জিকির এবং পাগলামী -রশীদ জামীল
একুশে জার্নাল
মার্চ ০২ ২০১৯, ১১:৩৭

রশীদ জামীল: আল্লাহর অফিস টুয়েন্টিফোর/সেভেন খোলা। আল্লাহকে যা বলার সরাসরি বলা যায়। সুযোগ আছে। যা চাওয়ার সরাসরি চাওয়া যায়। ব্যবস্থা আছে। আমি আমার যতো কাছে, আল্লাহ তারচেও কাছে। ডাকলেই শুনেন। শব্দকরে ডাকতেও হয় না। মনেমনে ডাকলেও আল্লাহ শুনে ফেলেন। সাথে সাথে জবাবও দেন। তাহলে আবার ওয়াসিলাহ লাগবে কেন? পীর-ফকির ধরা লাগবে কেন? আল্লাহ পর্যন্ত পৌছার জন্যই যদি পীর হয়ে থাকেন, আর আল্লাহ যদি কাছেই থাকেন, তাহলে খামাখা পীরের পেছনে দৌড়ানোর তো কোনো মানে হয় না!
আজকাল এসব কথা বেশ জোরেসুরেই মার্কেটিং করা হচ্ছে। সাধারণ মুসলমানরা বিব্রত না হয়ে পারছে না। তাঁরা ভাবছে, কথায় তো যুক্তি আছে। আল্লাহ যদি কাছেই থাকেন, ডাকলেই যদি শুনেন, তাহলে পীরের আবার ডিউটি কী?
যারা এই কাজটি করছে, তাদেরকে যদি পালটা প্রশ্ন করাহয়, এভাবে,
১. আল্লাহপাক চাইলে মা বাবা ছাড়াই সন্তান দিতে পারেন। তাহলে মা-বাবার মাধ্যম লাগে কেন?
২. আল্লাহপাক বান্দার জন্মের ৫০ হাজার বছর আগে তার রিজিক তৈরি করে রেখেছেন। তাহলে সেই রিজিক একসাথে বা টাইম টু টাইম দিয়ে দিলেই হত। মানুষকে রিজিকের জন্য এত দৌড়াদৌড়ি করতে হয় কেন?
৩. আল্লাহপাক নবিজিকে মে’রাজ নিয়ে গেলেন, বোরাক নামের বাহনে বসিয়ে। দরকার তো ছিল না। ‘বন্ধু উপরে চলে এসো’ বললেই তো নবি সাত আসমানের উপরে পৌঁছে যেতেন।
৪. এ পর্যন্ত ১০ বার কা’বা ঘর মেরামত করা হয়েছে। কা’বা তো সরাসরি আল্লাহর ঘর। সেটা তো অন্তত আল্লাহর জন্য উচিৎ ছিল সরাসরি মেরামত করে নেওয়া। তাহলে ইবরাহিম, ইসমাঈল তারপর আরো অমুক-তমুককে দিয়ে কেন?
৫. রোগ বালাই থেকে পরিত্রাণ পেতে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার প্রেসক্রাইভ করেন। ঔষধ লিখে দেন। সেই ঔষধ আমরা সেবন করি। কেন করি? আমরা জানি ঔষধের কোনো ক্ষমতা নেই। সুস্থতা আল্লাহর হাতে।
দুই
হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সাদিকীনদের সঙ্গি হয়ে যাও। পীর-বুযুর্গরা হলেন সাদিকীনদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সংস্পর্শে গেলে ইমানের কাইফিয়তে পরিবর্তন আসে। অন্তর আল্লাহমুখো হয়। এখন কারো যদি না-হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিজের একিনে কমজুরি আছে, আর না-হয় পীর ঠিক না। মানে পীর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত নন। ভ্যাজাল আছে।
পীর-বুযুর্গ তথা সাদিকীনদের সংস্পর্শে গেলে কী হয়, বুঝবার জন্য সহজ একটা উদাহরণ দিই।
-আপনি বাইরের প্রচণ্ড গরম থেকে বাসায় ফিরেছেন। তখন আপনার শরীরটাকে ফ্যান বা এসির কাছে নিয়ে গেলে শরীরটা শীতল হয়ে যায় না?
-কনকনে ঠাণ্ডা থেকে ঘরে গেছেন। শরীরটাকে হিটারের কাছে নিয়ে গেলে হিটারের তাপে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় না?
ঠিক এই কাজটাই হয় হক্কানি আল্লাহওয়ালা পীর-বুযুর্গদের কাছে গেলে। তাদের ইমানের তার এবং শীতলতা আশেপাশের মানুষকেও প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে আল্লামা রূমীর বহুল আবৃত একটি কবিতা সামনে রাখা যায়।
এক যামানা সহবতে বা আউলিয়া,
বেহ্তর আজ সদ সালা তোয়াআত্ব বে-রিয়া।
(ওলি আল্লাহদের সংষ্পর্শে কিছু মুহূর্ত কাটানো শত বছর খালিস ইবাদত থেকেও উত্তম। )
মুফতী মুহাম্মদ শফি হাকিমুল উম্মত থানবীকে প্রশ্ন করলেন, ‘হযরত, কবি যে দাবিটি করলেন, এটা কি ঠিক’?
থানবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জবাব দিলেন, ‘পুরা ঠিক নেহি। দর আসল শায়েরনে সহবতে আউলিয়াকো কুচ কম কর দিয়া। সদ সাল নেহি, লাঁকো সাল বুলনা চাহিয়ে থা। কেঁউকে ইবাদতসে জান্নাত মিলতি হে আর সহবতে আউলিয়াসে মালিকে জান্নাত।
তিন
আমরা মুসলমান। আমরা ইমানদার কিন্তু ইমানের কী অবস্থা? কখনও ওজন করে দেখেছি ভেতরে ইমানের পরিমাণ কতো? চলুন কাজটা করতে শুরুকরি।
ফর্মূলা নং ওয়ান।
একটু একা হয়ে, একটু নিরিবিলি পরিবেশে, সবচে ভালো হয় রাতের শেষভাগটায়; কিছুক্ষণ আল্লাহর জিকির করি। যদি ভালো লাগে, মনে যদি প্রশান্তি আসে, তাহলে আমি মুমিন। আমার ইমান ভালো আছে। ফর্মূলা সূত্র: আলা বিজিকরিল্লাহি তাত্বমাইন্নুল কুলুব। আল্লাহর জিকিরের মাঝেই মনের শান্তি, অন্তরের সান্ত¡না।
ফর্মূলা নং দুই
আপনার সামনে কেউ আল্লাহর কথা বলছে। আল্লাহকে স্মরণ করা হচ্ছে। দেখুন আপনার অন্তর কেঁপে উঠে কিনা। মনের মধ্যে গিয়ে ধাক্কা লাগে কিনা। আল্লাহর ভয়ে আপনি জবুতবু হয়ে যান কিনা। যদি হয়, যদি যান, তাহলে আপনার ইমান সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। ফর্মূলা সূত্র: ইন্নামাল মু’মিনুনাল্লাজিনা ইজা জুকিরাল্লাহু ওয়াজিলাত কুলুবুহুম।
ফর্মূলা নং তিন
কেউ আপনার সামনে কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করছে। অনুভব করতে চেষ্টা করুন আপনার ইমানের অবস্থা কী। বাড়ছে না কমছে। তেলাওয়াত শুনলে যদি ভাল লাগে, ভেতরে গোনাহের প্রতি ঘৃণা এবং নেককাজের আগ্রহ টের পান, আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা ঐকান্তিক হচ্ছে টের পান, তারমানে আপনার ইমানের গতি বাড়ছে। সুতরাং আপনি একজন খাঁটি মুমিন। ফর্মূলা সূত্র: ওয়াইজা তুলিয়াত আলাইহিম আ-ইয়া-তুহু জাদাতহুম ইমানা।
আরো অনেক ফর্মূলা আছে। সেগুলো অ্যাপ্লাই করা যায়। কাজটি আমাদের করা উচিত। শুধু শুধু মুসলমান দাবি করে বসে থাকলে তো আর হলো না। ভেতরে ইমানের গতি-প্রকৃতি-পরিমাণ যাচাই করা দরকার।
চার
‘জিকির এতবেশি করো, এতোবেশি করো এবং এতবেশি করো যে, লোকে তোমাকে পাগল বলতে শুরু করে’- কথাটি আমি যদি এভাবে বলি, তাহলে অনেকেই ভাববে, নিশ্চই এই ব্যাটা চরমোনাইর মুরিদ হয়েগেছে। না হলে এভাবে বলত না।
আসলে কথাহল, আমাদের সুঁচ ও ফিকির, চিন্তা ও চেতনা সংকীর্ণ হতে হতে এতবেশি ছোট হয়ে গেছে যে, কাউকেই এর ঊর্ধ্বে ভাবতে পারি না। কেউ যখন তার নিজের মতো করে কিছু বলে, হতে পারে সেটা কারো পক্ষে যাবে, অথবা কারো বিপক্ষে। তারমানে সে পক্ষের হয়েগেল?
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাথেও আমার সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক নাই। কখনও রাজনীতির সাথে জড়ানোর ইচ্ছা নাই বলে আগামীতেও সম্ভাবনা নাই। ইসলামীদলগুলোর প্রতি এমপিতি এবং সিমপিতি, ভালো কাজের প্রশংসা, ভুলের সমালোচনা; তাতেই আমি সন্তুষ্ট। কাজটি কোনো দলের সমর্থক বা কর্মী হলে আর সম্ভব হয় না।
কথাটি এর আগেও বলেছি আমি। কোনো না কোনো ইসলামী দলের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলে তাঁর চোখে এক ধরনের পর্দা পড়ে যায়। কুরআনের ভাষায় যাকে বলা যায় গিশাওয়াহ্। তখন আর নিজ দলের দুর্বলতা আর চোখে পড়ে না। রাজনৈতিক মুরব্বীদের মুখ থেকে কোনো ভুল কথা উচ্চারিত হলেও একশ একটা যুক্তি খাড়া করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করাহয় এরচে খাঁটি কোনো বাণী আল্লাহর জমিনে এর আগে আর কেউ দেয়নি!
পাঁচ
কথা শেষকরি। চরমোনাইর মাহফিলগুলোতে মাঝেমধ্যে জাকিরিনদের মধ্যে এক ধরণের পাগলামী লক্ষ করা যায়। কেউ লাফালাফি শুরু করে। কেউ বাঁশ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। কাজটি শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে কতটা কী, এটা বড় বড় উলামায়ে কেরাম এবং মুফতিয়ানে এজামই বলবেন। আমি আজকের আগে কখনও বিষয়টি নিয়ে ইতিনেতি কোনো মন্তব্যই করিনি। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবদের কেউকেউ নক করতো। বলতো, বিষয়টা নিয়ে কিছু লিখেন না কেন? আমি বলতাম সবকিছু নিয়ে সবাইকে লিখতেই হবে- এটা কে বলেছে। কথাটি বলে আসলে পার পাওয়ার চেষ্টা করতাম আমি। আমি মন্তব্য করতে রাজি হতাম না অন্য কারণে। কখনও কারণটি বলিনি। আজ বলেই ফেলি।
এভাবে জিকিরের সময় লাফালাফিকে এককথায় পাগলামীও বলা যায়। আর এই পাগলামী যদি ফানাফিল্লাহ পর্যায়ে গিয়ে হয়, অর্থাৎ জিকিরের মধ্যে ডুবে গিয়ে কেউ যদি কী করছে সেটা না বুঝেই এমন করে, তাহলে সেটার অনুমতি শরিয়তে আছে কিনা- বাংলাদেশের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম থেকে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য আমার নজরে পড়েনি। যে কারণে কাজটিকে সমর্থন করে কিছু বলিনি।
আবার নবিজির একটি হাদিস যখন মনেপড়ে, তখন এটি নিয়ে সমালোচনা করতেও ভয় হয়। কে কোন অবস্থায় কী করছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেটাকে কীভাবে নিচ্ছেন, আমি তো জানি না। তাহলে কী বলব?
হযরত আবু সাইদ খুদরি রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসটি উদ্ধৃত করে এবং সাথে কোনো মন্তব্য বা মতামত জুড়ে না দিয়েই আমার কথা শেষ করছি। নবিয়্যে কারিম আলাইহিত তাহিয়্যাতু ওয়াত তাসলিম বলেছেন,
أَكْثِرُوا ذِكْرَ اللهِ حَتَّى يَقُولُوا : مَجْنُونٌ
জিকির এতবেশি করো যে, লোকে তোমাকে পাগল বলতে শুরু করে’।
সূত্র: মুসনাদে আবু ইয়া’লা ২/৫২১, ইবনে হিব্বান ৩/৯৯, আল মুসতাদরাক লিল হাকিম ১/৬৭৭।)