গল্প: আজ নীলার বিয়ে -ফাতেমাতুয যাহরা স্মৃতি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৫ ২০২২, ১৪:৫৪

আজ নীলার বিয়ে
ফাতেমাতুয যাহরা স্মৃতি

নীলা কিচেনে চা বানাচ্ছে। চামচের টুংটাং শব্দের সাথে তার নীল চুড়ির রিনিঝিনি আবীরের মনে অদ্ভুত ভালোলাগার সৃষ্টি করেছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মায়াবতীটাকে খুব বেশি ভালবাসতে, কিন্তু এ মূহুর্তে তা সম্ভব নয়…

আবীবের প্রতিটি সকাল শুরু হয় মায়াবতীর মায়াবী সুরেলা কন্ঠ শুনে। সে চা নিয়ে এক্ষুণি আসবে। কণ্ঠে পৃথিবীর সকল মায়া নিয়ে ওকে ডাকবে। ডাক শুনে সে ধড়ফড় করে জেগে উঠবে। তারপর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে কিছুক্ষণ।

রূপবতী নীলার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে হাজার বছর – এত্ত রূপবতী মেয়েটি তার বউ, তার ভালোবাসার মানুষ। যাকে ইচ্ছে করলেই ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে, ভালোবাসা যাবে, ভালোবাসতে বাসতে সুখের অতল গহীনে সাঁতার কাটা যাবে। নিজের সৌভাগ্য ও সফলতায় তার দু’চোখে দেখা দিলো আনন্দাশ্রু…

মোবাইলের এলার্মের বিশ্রী রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেলো আবীরের। তাকিয়ে দেখলো- সে শুয়ে আছে রেবেকা খালার ঘরে। কোথায় নীলা! কোথায় তার মায়াবী কন্ঠ! কোথায় প্রিয়তমার মমতা মেশানো ধোঁয়া ওড়া চা!

খুব ছোট বেলায় একটা সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর চাচা-গৃহে আশ্রয় হয় তার। মেট্রিক পাশের পরই হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা যান চাচা। দ্বিতীয় বারের মত আবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে সে। দজ্জাল চাচীর অত্যাচারে জীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন আপন খালা শরীফা বেগম।

খালার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, খালু ছোটখাটো ব্যবসা করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। “অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়” প্রবাদটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেন সে।

নিজেদের‌ই থাকার জায়গা নেই, উটকো ঝামেলা হিসেবে আবির্ভূত হলো সে। তার ঠাঁই হলো স্টোর রুমের মত অন্ধকার একটা ঘরে। ঘরের ভেতর ঢুকলেই অটোমেটিক মৃত্যুর কথা মনে পড়বে যে কারোর। এত অন্ধকার আর গরম যে, কয়েক সেকেন্ড অবস্থান করলেই মনে হবে- সে এই পৃথিবীর বাসিন্দা নয়, শুয়ে আছে সাড়ে তিন হাত মাটির নীচে অন্ধকার কবরে।

সকালে ঘুম ভাঙে এলার্মের কর্কশ শব্দে। তারপর নিয়ম করে ইন্টারভিউ দেয়া যেন তার জন্য ফরয কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতে ঘরে ফিরে ডাল, আলু বা নিরামিষ টাইপের কিছু অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেলা।প্রতিদিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত সে… রুটিন মাফিক একগুয়ে জীবন! ভাল্লাগে না আর!

একটা চাকরি পাওয়া আর যুদ্ধ করে এই পৃথিবী জয় করা তার কাছে একই কথা।চাকরিটা পেলেই নীলা নামের অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটা চিরকালের জন্য তার হয়ে যাবে।

চোখ ভর্তি জল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে নীলা। শুনো! আর কোন অজুহাত শুনতে চাই না আমি। যেভাবেই পারো একটা চাকরি ম্যানেজ করো। আমি আর পারছি না। আর কতো বিয়ে ভাঙবো আর কত অপছন্দের কথা বলবো। ‌ড্যাডি বলেছেন – এবারের সমন্ধটা কখনোই ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। পাত্র যেমন যোগ্য, তেমন সুন্দর। এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া করা যাবে না কখনোই।

প্লিজ! কিছু একটা করো।‌ ড্যাডি আমাকে খুব ভালোবাসেন, তাই আমার উপর কখনোই কোন বিষয়ে জোর করেন না।
এবার মনে হয় আর কাজ আসবে না। তুমি চাকরি পেলে না হয় কিছু একটা বলে হাতে-পায়ে ধরে ম্যানেজ করা যেতো।

নীলার মিনতি ভরা কণ্ঠ, চোখ ভর্তি জল কষ্টের ঝড় তুললো আবীরের হৃদয় মহলে। ঝড়ের তান্ডবে দুমড়ে মুচড়ে গেলো তার বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকু।

আসলেই তো। নীলাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন নীলা, তাকে না পেলে…

কবরের মত অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে প্রতিদিন সে নীলাকে নিয়ে মধুর মধুর স্বপ্ন দেখে আর প্রতিদিন এলার্মের কর্কশ টিউনে ঘুম ভেঙে যায়। ছুটতে হয় -‌ সোনার হরিণ নামক চাকরির পেছনে।

তার জীবন ডাইরির রোজনামচার পাতায় নেই কোন ব্যাতিক্রম কিছু – শুধু রাতে দেখা নীলাকে নিয়ে অবাস্তব ও অকল্পনীয় স্বপ্ন ছাড়া। এতোই রষ-কষহীন জীবন তার।

কয়েকদিন থেকে মনের মাঝে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে ওর। এবারের ইন্টারভিউ দিয়ে আসার পর থেকে। মনটা কেন যেন বলছে- এবারের চাকরিটা হয়ে যাবে।
কিন্ত কেন? নিজেই জানে না সে।

চাকরি পাবার লেটারটি হাতে পেয়েই আনন্দ চিৎকার করে উঠলো সে। মনটা স্বপ্ন পাখায় ভর করে ভেসে বেড়াতে লাগলো একটা সুখের নীল আকাশে।সেখানে আছে নীলা আর তার ছোট্ট একটা সংসার। অসম্ভব সুখ আর আনন্দে ঘেরা প্রতিটি ক্ষণ। কত সুন্দর সুন্দর আর সুখের একেকটি চিত্র ভেসে উঠলো চোখের তারায়। ছোট্ট একটা বেবীডলের মত মেয়ে শিশুর ছবি ভেসে উঠে মনের পর্দায়। শিশুটির নিষ্পাপ মুখের পবিত্র চাহুনি হৃদয়ে ভালোবাসার সুনামী বইয়ে দিলো।

আহা! কি সুখ! আহা! কি আনন্দ! যেন স্বর্গ নেমে এসেছে এই ধুলির ধরায়।

আনন্দ ও খুশিতে নীলাকে জানাতেই ভুলে গেছে সে… আর তখনই মোবাইল হাতে নিয়ে ডায়াল করলো – কিন্ত হতাশ হতে হলো কারণ নীলার নাম্বার বন্ধ।

এখন উপায় একটাই- সোজা নীলাদের বাড়ি চলে যাওয়া আর তাকে চমকে দেয়া। ওর মোটা স্যালারির চাকরিটার কথা শুনে নীলার মুখটা নিশ্চয়ই আনন্দে ঝলমল করে উঠবে। আর তার পিতাও নিশ্চয়‌ই অমত করবেন না এই প্রস্তাবে।

খুশিতে মনে হচ্ছে – উড়ে উড়ে চলে যাবে সে। যখন ওদের বাড়িতে সে পৌঁছালো তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়।

নীলাদের বাড়িতে পৌঁছেই সে হতবাক হয়ে গেলো। বাড়িটা যেন মৃত্যপুরি। খাঁ খাঁ করছে শুন্য মরুভূমির মত।

কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়নি তো! নীলার মা-বাবা সোফার এককোনে বসে আছেন হতাশ হয়ে। চোখে অশ্রু।

আজ নীলার বিয়ে ছিলো। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে ওকে দেখে ঘুনাক্ষরেও বুঝা যায়নি বিয়েতে ওর অমত আছে।তারিখ ঠিক হবার পর থেকেই ওকে প্রচন্ড হাসি-খুশি আর আনন্দিত দেখাচ্ছিলো।নিজ হাতে সবকিছু গুছানো, মার্কেট থেকে শুরু করে সব পরিকল্পনা ওর ছিলো। সকালে ওকে ডাকতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিলো। মাথা ব্যাথার অজুহাত দেখিয়ে সে মেহেদি রাঙা হাত নিয়ে একা এক রুমেই ঘুমুতে যায়। কিন্তু দরজা ভেঙে দেখা গেলো-নীলার ঝুলন্ত লাশ!

কিন্ত এ বিয়েতে তো ওর কোন আপত্তি ছিলো না। তবে কেন আত্মহত্যা করতে গেলো সে? কেউ এর রহস্য খুঁজে পেলো না।
পরে টেবিলে রাখা চিঠিটাই সব রহস্যর সমাধান করে দিলো। তাতে লেখা-
প্রিয় বাবা ও মা। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতেও লজ্জা লাগছে। জানি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করতে যাচ্ছি আমি।কিন্তু আমি যেনিরুপায়। যাকে ভালোবাসি সে সবদিকে তোমাদের অযোগ্য। এই বিয়েতে আমার কোন অমত নেই। আবার তার হাত ধরে পালিয়ে যাবার দুঃসাহস হয়নি। কাল রাত মেহেদী লাগানোর পর আমার টনক নড়ে। বারবার মনে হতে লাগলো- কাল থেকে শুরু হবে অন্য রকম জীবন, যা আমার এতদিনের কল্পনার ঠিক বিপরীত। যাকে নিয়ে এত্ত কল্পনার জাল বোনা। সুখের স্বপ্ন দেখা। যে আমার জন্য প্রতিদিন ইন্টারভিউ নামক কঠিন প্রহসনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমাকে না পেলে সে বাঁচতে পারবে না আর আমিও যাকে ছাড়া বেঁচে থাকবো একটা জীবন্ত লাশের সমতুল্য। ঠিক তখন‌ই হঠাৎ মনে হলো – তাকে ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন, আর তাই…।
প্রিয় মা-বাবা, পারলে ক্ষমা করে দিও, নইলে ঘৃণা করো।
তোমাদের আদুরী…
নীলা

আবীর টলতে টলতে রাস্তায় বের হলো। তারপর চাকরির লেটারটি কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিলো বাতাসে। এই চাকরিটার কোনই প্রয়োজন নেই এখন!