দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ৩১ ২০২৫, ০১:০৪

জামেয়া দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট।

ভারত বিভাজনের দুই বছর পর, ১৯৪৯ সালে, সিলেটের সাদীপুর ফেরিঘাটে গলমুকাপন নিবাসী বিশিষ্ট মুরব্বি জনাব আবদুল মান্নান মিয়া সাহেবের সঙ্গে কর্মবীর ডা. মর্তুজা চৌধুরীর (রহ.) সাক্ষাৎ হয়।

ডা. মর্তুজা চৌধুরী ছিলেন অখণ্ড-ভারত আন্দোলনের সমর্থক, অপরদিকে মান্নান মিয়া ও তাঁর গ্রামবাসী ছিলেন ভারত বিভাজনের পক্ষে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার মধ্যেও তাঁদের আলাপচারিতায় এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা হয়।
জনাব মান্নান মিয়া ডাক্তার সাহেবকে চাচা বলে ডাকতেন। কুশল বিনিময় করে বললেন, “চাচা, আপনি তো আমাদের এদিকে আর আসেন না। আমাদের মসজিদ ইমামশূন্য। দুই-তিন মাসের বেশি ইমাম রাখা সম্ভব হয় না। আপনি আমাদের মসজিদে যোগ্য একজন ইমাম রেখে দিন।”

ডাক্তার সাহেব বললেন, “আসব কিভাবে? তোমরা তো আমাকে পছন্দ কর না!” মান্নান মিয়া বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, “আমরা ভুলের মধ্যে ছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, আপনার ধারণাই সঠিক ছিল।” ডাক্তার সাহেব এরপর আশ্বাস দিলেন, “তাহলে আগামী শুক্রবার তোমাদের মসজিদে আসব।”

‘মসজিদে জমায়েত ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের বীজ বপন’

নির্ধারিত দিনে ডাক্তার সাহেব গলমুকাপন পৌঁছে মান্নান মিয়া ও মুনশি আফতাবুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে জুম্মার নামাজে উপস্থিত থাকার আহবান জানান।
নামাজ শেষে তিনি যখন সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান করছিলেন, তখন গ্রামের আরেক মুরব্বি জনাব ইসমাইল মিয়া বলে উঠলেন, “আপনার ওয়াজ তো আমরা অনেক শুনেছি। এবার আপনি আমাদের মসজিদের মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব নিয়ে আমাদের হেদায়েতের ব্যবস্থা করুন।”

ডাক্তার সাহেব বললেন, “আপনারা যদি মসজিদের পাশাপাশি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, তবে আমি আপনাদের মসজিদের দায়িত্ব নিতে পারি।” উপস্থিত সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন! যেখানে মসজিদ চালাতেই হিমসিম খেতে হয়, সেখানে আবার মাদরাসা! এটা কি সম্ভব? ডাক্তার সাহেব বললেন তিনটি কাজ করতে পারলে মাদরাসা চালানো অসম্ভবের কিছু নয়। কাজ তিনটি হল:

১. সাপ্তাহিক ঘরপ্রতি প্রতিবেলা এক মুঠো চাল।
২. কেদারপ্রতি জমি থেকে এক সের ধান।
৩. বহিরাগত ছাত্রদের জন্য লজিংয়ের ব্যবস্থা।

তাঁর পরিকল্পনা-প্রস্তাবে সবাই সম্মতি প্রকাশ করলে ডাক্তার সাহেব অভয় দিয়ে বললেন, “আজ থেকে আপনাদের মসজিদ ও মাদরাসার যাবতীয় জিম্মাদারি আমি গ্রহণ করলাম।”

‘মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী কার্যক্রম’

অতঃপর ১৯৫০ সালে মাহমুদুল হাসান ওরফে অন্ধ হাফিজ সাহেব এবং মুনশি আফতাবুদ্দিন সাহেবের মাধ্যমে মসজিদের বারান্দায় গলমুকাপন দারুসসুন্নাহ মাদরাসার প্রথম সবক শুরু হয়। এভাবে মসজিদ ও মাদরাসার স্বাভাবিক কার্যক্রম চলার কিছুদিন পর ডাক্তার সাহেবের অনুরোধে গহরপুর দেওয়ান-বাড়ি মসজিদের ইমামতি ছেড়ে মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেব নিজ গ্রামে ফিরে আসলে, তাঁকে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব সমঝিয়ে দেয়া হয়।

মাওলানা ফখরুদ্দিন সাহেবের তুখোড় নেতৃত্ব ও অপরিসীম মেহনতের ফলে দারুসসুন্নাহ মাদরাসা ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহন করে। অল্প কয়েক বছরে তাঁর সাহসী উদ্যোগ এবং এলাকার জনসাধানণের নিঃস্বার্থ অনুদানে মাদরাসাটি ছাপড়াঘর থেকে সুরম্য অট্রালিকায় পরিনত হয়। অজপাড়াগাঁয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় একটি টাইটেল মাদরাসা।

শায়খুল হাদিস মাওলানা মাসউদ আহমদ বাঘার হুজুর, মাওলানা মুহিউদ্দিন, মাওলানা শায়খ আবদুশ শহীদ, মাওলানা শামছুদ্দীন ও মাওলানা আবদুল খালিক কিয়ামপুরীর মতো মেধাবী শিক্ষকমন্ডলি, উন্নত বোর্ডিং ব্যবস্থা ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ মাদরাসাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তীর্থস্থানে পরিনত করে।

১৯৫১ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৫৮ বাংলা সনে গলমুকাপন গ্রামবাসীর পক্ষে জনাব আবদুল মান্নান মিয়া ওয়াকফ-রেজিস্ট্রির মাধ্যমে মাদরাসার নামে জমি বরাদ্দ করেন।

এভাবে গলমুকাপন মাদরাসা একটি ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে বিগত পঁচাত্তর বছর যাবত সিলেট ও পাশ্ববর্তী এলাকায় দ্বীনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে ইসলাম ও সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছেন।

©️ গ্রন্থনা ও পরিবেশনাঃ আহমদ মানসুর।
সূত্রঃ কর্মবীর ডা. মর্তুজা চৌধুরী: জীবন ও সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬।