গল্পের বাবু’টা
একুশে জার্নাল
অক্টোবর ১২ ২০১৯, ১৬:২৯
বনশ্রী বড়ুয়া
হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল,মৃত্যু পুরীর মত লাগছে,,,ইমার্জেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে আছি একঘন্টা। ভোররাতের দিকে বাবার বুকে ব্যাথা করছিল।তাড়াহুড়া করেই নিয়ে এসেছিলাম।আমি আর বাবা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়েই আছি।ভীড় ঠেলে বাবা ভেতরে যেতে চাইছেন না।চারিদিকে কান্নার শব্দ,আহাজারি মনটা কেমন অস্থির হয়ে আছে।
সাদা আস্তিনে পুরো শরীর ঢাকা,শুধু পা’দুটো বেড়িয়ে আছে।বেড়িয়ে থাকা পা দুটো খুব আদুরে দেখাচ্ছে।
কতগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলে, সম্ভবত বিশ একুশ হবে,কান্নায় ভেঙে পড়ছে একবারে,কেউ কেউ আর্তনাদ করছে,কেউ কেউ গোঁ গোঁ শব্দ করছে।কেউ কেউ শাদা আস্তিনে ঢাকা শরীরটাকে নাড়াচ্ছে।যেন নাড়া দিলেই জেগে উঠবে।
আমি ওর বাবা-মাকে খুঁজছিলাম। না,কেউ নেই কোথাও। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
বলল,ভুল সন্দেহে ক্যাম্পাসের সেরা ছাত্রটাকে পিটিয়ে মেরেছে ।
পিটিয়ে মেরেছে!!শব্দটা কেমন যেন লাগল।
আহারে!!কতটা পেটালে পরে একটা তাজা প্রাণ বেড়িয়ে যায় খোলা আকাশে….?আচ্ছা,বাচ্চাটার কি খুব লেগেছিল?মায়ের মুখটা কি খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল?নিশ্চয়ই জোরে জোরে মা, মা বলে চিৎকার করেছিল বাচ্চাটা…
জায়নামাজে দাঁড়িয়ে মা কি পেরেছিল স্থির আর শান্ত ভাবে আল্লাহ কে ডাকতে?নাকি মনটা খালি আকুলিবিকুলি করছিল,অস্থির হয়ে শুধু ঘরময় পায়চারা করছিল?
প্রসববেদনায় অস্থির হয়ে এঘর ওঘর হাঁটতে কি অসহ্য যন্ত্রণা হতো মায়ের,তারপরও দশমাসে একবারও বাচ্চাকে অন্যের কাছে দিয়ে হালকা হতে মন চায়নি কিন্তু আজ কেন মায়ের পুরো শরীরটা এমন ভারী মনে হচ্ছে?তবে কি মায়ের মন জেনে গেছে তার সন্তানের কচি শরীরে একটার পর একটা কালশিটে দাগ, জমা রক্ত, কান্না,আত্নচিৎকার একটু একটু করে দূরে নিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে….
মা কি শুনতে পেয়েছিল, মা মা চিৎকারে বাঁচার আকুতি করেছিল তার বাবুটা?
বাবুটা নিশ্চয়ই শেষ মুহুর্তে মা’কে ডেকে ছিল খুব,মায়ের দেবীময় মুখটা কল্পনায় এঁকেছিল!,
বাচ্চাটার মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।একটু সামনে এগিয়ে যাবো ভাবছি।তখনই ষোলো সতের বছরের একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে আসছে অন্য দুটো’ ছেলে।
ছেলেটা আমার ভাইয়া,আমার ভাইয়া বলেই গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ায় শাদা আস্তিনটা সরে গেল মুখ থেকে।
একি!!কি আদুরে মুখটা!! কি অদ্ভুদ সুন্দর !!
মনে হলো যেন হাসছে!সে হাসি তাচ্ছিল্যের!
যেন ব্যঙ্গ করছে আমাকে!
না, না, আমাকে নয়,ব্যঙ্গ করছে মানচিত্রটাকে!নিরাপত্তাহীন জীবনটাকে!বিকিয়ে যাওয়া লাল সবুজকে!যেন বলছে,মৃত্যু চাইনি,আলোতে ভরাতে চেয়েছিলাম এই দেশটাকে,প্রিয় মাতৃভূমিকে।
ততক্ষণে ভীড় বেড়েছে হাসপাতালে, বেড়েছে বন্ধুদের কান্না,আহাজারি আর আর্তনাদের শব্দ।আস্তে আস্তে দূরে সরে এলাম।
বাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পেছন থেকে বাবা বলল,এখানে থাকলে বুকের ব্যাথা আরো বেড়ে যাবে খোকা,চল,বাড়ি ফিরে যাই…
বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম খুব করে। কান্না পাচ্ছিল,পেছন ফিরে ওর তাচ্ছিল্য মাখা হাসিটা আবার দেখলাম।বাচ্চাটা হেসেই চলেছে….কি অদ্ভুত সে হাসি….
বাবা আমাকে টেনে নিয়ে গেল হাসপাতালের বাইরে…..আজ বিজয়া দশমী,দূর থেকে কাঁসার ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে…দেবী বিসর্জনের আয়োজন চলছে…দেবী ফিরে যাবেন।
অসুর বিনাশ না করেই দেবীর বিসর্জন হবে….
যুগে যুগে অসুর রয়ে যাবে… অসুরময় হবে একদিন পুরো পৃথিবী….