চরম দুর্ভোগে কুড়িগ্রামের বানভাসিরা, খাবার ও পানির সংকট 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২১ ২০২২, ১৫:০৭

রোকন সরকার, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: রাবেয়া বেগম (৩৭) ও রমজান আলী (৪৫)দম্পতি তাদের পাঁচ সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধে।সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেলো কচু ও কাঁঠালের বিচি রান্না করছেন রাবেয়া বেগম।কথা হলে তিনি জানালেন, চারদিন ধরে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া নাই।আজ ছেলেমেয়েদের জন্য কচু ও কাঁঠালের বিচি দিয়ে তরকারি ও ভাত রান্না করছি।বৃষ্টিতে ভিজে কোনরকমে এগুলো করছি।

চারদিন পর সন্তানদের জন্য কচু ও কাঁঠালের বিচি রান্না করছেন রাবেয়া বেগম। ছবি; একুশে জার্নাল

রমজান আলী জানালেন,বন্যা হওয়ায় ব্যাংমারার চর ডুবে যাওয়ায় এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি। দিনমজুরি করতাম। বন্যা ও বৃষ্টির কারণে কাজ নাই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। এখন পর্যন্ত কেউ খোঁজ নেয়নি। কোন সহায়তাও পাইনি।

রমনার এই বাঁধে বেশকিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকেই ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ও নদ দ্বারা বেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল ব্যাংমারার বাসিন্দা। তারা জানালেন বাড়িঘরে পানি থই থই করছে।অনেকের বাড়িঘর ডুবে গেছে। ব্যাংমারার চরে তিনশত পরিবারের বসবাস। তবে এই বন্যায় যে যেখানে পেরেছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কয়েকদিনের পানিবন্দী অবস্থায় শুকনো খাবার, চিড়া, মুড়ি খেয়ে দিন কাটছে তাদের। কাজকর্ম না থাকায় তারা শোচনীয় অবস্থায় পড়েছেন।

কোনরকমে চালা তুলে আশ্রয় নিয়েছেন। সাথে রেখেছেন শেষ সম্বল গবাদি পশু। শুধু নিজেদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট নয় গবাদি পশুর খাবার নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন তারা। স্যানিটেশন সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নারীরা।

এমন দুর্ভোগের চিত্র শুধু রমনা ইউনিয়নে নয়, জেলার ৯ টি উপজেলার চিত্রই এমন। তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে জেলার অনেক জায়গায় এর থেকেও অবস্থা শোচনীয়।

ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের শতাধিক দুর্গম চর ডুবে গেছে।সেখানকার বাসিন্দারা পড়েছেন চরম বিপাকে।দুর্গম চরাঞ্চলের অনেক পরিবার নৌকা ও বাঁশের মাঁচায় আশ্রয় নিয়ে দিন পার করছে। পানির তোড়ে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ার আতঙ্কে অনেকেই ঘর-বাড়ি ভেঙে নিয়ে উঁচু স্থানে তুলে রাখছেন।নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এসেছেন আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ ও বিদ্যালয়ে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, এক হাজার দুইশ বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া নদী ভাঙন এবং পানির তোড়ে আরাজিপাড়া, রলাকাটা ও চর যাত্রাপুরের ৬০ পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে।প্রশাসনের পক্ষ হতে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বাঁধে চালা তুলে গবাদি পশু সহ আশ্রয় নিয়েছেন বানভাসিরা। ছবি: একুশে জার্নাল

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, আমার ইউনিয়নের মশালের চর ও পূর্বমশালেরসহ সবমিলে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। এরমধ্যে কিছু পরিবার ফকিরের চরে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও আশ্রয়কেন্দ্রটিও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহায়তা পাইনি।

চিলমারীর রমনা ইউনিয়নের চড়ুয়া পাড়া চরের বাসিন্দা মমতাজ, রহিমা, ফুলমালা, লিপি বেগম জানালেন, বাড়িঘরে পানি থাকায় কোন উপায় নাই।পাঁচটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন বজরা দিয়ারখাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।চারদিন খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন। গতকাল রাতে একটি চুলা কিনে এনে কোন রকমে রান্না করে খেয়েছে পরিবার পাঁচটি। এখন পর্যন্ত পাননি কোন সহায়তা। বন্যায় দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে কষ্টে কেঁদে ফেলেছেন তারা

চিলমারীর রমনা বাঁধে আশ্রয় নেয়া নুর মোহাম্মদ (৩৮) ইসলাম, হোসেন (৬০), সাজু মিয়া(৪০), রফিকুল ইসলাম (৪০), হোসেন আলী (৬০)সহ অনেকে বলেন, পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি। বাড়িঘরে এক কোমর পানি ,থাকা, খাওয়ার কষ্টে আছি। কাজকর্ম নেই সন্তানদের কি খাওয়াই। হালোয়াত ও ঋণ করে কোনরকমে চলছি।এখন পর্যন্ত সহায়তা পাইনি।

রমনা উত্তর পাড়া আম্বার আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন লাভলী বেগম ও জরিনা বেগম সহ কয়েকজনের পরিবার।

রমনা মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম আশেককে কল দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেন নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা গেছে,রোববার (২১ জুন) সকাল ৬ টায় ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি কমে গিয়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে জেলা সিভিল সার্জন বন্যায় এ পর্যন্ত ২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।সরকারি আবাসনে থাকা দেয়াল চাপায় আজ একজনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় ১৪৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।

ডুবে গেছে জেলার ১৪৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছবি: একুশে জার্নাল

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যা কবলিতদের জন্য ৯ উপজেলায় ২৯৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১১ লাখ টাকা, শুকনো খাবার ১ হাজার প্যাকেট, ১৭ লাখ টার শিশু খাদ্য ও ১৯ লাখ টাকার গো-খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলার রৌমারী, রাজিবপুর ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাকি উপজেলাগুলোতেও দ্রুত শুরু হবে।