জনপ্রিয় বক্তার মূর্খতাপ্রসূত বক্তব্য প্রচার করায় আমরাও দোষী

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৪ ২০২০, ০৪:৩৬

।। আরজু আহমাদ ।।

বুবোনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ ছিল ইউরোপের জন্য একটা ঝড়ের মত। ইউরোপের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সে সময় মাত্র কয়েক বছরে মারা গিয়েছিল।
মুসলিম বিশ্বেও এক তৃতীয়াংশ লোক এতে মারা গেছে। কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত ধীরগতিতে।

এই মহামারীর পর ইউরোপে গীর্জার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। মানুষ ধর্ম বিমুখ হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে শুরু করে, গীর্জা কিম্বা পাদ্রি কেউই তাদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। এটাই ইউরোপে সেক্যুলারিজমের প্রথম পোক্ত ভিত গড়ে দেয়।

ফলে এই সময়টাকে খুব সাবধানে অতিক্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্মের কাজ যা- তার বাইরে ধর্মকে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সে জায়গায় নিলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।

অতি বাক-প্রবণ যথাযথ ধর্মজ্ঞানহীন কতিপয় লেবাসপোরস্তি বক্তাদের ওয়াজের নামে ভাড়ামোতে কান দেবার সময় এটা নয়। বস্তুত শয়তান এদের মাধ্যমে এই দ্বীন থেকে মানুষকে বিমুখ করতে চায়। আর ইসলামকে হাসি-তামাশার বস্তুতে রূপান্তরিত করে।

এদের অহংকারসুলভ মনোভাব আর ইলমহীনতার কারণে শয়তানের পক্ষ থেকে দেখা স্বপ্নগুলোকেও তারা এই সময়ে ইসলামের নামে প্রচার করছে। গল্প করে বেড়াচ্ছে। ইদানীং এরা উপদ্রব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণ মানুষ এসবের কারণে বিভ্রান্ত হবে। কেউ কেউ এইসব মিথ্যার উপর আমল করে কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে ধর্মের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতে পারে।

উমার রা. এঁর আমলে এক বক্তা আয়েশা রা. এঁর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ওয়াজ করত।

আয়েশা রা. তাঁকে নিষেধ করলেও তিনি তা শুনেন নি। এই খবর উমার রা. এঁর কাছে পৌঁছালে তিনি তাকে কড়া ভাষায় ভৎর্সনা করেন। আর জানিয়ে দেন, এরপর এমন কিছু ঘটলে পেটাতে পেটাতে শহর থেকে বের করে দেওয়া হবে।

আল্লামা ফরিদ উদ্দিন আত্তার রহ. লিখেন, আলী রা. ওয়ায়েজদের তাদের মনগড়া কিসসা কাহিনীর জন্য অপছন্দ করতেন। এমনকি এরকম ওয়ায়েজদের বেত্রঘাতের শাস্তি প্রদান করতেন।

জাল হাদীসের অন্যতম উদ্ভাবক ছিল এই পেশাদার ওয়ায়েজরা। এই জন্য এইসব ওয়ায়েজ বা বক্তাদের থেকে কোনও হাদীস গ্রহণ করা হত না। এরা ইসলামি ইতিহাসে গল্পকার হিসেবে অভিহিত হয়েছেন।

আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন রহ. রুসাফাহ নামে এক মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। তখন এক বক্তা তাদের সামনে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ করতে শুরু করলেন।

সে বলতে লাগলো, ‘আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন আবদুর-রাজ্জাকের সূত্রে আমাদের বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রাসুল বলেন…….

এভাবে তিনি বিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক হাদীস বর্ণনা করেন। এটা শুনে আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন পরস্পরের দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকাতে লাগলেন।

ইমাম আহমদ ইয়াহিয়া ইবনে মাঈনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন?’ ইয়াহিয়া জবাব দিলেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম! আমি এই মুহুর্তের আগে এইরকম কিছু কখনও শুনিই নি।’

তাঁরা দুজনে ওয়াজ শেষ হওয়ার আগ অবধি অপেক্ষা করে রইলেন। এরপর ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন সেই বক্তাকে জানতে চাইলেন, ‘আপনার কাছে কে এই হাদীস বর্ণনা করেছে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন।’

তিনি বিস্ময়ের স্বরে বললেন, ‘আমিই ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন আর তিনি হলেন আহমাদ ইবনে হাম্বল। আমরা তো এই হাদীস কখনও শুনিও নি। এ তো সুস্পষ্ট মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়!’

তখন সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আচ্ছা, আপনিই তবে ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন! আমি তো এতদিন কেবল শুনেছি আপনি নির্বোধ। আজকে তো তা নিজে থেকে দেখলাম।

আপনি এমন আচরণ করছেন যেন ইয়াহিয়া ইবনে মাঈন এবং আহমদ ইবনে হাম্বল নামে আর কোনও ব্যক্তি নেই। আমি তো সতেরো জন আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইয়াহিয়া ইবনে মাঈনের থেকে হাদীস শুনেছি।’

তার এই মিথ্যাচারে বিরক্ত হয়ে ইমাম আহমাদ রহ. নিজ হাতে মুখ ঢেকে বললেন, ‘ওর থেকে সরে আসো।’ এটা ছিল সে যুগেই পেশাদার ওয়ায়েজদের ছিল অবস্থা। বর্তমানে ইসলামের এই দু:সময়ে কি পরিস্থিতি তা সহজেই অনুমেয়।

এই যে স্বপ্ন, এই যে নানা কথাবার্তা তা এই ঘটনার আলোকে বিচার করুন। যা হোক, ওয়াজ শোনার বিপক্ষে নই আমি। যদি সম্ভব হয় যোগ্য কারো থেকে শুনুন নতুবা শোনা থেকে বিরত থাকুন, পড়ুন।

তাবেয়ী উবাইদ বিন উমাইরের ওয়াজের মজলিসে খোদ আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বসতেন। আলোচনায় প্রভাবিত হয়ে সেখানেই কাঁদতেন। ৬৮ হিজরীতে মক্কায় তাঁর উবাইদের ইন্তেকাল হয়।

যা হোক, ওয়াজের নামে উদ্ভট এইসব নানাবিধ আলাপচারিতা প্রচারে দুটো শ্রেণি সম্পৃক্ত।

১. যারা এসব কথা বলছে
২. যারা এসব প্রচার করছে।

ভিডিও ধারণ করা, ঠাট্টারছলে এসব ভুল কথাবার্তা সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা, শেয়ার দেওয়া এমনকি ট্রলের মাধ্যমেও প্রচার করার মধ্য দিয়ে মূলত তাদের শ্রোতা বৃদ্ধি করে শয়তানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা নিজের অজান্তেই শামিল হচ্ছি।

আমাদের উচিত ছিল আমরা এসব তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করব। কিন্তু এর বদলে আমরা এসবের প্রচার সহযোগী হচ্ছি। আমাদের জন্যই এরা মোস্ট ভিউয়েড। মনে রাখতে হবে, এইটুকুনের জন্যও বিচারের দিন আমাদের আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।