চোগলখোরী আচরণ সামাজিক বন্ধনের প্রতিবন্ধক
একুশে জার্নাল ডটকম
জানুয়ারি ১৭ ২০১৯, ১৩:৫৯
প্রযুক্তির বিকাশ আমাদেরকে উন্নতির দিকে ধাবিত করলেও এই প্রযুক্তি মানুষকে মনের দিক দিয়ে করে দিয়েছে একেবারেই সঙ্কীর্ণ! ফেসবুকে নামে-বেনামে ফ্যাক আইডি খুলে ব্যক্তি ও পরিবারের উপর নগ্ন আক্রমণ দেখে সচেতন মহল লজ্জা বোধ করছে। ফ্যাক আইডি খুলে অপরের সম্মানহানি করতেছে সংঘবদ্ধ একটা গোষ্ঠী; আর সন্দেহের তীর চলে যাচ্ছে এমনসব লোকের প্রতি, যাদের এগুলোর সাথে নূন্যতম সম্পর্ক নেই এমনসব নিরপরাধ ব্যক্তির প্রতি। এর দ্বারা তৃতীয়পক্ষ মধ্যখান থেকে ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে, তৃতীয়পক্ষ তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করতেছে ঠিকই কিন্তু অযথা নির্দোষ দুইটা পক্ষের মধ্যে বিবাদ তৈরী করতে নীরবে সাহায্য করতেছে। এটাকে বলে ডিজিটাল মোনাফেকি! যারা এসব করতেছেন তাদের প্রতি কড়জোড়ে নিবেদন, আপনারা এসব বন্ধ করুন!
মূলত মনোমালিন্যের উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যের কাছে লাগানোকেই ইসলামের পরিভাষায় চোগলখুরি বলে। ইসলামে এমনকি সামাজিক শিষ্টাচারেও চোগলখুরি আচরণ সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্যের কাছে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে দুনিয়াবী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে যে লোক একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলে বেড়ায়; সে হচ্ছে চোগলখোর। এরা সমাজ ও দেশের শত্রু।
ফেতনা-ফাসাদ ও অসন্তষ্টি সৃষ্টির লক্ষে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলে বেড়ানোই হচ্ছে চোগলখুরি। চোগলখুরীর কারণে মানুষের মাঝে মতপার্থক্য তৈরী হয়। পরস্পরের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যায়। পারস্পরিক শত্রুতা তৈরী হয়। হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিমুখী কথাবার্তাকে চোগলখুরি বলে। যারা এজাতীয় কথা বলে বেড়ায়, তাদের চোগলখোর বলে। অর্থাৎ দ্বিমুখী স্বভাব যাদের ভেতরে বিদ্যমান, তাদেরই চোগলখোর বলে। এখন সবখানেই চোগলখোর ব্যক্তির উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্বিমুখীর কারণে তাদেরকে সহজে চেনা যায় না; কিন্তু ব্যক্তির অজান্তে তারা মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করছে, যা ব্যক্তি টেরও পায় না। সাময়িক স্বার্থ উদ্ধার করতে চোগলখোর লোকেরা চোগলখুরি করে থাকে। শুধু সাধারণ মানুষই নয়; আলেম-গাইরে আলেম বেশির ভাগ মানুষই এই নিন্দনীয় কাজের সাথে সম্পৃক্ত। চোগলখোর ব্যক্তিরা সমাজে সবচেয়ে বেশি ফেতনা, বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য সৃষ্টি করে।
আল্লাহ বলেন, “সে ব্যক্তির অনুসরণ করো না, যে কথায় কথায় শপথ করে, সে লাঞ্ছিত, যে অসাক্ষাতে নিন্দা করে, যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগায়।” [সুরা আলা কালাম ১০ -১১]
রাসুল সঃ বলেছেন, “চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” [বুখারি, মুসলিম]
বর্ণিত আছে যে, একবার রাসুল সাঃ দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “এ দুটি কবরের অধিবাসীরা আযাবরত অবস্থায় ভুগছে। কিন্তু কোন বড় ধরণের গুনাহের জন্য তারা শাস্তিতে ভুগছে না। একজন পেশাব করার পর ভালোভাবে পবিত্রতা অর্জন করতো না এবং আরেকজন জীবিতাবস্থায় মানুষ্য সমাজে চোগলখুরি করে বেড়াত।“ এরপর রাসেল সাঃ খেজুরের দু’টি কাঁচা ডাল নিয়ে উভয়ের কবরে একটি করে গেড়ে দিয়ে বললেন, “ডাল দু’টি না শুকানো পর্যন্ত হয়তো এদের শাস্তি কম হবে।”
এ হাদীসে, “কোন বড় ধরণের গুনাহের জন্য তারা শাস্তিতে ভুগছে না” এ উক্তির অর্থ একটাই, তাদের ধারণায় তাদের কৃত গুনাহ তেমন বড় ছিল না। এজন্য কোন কোন বর্ণনাতে রয়েছে, রাসুল সাঃ বলেছেন, “তবে অবশ্যই তা কবীরা গুনাহ ছিল”।
রাসুল সাঃ বলেছেন, “তোমরা সবচেয়ে অধম লোক দেখতে পাবে সেই ব্যক্তিকে, যে বিভিন্ন জনের কাছে গিয়ে নিজেকে বিভিন্নভাবে বা বিভিন্ন আকারে প্রকাশ করে। আর যে ব্যক্তি পৃথিবীতে দ্বিমুখী আচরণ করবে; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে দু’টি আগুনের জিহ্বা দিবেন।” [বুখারি,মুসলিম] দ্বিমুখী আচরণ দ্বারা এই হাদীসে দু’জনের সাথে দু’ধরণের কথা বলার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে।
আবু হুরায়রা রাঃ বলেছেন, ”দ্বিমুখী লোক বলতে সাধারণত চোগলখোরকে ধরে নেয়া হয়, যে ব্যক্তি একজনকে গিয়ে বলে; অমুক তোমার সম্পর্কে এমন কথা বলেছে। সংশ্লিষ্ট দু’পক্ষের যেকোন পক্ষ অথবা তৃতীয় কোন পক্ষ যে গোপনীয় বিষয় অপছন্দ করে তা প্রকাশ করা। প্রকাশিত ব্যাপারটি কারো কথা, কাজ বা কোন দোষ ত্রুটি যাই হোক না কেন। অতএব চোগলখুরি হচ্ছে; সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কেউ বা তৃতীয় কেউ অপছন্দ করে এমন তথ্য ফাঁস করা। মানুষের যে অবস্থা দৃষ্টিতে পড়ুক না কেন, তা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করায় যদি কল্যাণ না হয় এবং এর দ্বারা সমাজকে কোন গুনাহ থেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত।”
কোন কোন তাফসীরকার সূরা লাহাবের যে স্থানে আবু লাহাবের স্ত্রীকে “হাম্মালাতাল হাতাব” (জ্বলন্ত কাঠ বহনকারী) বলা হয়েছে, এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সে ছিল একজন চোগলখোর। চোগলখোরি স্বভাবটাকে কাষ্ঠ বলা হয়েছে; কেননা কাঠ যেমন আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে, তেমনি চোগলখোর দু’জনের মধ্যে বিবাদের প্ররোচনায় অধিক পরিমাণে সাহায্য করে থাকে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাবধান! আমি তোমাদেরকে জানাচ্ছি চোগলখুরি কী? এ হচ্ছে কুৎসা রটনা করা; যাতে মানুষের মাঝে বৈরিতার সৃষ্টি হয়। তিনি আরো বলেছেন, কোনো ব্যক্তি সত্য কথা বলতে বলতে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়; আবার কেউ মিথ্যা বলতে বলতে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।’
রাসুল সঃ বলেছেন; ‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে খারাপ লোকদের দলভুক্ত হিসেবে ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পাবে; যে ছিল দু’মুখো- যে এক জনের কাছে এক কথা আরেক জনের কাছে আরেক কথা নিয়ে হাজির হত।’ (মুসলিম)
চোগলখুরির মতো নিকৃষ্ট অভ্যাসের কারণে আমাদের পারিবারিক জীবনে অশান্তি বিরাজ করছে। কর্মস্থলে কর্মী এবং দায়িত্বশীলদের মাঝে বিরূপ মনোভাবও তৈরি হচ্ছে এই চোগলখুরির কারণে।
যদিও চোগলখোর লোক সাময়িকভাবে তার কর্মকাণ্ডে কর্তাব্যক্তি বা দায়িত্বশীলদের কাছে আস্থা অর্জন করে থাকে কিন্তু তা ওই ব্যক্তির দুনিয়া এবং পরকালে জন্য মহাক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে সেটা সে ঠাহরই করতে পারতেছে না। দুনিয়াতে এসব লোক চোগলখোর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে লাঞ্ছিত ও ধিকৃত হয় এবং পরকালে তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়।
এজন্যই ইসলামে চোগলখুরি করা হারাম এবং এটা বড় গোনাহের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব আচরণ জান্নাতের জন্য অন্তরায় বলে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। সুতরাং জীবনের সকল পর্যায়ে চোগলখুরি স্বভাব পরিহার করা প্রত্যেক লোকের জন্য একান্ত কর্তব্য।
চোগলখোরের কার্যক্রম শয়তানী কার্যক্রম অপেক্ষাও অধিক ক্ষতিকর। কেননা, শয়তানী কার্যক্রম সংঘটিত হয় “ওয়াস ওয়াসার” মাধ্যমে, আর চোগলখুরির কার্যক্রম চলে সম্মানহানির মাধ্যমে।
আল্লাহ্ পাক এসব কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের সবাইকে বিরত রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন।