জাতির পিতা ইবরাহীমের সময় থেকেই রজব সম্মানিত
একুশে জার্নাল ডটকম
মার্চ ১৪ ২০১৯, ১৬:৪৬

আশরাফ আলম কাসেমী
মক্কার মানুষ নিজেদেরকে ইব্রাহিম আ. এর ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করত। যদিও তাঁরা এতে অনেক রদ বদল করে রেখেছিল। মনগড়া অনেক কুসংস্কার এর জন্ম দিয়েছিল এবং একত্ববাদের পরিবর্তে কাবা ঘরে মূর্তি স্থাপন করে পূজা করাকেও দ্বীন মনে করতো। তথাপি স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষ এমন ছিল যারা এসব কুসংস্কার ও একত্ববাদের পরিপন্থী কোন ধরণের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিল না। আবার যারা এসব কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল তাদের মধ্যেও ইব্রাহিম আ. এর ধর্মের বেশ কিছু বিধান অবশিষ্ট ছিল, যা তাঁরা খুব সম্মানের সাথে পালন করে চলত। তন্মধ্যে একটি ছিল কুরআনে বর্ণিত চারটি মাসের তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এতে যে কোন প্রকার যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। চারটি মাস ইব্রাহিম আ. এর ধর্মে বেশ কিছু কারণে বিশেষ সম্মানিত ছিল। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِى كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ مِنْهَآ أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلْقَيِّمُ
অর্থ- নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সূরা তাওবা)
মক্কার কুরাইশ গোষ্ঠী হযরত ইব্রাহীম আ. এর বংশধর ছিল। তাঁরা দ্বীনে ইব্রাহিম আ. এর কথা বেশি আলোচনা করত। কিন্তু সেই দ্বীনকে বশ করে রেখেছিল নিজেদের প্রবৃত্তি ভিত্তিক। যা তাদের মন চাইত তাই দ্বীন মনে পালন করত। এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়াকে বড় অপরাধ মনে করলেও এর বিন্যাসে নিয়ে এসেছিল চরম পরিবর্তন। নিজেদের প্রবৃত্তি মিটাতে নির্বাচিত মাসের পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মাসকে সম্মানিত মনে করত। কখনও কখনও মাস আগে পিছেও নিয়ে আসত। তাদের এই রদবদলের কর্মটিকে আল্লাহ তায়ালা এভাবে চিত্রায়ন করেছেন-
إِنَّمَا ٱلنَّسِىٓءُ زِيَادَةٌ فِى ٱلْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ يُحِلُّونَهُۥ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُۥ عَامًا لِّيُوَاطِـُٔوا۟ عِدَّةَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ فَيُحِلُّوا۟ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوٓءُ أَعْمَٰلِهِمْ وَٱللَّهُ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلْكَٰفِرِينَ
অর্থ- এই মাস পিছিয়ে দেয়ার কাজ কেবল কুফরির মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে কাফেরগণ গোমরাহিতে পতিত হয়। এরা হালাল করে নেয় একে এক বছর এবং হারাম করে নেয় অন্য বছর, যাতে তারা গণনা পূর্ণ করে নেয় আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসগুলোর। অতঃপর হালাল করে নেয় আল্লাহর হারামকৃত মাসগুলোকে। তাদের মন্দকাজগুলো তাদের জন্যে শোভনীয় করে দেয়া হল। আর আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সূরা তাওবা)
সম্মানিত এই চারটি মাসের তাৎপর্যের বর্ণনা একাধিক হাদিসেও এসেছে, বিদায় হজ্বের ভাষণকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন,
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” الزَّمَانُ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ، السَّنَةُ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلَاثَةٌ مُتَوَالِيَاتٌ : ذُو الْقَعْدَةِ، وَذُو الْحِجَّةِ، وَالْمُحَرَّمُ، وَرَجَبُ مُضَرَ الَّذِي بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ “.
আবূ বাকরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ যে দিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা’দাহ, যূল-হিজ্জাহ ও মুহাররম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব-ই-মুযারা যা জুমাদা ও শা’বান মাসের মাঝে অবস্থিত। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৯৭)
(মুযারা একটি সম্প্রদায়ের নাম। ‘আরবের অন্যান্য সম্প্রদায় হতে এ সম্প্রদায়টি রজব মাসের সম্মান প্রদর্শনে অতি কঠোর ছিল। তাই এ মাসটিকে তাদের দিকে সম্বন্ধ করে হাদীসে “রজব-মুযারা” বলা হয়েছে।)
আরববাসী একাধারে যি-কাদাহ, যিল-হিজ্জাহ ও মুহররম পরস্পরে থাকা এই তিনটি মাসে হজ্ব পালনের জন্য আসা যাওয়ায় ব্যস্ত থাকত এবং রজব মাসে উমরা করার জন্য আসত। তাই পরস্পরে যুদ্ধ-বিগ্রহকে এই মাসগুলোতে স্থগিত রাখত। যদি একান্তই যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেত। তখন মাসগুলোর বিন্যাস পরিবর্তন করে দিত।
উপরের আয়াত এই হাদীস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মক্কার কুরাইশ গোষ্ঠী নিজেদের পক্ষ থেকে মাসগুলোর বিন্যাসের ক্ষেত্রে আগে পিছে করে রেখেছিল। কিন্তু ১০ হিজরী সনে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ হজ্ব পালন করতে মক্কায় আগমণ করেন, তখন মুশরিকদের কর্তৃক বদলে দেওয়া বিন্যাসের পরিবর্তে সেই মূল বিন্যাসের দিকে ফিরিয়ে আনেন যা সৃষ্টিলগ্ন থেকেই চলে আসছিল।
আর যখন রজবের মাস আগমণ করত তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দোয়াটি পড়তেন,
اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان
হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শাবানের পরিপূর্ণ বরকত দান করুন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।
উল্লেখিত এই চারটি মাসে যেমন হযরত ইব্রাহীম আ. এর ধর্মে যুদ্ধ বিগ্রহ করা নিষিদ্ধ ছিল। তেমনি ভাবে ইসলামেও এর ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
يَسْـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلشَّهْرِ ٱلْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ وَكُفْرٌۢ بِهِۦ وَٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِۦ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ ٱللَّهِ وَٱلْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ ٱلْقَتْلِ
অর্থ- সম্মানিত মাস সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারামের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহাপাপ।
এই মাসগুলোতে রাস্তা-ঘাট নিরাপদ থাকার কারণে মানুষ নির্ভয়ে হজ্ব ও উমরাহ পালন করতে মক্কায় আগমণ করত ও নিরাপদে আপন আপন অঞ্চলে ফিরে যেত। হজ্বযাত্রীদের উপর কেউ আক্রমণ করবে বা তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যাবে এমন কোন ভয়-ভীতি কাজ করত না।