জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ
একুশে জার্নাল
মার্চ ২৫ ২০২০, ২১:০১
মহান স্বাধীনতা দিবস এবং মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রায় ২৩ মিনিটের এই ভাষণে তিনি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি পাঠকদের জন্য এখানে হুবহু তুলে ধর হলো:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় দেশবাসী।
আসসালামু আলাইকুম।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি ভাইবোনদেরও জানাই শুভেচ্ছা।
মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশি রাষ্ট্র এবং জনগণ আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন, আমি তাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
আজকের এই দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি আমাদের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন।
শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতীয় চার নেতার প্রতি। স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের জানাচ্ছি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের শুভেচ্ছা।
১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি উপর গণহত্যা শুরু করে। আমি ২৫-এ মার্চের গণহত্যার শিকার সকল শহীদকে স্মরণ করছি।
আমি স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার আমার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ভাই – মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ও দশ বছরের শেখ রাসেল – কামাল ও জামালের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদকে।
প্রিয় দেশবাসী,
এবারের স্বাধীনতা দিবস এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গোটা বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। ধনী বা দরিদ্র, উন্নত বা উন্নয়নশীল, ছোট বা বড় – সব দেশই আজ কমবেশি নভেল করোনা নামক এক ভয়ংকর ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশও এ সংক্রমণ থেকে মুক্ত নয়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমরা এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ভিন্নভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জনসমাগম হয় এমন ধরনের সব অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সকল জেলায় শিশু সমাবেশ ইতিমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই কারণে আমরা মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জনসমাগম না করে টেলিভিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার করেছি।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের স্বাধীনতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল। ১৯৪৮-৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়-দফা-১১-দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র নির্বাচনের পথ পেরিয়ে আমরা উপনীত হই ৭১’র ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনাতর সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমগ্র জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম স্তব্ধ করে দিতে ২৫-এ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত হত্যা শুরু করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬-এ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসক তাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি ৯-মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনে।
পাকিস্তানের জেলে ১০-মাস বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর হাতে সময় পেয়েছিলেন তিনি।
প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা, শহীদ পরিবার, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিত মা-বোনদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, তাদের প্রতিষ্ঠিত করা সমস্ত কাজই তিনি করেছিলেন এই সাড়ে তিন বছরে।
জাতির পিতা বলতেন: ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলার মানুষ যেন অন্ন পায়, বস্ত্র পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’
তিনি যখন দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিমগ্ন, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকেরা তাকে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ হত্যা করে। আমরা দুবোন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই।
প্রিয় দেশবাসী,
আমরা জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা তার ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে।
বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশ আজ খাদ্যশস্য, শাক-সবজি-মাছ-মাংস-ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে।
ঢাকায় মেট্রোরেল এবং চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দোরগোড়ায় এখন আমরা। মহাকাশে আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপিত হয়েছে।
গত বছর ৮.১৫ শতাংশ হারে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। চলতি বছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম।
কিন্তু প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস জনস্বাস্থ্যসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক থাবা বসাতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন। আমাদের ওপরও এই আঘাত আসতে পারে।
প্রিয় দেশবাসী,
এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।
গত জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছিল। এটি এখন বিশ্বের ১৯৫টির মধ্যে ১৬৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
গতকাল পর্যন্ত চার লাখ ২২ হাজার আটশোরও বেশি মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৯০৭ জন মানুষ মারা গেছেন। এক লাখ নয় হাজার ১০২ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে প্যানডামিক বা মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি জানি আপনারা এক ধরনের আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। যাদের আত্মীয়স্বজন বিদেশে রয়েছেন, তারাও তাদের নিকটজনদের জন্য উদ্বিগ্ন রয়েছেন। আমি সকলের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু এই সংকটময় সময়ে আমাদের ধৈর্য এবং সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।
এই ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উপদেশ আমাদের মেনে চলতে হবে। আমাদের যতদূর সম্ভব মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে।
যারা করোনাভাইরাস-আক্রান্ত দেশ থেকে স্বদেশে ফিরেছেন, সেসব প্রবাসী ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ – আপনাদের হোম কোয়ারেন্টাইন বা বাড়িতে সঙ্গ-নিরোধসহ যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন।
মাত্র ১৪ দিন আলাদা থাকুন। আপনার পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসী এবং সর্বোপরি দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এসব নির্দেশনা মেনে চলা প্রয়োজন।
কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সহজ হবে। ঘনঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি দিতে হলে রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নেবেন। যেখানে-সেখানে কফ-থুথু ফেলবেন না। করমর্দন বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকুন। যতদূর সম্ভব ঘরে থাকবেন। অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না।
বাইরে জরুরি কাজ সেরে বাড়িতে থাকুন। মুসলমান ভাইয়েরা ঘরেই নামাজ আদায় করুন এবং অন্যান্য ধর্মের ভাইবোনদেরও ঘরে বসে প্রার্থনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আই.ই.ডি.সি.আর-এর হটলাইন নম্বর খোলা হয়েছে। এছাড়া সোসাইটি অব ডক্টরস তাদের ৫০০টি নম্বর উন্মুক্ত করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ঐসব নম্বরে যোগাযোগ করুন। সরকার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা রাখলেও ততটা প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত সিংহভাগ মানুষই কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেন।
তবে, আগে থেকেই নানা রোগে আক্রান্ত এবং বয়স্ক মানুষদের জন্য এই ভাইরাস বেশ প্রাণ-সংহারী হয়ে উঠেছে। সেজন্য আপনার পরিবারের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষটির প্রতি বেশি নজর দিন। তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করুন। তাকে ভাইরাসমুক্ত রাখার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করুন।
আতঙ্কিত হবেন না। আতঙ্ক মানুষের যৌক্তিক চিন্তাভাবনার বিলোপ ঘটায়। সব সময় খেয়াল রাখুন আপনি, আপনার পরিবারের সদস্যগণ এবং আপনার প্রতিবেশীরা যেন সংক্রমিত না হন। আপনার সচেতনতা আপনাকে, আপনার পরিবারকে এবং সর্বোপরি দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখবে।
প্রিয় দেশবাসী,
চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্র বন্দর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনসহ সকল স্থলবন্দরের মাধ্যমে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৫৮ হাজার ৯৮১ জন যাত্রীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে।
জানুয়ারি মাস থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ও দিক-নির্দেশনা প্রদানের জন্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া আরও তিনটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য পৃথক শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঢাকায় ১০ হাজার ৫০টিসহ সারা দেশে ১৪ হাজার ৫৬৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সারাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য ২৯০টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এতে মোট ১৬ হাজার ৭৪১ জনকে সেবা দেওয়া যাবে।
বাংলাদেশে ৮ মার্চ সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসবাহী রোগীর অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩৯ জন করোনাভাইরাসবাহী রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন বয়স্ক ব্যক্তি মারা গেছেন। তারা আগে থেকেই নানা অসুখে ভুগছিলেন। পাঁচজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৩৭ হাজার ৩৮ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এরমধ্যে নয় হাজার ৮৮৫ জনকে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ২৬৭ জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়। তাদের মধ্যে ২৭৭ জনকে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে।
গত ১৯-এ মার্চ থেকে বিদেশ হতে আগত সকল যাত্রীর সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিমান বন্দর হতে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকায় আশকোনা হাজী ক্যাম্প এবং টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
আমরা ইতিমধেই অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দিয়েছি। বিদেশে অবস্থিত আমাদের মিশনগুলোকে কোনো বিদেশি নাগরিককে ভিসা না দিতে বলা হয়েছে।
বিদেশ থেকে যারা আসছেন তাদের তালিকা ঠিকানাসহ জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন আগত প্রবাসীদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করছেন।
প্রিয় দেশবাসী,
আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত ১৩ হাজার পরীক্ষা কিট মজুদ ছিল। আরও ৩০ হাজার কিট শিগগিরই দেশে পৌঁছবে। ঢাকায় আটটি পরীক্ষার যন্ত্র রয়েছে। দেশের অন্য সাতটি বিভাগে করোনাভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলছে।
আমি স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রশাসনের সদস্যবৃন্দকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে একযোগে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বেতার-টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। তবে কেউ গুজব ছড়াবেন না। গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রিয় দেশবাসী,
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে আপনারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন। তবুও আমি কয়েকটি বিষয়ের কথা আবারও উল্লেখ করছি।
দেশের সকল স্কুল কলেজ ও কোচিং সেন্টার গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।
সকল পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
আগামীকাল ২৬-এ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরবারি অফিস বন্ধ থাকবে। কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান এবং হাসপাতালসহ জরুরি সেবা কার্যক্রম চালু থাকবে।
গতরাত থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন, নৌযান এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখবে।
২৪-এ মার্চ থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বলবৎ হয়েছে।
এটি কার্যকর করতে জেলা প্রশাসনকে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ সহায়তা করছেন। আপনারা যে যেখানে আছেন, সেখানেই অবস্থান করুন।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ৫০০ চিকিৎসকের তালিকা তৈরি করেছে যারা জনগণকে সেবা প্রদান করবেন।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে গত ১৫ মার্চ সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণের সঙ্গে আমি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে যুক্ত হই। এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে আঞ্চলিকভাবে সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণের জন্য আমি সার্কভুক্ত দেশসমূহের নেতাদের উদাত্ত আহ্বান জানাই।
সার্কভুক্ত দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়গুলো প্রস্তাবিত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করছে। আমরা একটি যৌথ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাতে বাংলাদেশ ১৫ লাখ ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
যুগে যুগে জাতীয় জীবনে নানা সংকটময় মুহূর্ত আসে। জনগণের সম্মিলিত শক্তির বলেই সেসব দুর্যোগ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেয়েছে। ইতঃপূর্বে প্লেগ, গুটি বসন্ত, কলেরার মত মহামারি মানুষ প্রতিরোধ করেছে।
তবে ওইসব মহামারির সময় বিশ্ব এখনকার ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল না। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ তখন একদেশ থেকে অন্য দেশে বা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতো না।
এ কারণে করোনাভাইরাস দ্রুততম সময়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিরও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই বিশ্ববাসী এ দুর্যোগ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাবে।
এ সংকটময় সময়ে আমাদের সহনশীল এবং সংবেদনশীল হতে হবে। কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই।
দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সঙ্গে সরবরাহ চেইন অটুট রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করবেন না। জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। সর্বত্র বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আমাদের তাদের পাশে দাড়াতে হবে। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ‘ঘরে-ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ছয় মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভাসানচরে এক লাখ মানুষের থাকার ও কর্মসংস্থান উপযোগী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একইভাবে বিনামুল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা ও দেওয়া হচ্ছে।
আমি নিম্নআয়ের মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
আমাদের শিল্প উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই আঘাত মোকাবিলায় আমরা কিছু আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে।
এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যবসায়-বান্ধব বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন মাস পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ঋণ খেলাপি না করার ঘোষণা দিয়েছে।
রপ্তানি আয় আদায়ের সময়সীমা দুই মাস থেকে বৃদ্ধি করে ছয় মাস করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি ব্যয় মেটানোর সময়সীমা চার মাস থেকে বৃদ্ধি করে ছয় মাস করা হয়েছে। মোবাইলে ব্যাংকিং-এ আর্থিক লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাস বিল পরিশোধের সময়সীমা সারচার্জ বা জরিমানা ছাড়া জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এনজিওগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
আজ সমগ্র বিশ্ব এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। তবে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের সরকার প্রস্তুত রয়েছে।
আমরা জনগণের সরকার। সব সময়ই আমরা জনগণের পাশে আছি। আমি নিজে সর্বক্ষণ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।
আমাদের এখন কৃচ্ছতা সাধানের সময়। যতটুকু না হলে নয়, তার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। মজুদ করবেন না। সীমিত আয়ের মানুষকে কেনার সুযোগ দিন।
আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে।
এছাড়া, বেসরকারি মিল মালিকদের কাছে এবং কৃষকদের ঘরে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে। চলতি মওসুমে আলু-পিয়াজ-মরিচ-গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, কোন জমি ফেলে রাখবেন না। আরও বেশি বেশি ফসল ফলান।
দুর্যোগের সময়ই মনুষত্যের পরীক্ষা হয়। এখনই সময় পরস্পরকে সহায়তা করার; মানবতা প্রর্দশনের।
বাঙালি বীরের জাতি। নানা দুর্যোগে-সংকটে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সেগুলো মোকাবিলা করেছে। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনাভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সকলের প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হবো, ইনশাআল্লাহ।
আবারও বলছি: স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সকলে যার যার ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
খোদা হাফেজ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।