر وليال عشر } قال : العشر عشر الأضحى و الوتر يوم عرفة و الشفع يوم النحر-
‘ফজর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সকাল। আর দশরাত্রি দ্বারা জিলহজের প্রথম দশ রাত উদ্দেশ্য। যাতে কুরবানিও শামিল রয়েছে।
এবং الوتر দ্বারা আরাফার দিন নবম জিলহজ উদ্দেশ্য।
আর الشفع দ্বারা দশম জিলহজ্ব বুঝানো হয়েছে।
(শুআবুল ইমান:৩/২৫২; ফাজায়িলুল আওকাত:৩৪০;
মুস্তাদরাকে হাকিম:৪/২২০)
আবু হুরায়রা রা. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-
مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ. يَعْنِى أَيَّامَ الْعَشْرِ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَىْءٍ-
এমন কোনো দিন নেই, যার আমল জিলহজ্ব মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। আরজ করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি নয়? উত্তরে নবী সা. বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে এবং কোনো কিছু নিয়েই ফিরে আসে নি, (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে) তার কথা ভিন্ন।
(বুখারী:৯৬৯, আবূ দাউদ:২৪৪০, তিরমিযী:৭৫৭)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ وَلا الْعَمَلُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ، فَأَكْثِرُوا فِيهَا مِنَ التَّهْلِيلِ، وَالتكبير والتَّحْمِيدِ، يَعْنِي: أَيَّامَ الْعَشْرِ-
এই দশ দিন নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়। (মুসনাদ আহমাদ:১৩২, বাইহাকী, শুআবুল ঈমান:৩৪৭৪)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ ، يَعْدِلُ صِيَامُ كُلِّ يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ ، وَقِيَامُ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ-
দুনিয়ার সাধারণ দিবস-রজনীর মধ্যে আমল করার চেয়ে জিলহজ্বের প্রথম দশ দিনে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। এ সময়ে একদিন রোযা রাখা অন্য সময়ের এক বছর রোযা রাখার সমান। এক রাতের ইবাদত শবে কদরের মতো মহান। (বায়হাকি:শুআবুল ইমান- ৩/৩৫৫,
ফাজায়িলুল আওকাত-৩৪৬)
এ হাদীসগুলোতে জিলহজ্বের প্রথম দশকের আমল-ইবাদতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন; আল্লাহ তা’য়ালা দিবসসমূহের মধ্যে চারটি দিবসকে সম্মানিত করেছেন- জুমাবার, আরাফার দিন, ঈদুল আজহার দিন, ও ঈদুল ফিতরের দিন। তদ্রুপ চারটি মাসকেও মর্যাদাপূর্ণ করেছেন-
১. জিলক্বদ, ২. জিলহজ্ব ৩. মহররম ও ৪. রজব।
নবী সা. থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, যখন আরাফার দিন আসে, তখন আল্লাহ তা’য়ালা তার রহমত ছড়িয়ে দেন। এ দিনে যে পরিমাণ লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়, অন্য কোনদিন তা দেয়া হয় না। যে ব্যক্তি আরাফার দিনে রোজা রাখে তার বিগত বছর ও আগামী বছরের (সগীরা) গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হয়। (মুসলিম)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘জিলহজ্বের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো’। (তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা:১৫৮)
রাত সমূহের মধ্যে যেমন রমাদানের শেষ ১০ রাত শ্রেষ্ঠ তেমনি দিন সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো জিলহজ্বের প্রথম ১০ দিন। এমনকি তা রমাদানের শেষ ১০ দিনের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তাই এই মূল্যবান সময়ে আমাদের উচিত আমলের প্রতি যত্নশীল হওয়া। অথচ এই মূল্যবান দিনগুলো দেখা যায় যে, আমরা হেলায় ফেলায় কাটিয়ে দেই। অথচ আমাদের উচিত হলো যে, এই দিনগুলো থেকে পরিপূর্ণভাবে ফায়দা হাসিল করা।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রাহ. উনার কিতাব ফাতহুল বারীতে লিখেন যে, আল্লাহ তায়ালা জিলহজ্বের প্রথম দশকে এত বেশী ফজিলত রাখার কারন হলো যে, এই ১০ দিনে সকল এবাদত একত্রিত হয়ে যায়, যেমন কুরবানী, হজ্ব, আরাফার দিনের রোযা, ১থেকে ৯ তারিখের রোযা, সাদাকাহ, নামাজ সব ধরনের এবাদত এই ১০ দিনে একত্রিত হয়ে যায়, পক্ষান্তরে অন্যান্য দিবস সমুহে রোযা, নামাজ থাকলেও হজ্ব, কুরবানী থাকে না। সুতরাং এই দশ দিনকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে নিজেকে আমলের ভেতর রাখা উচিত।
জিলহজ্ব মাস ইসলামের আগেও সম্মানিত ছিল:
মনে রাখবেন জিলহজ্ব মাস শুধু মুসলমানদের জন্যই সম্মানের মাস নয় বরং এ মাসকে কাফেরেরাও সম্মান করত, এ মাসটি ৪টি হারাম মাসের অন্যতম মাস। যেমন জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব এ ৪টি মাসে ইসলাম পূর্বে কাফেররাও এই ৪ মাসের সম্মানার্থে কোন ধরনের যুদ্ধ- বিগ্রহ, ঝগড়া-বিবাদ করত না। এ ব্যাপারে একটি হাদীস দেখা যায়, যার মাফহুম কিছুটা এমন যে,
হাদীসের মাফহুম- একদিন নবী সা. এর কাছে একটি গোত্র থেকে প্রতিনিধি দল এসে ইসলাম কবুল করলো, আর ইসলাম কবুল করে আরজ করল; ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা যখন আপনার কাছে আসি তখন আমাদের পথে থাকে “মুদার গোত্র” তারা হারাম মাস তথা জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম ও রজব মাস ছাড়া অন্য মাসে আমাদেরকে আসতে দেয় না, তাই আমাদেরকে এমন কিছু আমল বলুন; যা করলে আমরা জান্নাত লাভ করব। দেখুন এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মুদার গোত্র একটি কাফের গোত্র তারাও এই ৪ মাসকে সম্মান করত এবং এ মাসসমুহে কারো সাথে কোন ধরনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতো না। সুতরাং আমরা মুসলমান হিসেবে এই মাসসমুহকে আরো বেশী সম্মান করা উচিত।
এই দশকে আমরা যা করতে পারি:
রাসূলুল্লাহ সা. এ সময় বেশি করে তাসবীহ (সুবাহানআল্লাহ্), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ্), তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) পড়তেন।
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহর নিকট এই দশ দিনের নেক আমল অপেক্ষা অন্য কোনো দিনের আমল অধিক প্রিয় নয়। সুতরাং তোমরা এই সময়ে তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ্), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পড়।”
(মুসনাদে আহমাদ)
তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা: জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসর নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। এটি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সকল বালেগ পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী বা একাকী আদায়কারী প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি; বাহরুর রায়েক)
তাওবাহ করা: এ ব্যাপারে তো আলাদাভাবে বলার প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো যখন তাঁর কোনো বান্দা তওবা করে তার কাছে ফিরে আসে। অতএব আমাদের বেশি বেশি করে তাওবা, ইস্তেগফার করা উচিত।
নফল নামাজের ইহতিমাম করা।
নফল নামাজের ফজিলত; নবী সা. এরশাদ করেন; আল্লাহর জন্য তোমরা নিজেদের সিজদাকে আবশ্যক করে নাও, কেননা যখন বান্দাহ আল্লাহকে সিজদা করে তখন আল্লাহ তায়ালা সে সেজদার বদলায় বান্দার ১টি মর্যাদা বৃদ্ধি ও ১টি গুনাহ মাফ করে দেন। (মুসলিম-৪৪৮)
সুতরাং এ গুরুত্বপূর্ণ দিনসমুহে বেশী বেশী নফল নামাজ পড়ার চেষ্টা করা উচিত। বিশেষকরে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া, এই ১০ দিন তাহাজ্জুদ নামাজ, সালাতুল তাসবিহ, কুরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরীফ, বেশী বেশী এসতেগফারের মাধ্যমে রাতের বেশীরভাগ অংশ কাটানো। এবং নিজের সকল নেক মাকসাদের জন্য দোয়া করা।
ইনশাআল্লাহ শবে কদরের পর সবচেয়ে মর্যাদাবান এই ১০ রাতে আমরা আমাদের মাকসাদ পুরনের জন্য বেশী বেশী দোয়া করতে পারি। গুনাহে কবিরা ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করা এই দশ দিনে খুবই জরুরি।
পশু কুরবানি করা: এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ তাঁর নবীকে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের মধ্যে এসেছে, ‘তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানি সম্পাদন করো।’ (কাউসার:২)
ইবনে কাসির বলেছেন, সূরা ফজরের এক ও দুই আয়াতে তথা শপথ প্রভাতের, শপথ দশ রাতের, যে দশ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা জিলহজ্বের প্রথম দশক।
(ইবনে কাসির, চতুর্থ খণ্ড: পৃষ্ঠা: ৫৩৫)।
এই দশক যেহেতু নেক আমলের বিশেষ সময়, তাই এই দশ দিনের যেকোনো আমল যেমন আল্লাহর নিকট অত্যধিক প্রিয় ও পছন্দনীয়। যেমন অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা, রোযা রাখা, যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি। তাই আল্লাহর নেয়ামত ও বিশেষ অনুগ্রহ মনে করে এই দশকে সাধ্যমতো নেক আমলের উপর অবিচল থাকা একান্ত প্রয়োজন।
তাছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশকের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা:
জিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।
হযরত উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إذا رأيتم هلال ذي الحجة وأراد أحدكم أن يضحي فليمسك عن شعره وأظفاره.
তোমরা যদি যিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।
(মুসলিম:১৯৭৭; জামে তিরমিযী : ১৫২৩; আবু দাউদ : ২৭৯১; নাসায়ী : ৪৩৬২; সহীহ ইবনে হিববান : ৫৮৯৭)
যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة. قال له رجل :يا رسول الله! أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال : لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك.
আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে, মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।
(মুসনাদে আহমদ : ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান : ৭৭৩;আবু দাউদ : ২৭৮৯; নাসায়ী: ৪৩৬৫)
অর্থাৎ যারা কুরবানী করতে সক্ষম নয় তারাও যেন মুসলমানদের সাথে ঈদের আনন্দ ও খুশি উদযাপনে অংশীদার হয়। তারা এগুলো কর্তন করেও পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। অনুরূপভাবে হাজীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারীও হবে।
আর এই আমল কিন্তু মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। ফিকাহবিদগণ বলেছেন যে, কুরবানি করার আগে নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি না কাটার পেছনে হিকমত হচ্ছে হজ্বযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য করা। কারণ, তাদের ইহরাম অবস্থায় এসব কাটা নিষিদ্ধ। ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন; পশু কুরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিছু অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি (ত্যাগ) করার ব্যাপারে যেন সে অভ্যস্ত হয়, এজন্যই এ নির্দেশ।
আরেকটি কথা, যারা কুরবানী করবে এবং যারা করবে না উভয়েই নখ না কাটা উত্তম।
হাদীসে এসেছে;
عن ام سلمة رضى الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من راى هلال ذى الحجة واراد ان يضحى فلا ياخذ من شعره ولا من اظفاره.
অর্থ: “হযরত উম্মে সালামা থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন, “যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখলো এবং কুরবানী করার নিয়ত করলো, সে যেন (কুরবানী না করা পর্যন্ত) তার শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটে।” (মুসলিম শরীফ)
মূলত: গ্রহণযোগ্য মত হলো এই যে, যারা কুরবানী করবে এবং যারা কুরবানী করবে না, তাদের উভয়ের জন্যই উক্ত আমল মুস্তাহাব ও ফযীলতের কারণ।
আর এ ব্যাপারে দলীল হলো এই হাদীস;
عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم امرت بيوم الاضحى عيدا جعله الله لـهذه الامة قال له رجل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ارايت ان لم اجد الا منيحة انثى افاضحى بـها قال لا ولكن خذ من شعرك واظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فذلك تمام اضحيتك عند الله.
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. উনার থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, “আমি কুরবানীর দিনকে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ পাক উক্ত দিনটিকে এই উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি হুযূর সা. কে জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি একটি মাদী মানীহা (উটনী) ব্যতীত অন্য কোন পশু কুরবানীর জন্য না পাই, তাহলে আপনি কি (আমাকে) অনুমতি দিবেন যে, আমি উক্ত মাদী মানীহাকেই কুরবানী করবো। জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না। তুমি উক্ত পশুটিকে কুরবানী করবে না। বরং তুমি কুরবানীর দিনে তোমার (মাথার) চুল, হাত-পায়ের নখ কাটবে। তোমার গোঁফ খাট করবে এবং তোমার নাভির নিচের চুল কাটবে, এটাই আল্লাহ পাক-উনার নিকট তোমার পূর্ণ কুরবানী অর্থাৎ এর দ্বারা তুমি উনার নিকট কুরবানীর পূর্ণ সাওয়াব পাবে।” (আবু দাউদ)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে যে, যারা কুরবানী করবে না, তাদের জন্যেও জিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত নিজ শরীরের চুল, নখ ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। আর যে ব্যক্তি তা কাটা থেকে বিরত থাকবে, সে একটি কুরবানীর সাওয়াব পাবে।
(শরহে নববী, বজলুল মাযহুদ, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী)
আশারায়ে জিলহজ্বের আরেকটি বিশেষ আমল হলো, ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নয়টি দিবসে (জিলহজ মাসের প্রথম নয় দিন) রোযা রাখতেন।
(আবু দাউদ : ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ : ২২২৩৪; নাসায়ী, : ২৪১৬)
অন্য হাদীসে হযরত হাফসা রা. বর্ণনা করেন;
أربع لم يكن يدعهن النبي صلى الله عليه وسلم : صيام عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر وركعتين قبل الغداة.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, জিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নাত নামায।
(নাসায়ী :২৪১৫; সহীহ ইবনে হিববান: ৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৭০৪২; মুসনাদে আহমাদ: ২৬৩৩৯)
বিশেষভাবে নয় তারিখের রোযা রাখা:
জিলহজ্বের প্রথম নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। সহীহ হাদীসে এই দিবসের রোযার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي بعده والسنة التي قبله.
আরাফার দিনের (নয় তারিখের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন।
(মুসলিম : ১১৬২; আবু দাউদ : ২৪২৫; তিরমিযী: ৭৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৭৩০)
আরেক হাদীসে এসেছে-
من صام يوم عرفة غفر له سنتين متتابعتين.
যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের (গুনাহ ক্ষমা করা হবে।
(মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৭৫৪৮; মাজমাউয যাওয়াইদ : ৫১৪১)
যারা জিলহজ্বের নয় রোযা রাখতে সক্ষম হবে না তারা যেন অন্তত এই দিনের রোযা রাখা থেকে বঞ্চিত না হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আশারায়ে যিলহজ্বের মতো অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দিনগুলোতেও ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক দিন। আমীন।
আরাফার দিন, অর্থাৎ ৯ জিলহজ নফল রোজা রাখা: এটা কিন্তু ইসলামে বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ
সুন্নাত আমল। তবে আরাফায় উপস্থিত হাজি সাহেবদের জন্যে এই রোজা রাখা প্রযোজ্য নয়।
আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে, আল্লাহ তায়ালা তার (রোজাদারের) বিগত এক বছরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’।
(তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৭)।
আরাফার দিনের দোয়া:
ইখলাছ ও বিশ্বাসের সাথে এই দিনে এ কালিমাটি বেশী বেশী পড়া উচিত। নবীজী সা. আরাফার দিন এ কালিমাটি খুব বেশী পড়তেন।
(মুসনাদে আহমাদ:৬৯২২ )
لَا اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَحْدَهٗ لَا شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلٰى كُلَّ شَيْئٍ قَدِيْرٍ
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব।
(ইলাউস সুনান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা: ১৪৮)।
কুরআন-হাদীসে জিলহজ্বের প্রথম দশকের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ তাৎপর্যের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে তেমনি প্রথম দশকের আমল ও ইবাদতের বিশেষ ফযীলত ও সওয়াবের কথাও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। এই দশকের নেক আমল, বিশেষত আল্লাহর যিকির সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন;
ويذكروا اسم الله في أيام معلومات على ما رزقهم من بهيمة الأنعام
“নির্দিষ্ট দিনসমূহে তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে সেই সকল পশুর উপর, যা তিনি তাদের দিয়েছেন। (হজ্ব: ২৮)
ইমাম বুখারী রাহ. বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ‘‘সুনির্দিষ্ট দিনসমূহ’’ দ্বারা জিলহজ্বের দশ দিনই উদ্দেশ্য। অনুরূপভাবে হযরত ইবনে ওমর রা., হাসান বসরী রাহ., আতা রাহ., মুজাহিদ রাহ., ইকরামা রাহ., কাতাদাহ রাহ., ইমাম নাখায়ী রাহ., ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ রাহ.সহ অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অভিমত, সুনির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা জিলহজ্বের দশ দিনই বোঝানো হয়েছে।-(তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৮৯; লাতায়িফুল মাআরিফ ৩৬১)
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন, আল্লাহকে স্মরণ ও তার নাম উচ্চারণ শুধু যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট নয়; বরং সুনির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম উচ্চারণের অর্থ হল, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের যেসব নেয়ামত দান করেছেন, বিশেষত জীব-জন্তুকে তাদের অধীন করে দিয়েছেন, তাদের খাদ্য বানিয়েছেন, ইত্যাদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
কুরআনের আয়াত ও হাদীসের আলোকে স্পষ্ট বুঝা যায়, এই দশ দিনের যেকোন নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। তাই মুমিন বান্দার জন্য অধিক পরিমাণে সাওয়াব অর্জন, আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের এরচেয়ে উপযুক্ত সময় আর কী হতে পারে? এজন্য পূর্ববর্তীদের জীবনীতে এই দশকের আমল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন এই দশকের দিনগুলোর আগমন ঘটত, তখন তারা এত অধিক আমল ও মুজাহাদা করতেন যে, যা পরিমাপ করাও সম্ভব নয়। আমাদেরও উচিত বিভিন্ন নেক আমলের মাধ্যমে এই দশকের রাত-দিনগুলোকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তোলা।