কোরবানির ইতিহাস : তাৎপর্য ও জরুরি মাসআলা
একুশে জার্নাল ডটকম
আগস্ট ০৯ ২০১৯, ২০:১১
এহসান বিন মুজাহির
আগামী ১২ আগস্ট দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তম দুটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম একটি হলো ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অপর নাম কোরবানির ঈদ। সামর্থবান ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব একটি বিধান।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয় মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা।
কোরবানি গুরুত্বপুর্ণ একটি ইবাদত। ঈদুল আজহার অপর নাম কোরবানির ঈদ। কোরবানির ঈদে পশু জবাই করা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ওপর ওয়াজিব। কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে অনেক বাণী বর্ণনা করা হয়েছে। কোরবানির ফজিলত প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন-‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তারা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লস্নাহর নাম উচ্চারণ করে। (হজ : ৩৪)।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-‘নিশ্চই আমার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার নিকট পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। (হজ : ৩৭)।
কোরবানি নতুন কোনো প্রথা নয়, বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হযরত আদম (আ.) এর যুগে কোরবানির সূচনা হয়েছিল। আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল কাবিলের মধ্যে বিয়ে-শাদী নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার নিকট কবুল হবে তার নিকট মেয়ে বিয়ে দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল। হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হল, কাবিলের হলো না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘হে নবী আপনি তাদের নিকট যথাযথভাবে আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের নিকট তাদের কোরবানিকে পেশ করল, তখন এক জনের কবুল হল অন্য জনের হলো না। যার কোরবানি কবুল না হওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলবো। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন’। (সূরা মায়িদা : ২৭)।
কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
প্রথমে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর কোনো সন্তান ছিল না তাই তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বললেন ‘হে আল্লাহ! আমাকে আপনি নেককার সন্তান দান করেন। তার এ দোয়া মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কবুল হয় এবং তিনি তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিলেন। ইবরাহিম (আ.) একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে মহান রাব্বুল আলামিন তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তার কলিজার টুকরা পুত্র সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দেয়ার জন্য। কোনো কোনো রেওয়াত থেকে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন ইবরাহিম আ. কে পরপর তিনদিন দেখানো হয় । এ প্রসঙ্গে তাফসিরের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত ইবরাহিম আ. এর বয়স যখন তের অথবা পূর্ণবয়স্কে পৌঁছেছিল তখন তাকে এ স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল । ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নের আধ্যমে এ নির্দেশ পেয়ে চিন্তিত হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন ইসমাঈল কি মেনে নিবে। সে কি আল্লাহর রাস্তায় জান বিলাতে রাজি হবে। তিনি তার ছেলের কাছে গেলেন এবং বললেন আমি স্বপ্নের মাধ্যমে তোমাকে কোরবানি করার নির্দেশ পেয়েছি তোমার কি মতামত? তিনি সাথে সাথে বলে উঠলেন, আব্বা আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশ পেয়েছেন তা বাস্তবায়ন করেন। ইনশাল্লাহ আমাকে আনুগত্য ও ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর মুখ থেকে প্রাণভরা কথা শুনে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাকে কোরবানি করার জন্য ময়দানে নিয়ে গেলেন। ইসমাাঈল (আ.) এর হাত, পা, বেঁধে জমিনে শুয়ে দিলেন । ধারালো চাকু দ্বারা তার গলাতে পোঁচ দিতে লাগলেন কিন্তু আল্লাহর কি অপার মহিমা ছুরি তথা চাকু দ্বারা গলা কাটবে তো দূরের কথা তার গলায় দাগও বসাতে পারেনি। ইবরাহিম (আ.) নতুন আরেকটি ছুরি হাতে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালাতে লাগলেন তখন গায়েবীভাবে একটি আওয়াজ তার কানে পৌঁছলো, হে ইবরাহিম তুমি মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো, তোমার কলিজার টুকরা সন্তানকে আর কষ্ট দিও না, এবার তাকে ছেড়ে দাও। তোমার কোরবানি হয়ে গেছে। পুত্রের বদলে তুমি একটি তর-তাজা দুম্বা কোরবানি করো। তখন ইবরাহিম আ. একটি দুম্বা কোরবানি করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন।
হযরত ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে গিয়ে শয়তান অনেক কুমন্ত্রণা ও প্রতারণা দেয়ার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করছিলো কিন্তু খলিলুল্লাহ শয়তানের সব প্ররোচনাকে পাড়ি দিয়ে মহান রবের নির্দেশ পালনে মনযোগী হলেন। হজরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বললেন যখন ইবরাহিম ছুরি চালালেন তখন জিবরাইল আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি আমি পৌঁছার আগেই জবাই কাজ শেষ হয়ে যায় কিনা তাই তিনি জোরে জোরে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি বলে আসছিলেন, আর এ তাকবিরের আওয়াজ ইবরাহিম (আ.) এর কানে পৌঁছলে তিনি উপরের দিকে তাকালেন এবং বুঝতে পারলেন যে, জিবরাইল (আ.) তাকবির ধ্বনি দিয়ে আসছেন। তখন তিনি বলে উঠলেন ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ আর এই তাকবীর শুনার পর ইসমাঈল (আ.) পরবর্তী লাইন ‘ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বলে উঠলেন। (তাফসিরে মাযহারি)।
কোরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সকল গুণাহ মোচন করে দেয়া হয়। (তিরমিজি শরিফ : ১/১৮০)।
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে। (মুসলিম শরিফ : ২৮৩১)।
বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় দশ বছর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি শরিফ : ১/১৮৯)।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই। (মেশকাত শরিফ : ১৯৬৭)।
বিখ্যাত সাহাবি হজরত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সা.) পবিত্র মদিনায় দশ বছর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি শরিফ : ১/১৮৯)।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই। (মেশকাত শরিফ : ১৯৬৭)।
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা রা. থেতে বর্ণিত, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন-‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করেনা সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়। (ইবনে মাজাহ শরিফ : ১৬৩৯)।
একদিন হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসুল সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোরবানি কি? তখন উত্তরে রাসুল সা. ইরশাদ করলেন কোরবানি হচ্ছে ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ. এর জীবনাদর্শ’ সাহাবী পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন কোরবানি র ফজিলত কি? রাসুল সা. বললেন- পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয়’। (মিশকাত শরিফ : ১/১২৯)।
কোরবানি সম্পর্কিত জরুরি কিছু মাসআলা
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব :
১. ঈদুল আজহার দিন প্রয়োজনীয় খরচ ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা সম পরিমাণ সম্পদ যার কাছে থাকবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছর থাকা জরুরি নয়, কোরবানির শেষ দিন সূর্যাস্তের পূর্বেও কেহ যদি নেসাব পরিমাণের মালিক হয় তাহলে তার ওপরও কোরবানি ওয়াজিব।
২. জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পরিমাণ জমি ও ফসলের দরকার তা থেকে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য অথবা যে কোনো একটির মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেও কোরবানি ওয়াজিব।
৩. একই পরিবারের সকল সদস্য পৃথক পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হলে সকলের ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব ৪. কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করলে সে উদ্দেশে পূর্ণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। অতএব প্রত্যেক স্বাধীন, ধনী, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব।
কোরবানির পশু ও তার বয়স :
ইসলামী শরীয়তে গরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, উট কোরবানি করাকে বৈধতা দান করেছে। তবে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করা চলবে কিন্তু গরু, মহিষ, উট সাত ব্যক্তি শরীক হতে পারবে। শর্ত একটাই শরীকদার সকলের নিয়ত বিশুদ্ধ থাকতে হবে। এদের মধ্যে একজনেরও যদি লোক দেখানো বা গোশত খাওয়া উদ্দেশ্য হয় তাহলে কারো কোরবানি কবুল হবে না।
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এক বছর বয়সী হওয়া আবশ্যক। তবে যদি ছয় মাসের দুম্বা এবং ভেড়া এরূপ মোটা তাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের মত মনে হয় তাহলে ঐ ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা যাবে। আর ছাগল যতো বড়ই হোক না কেন এক বছর পরিপূর্ণ হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি জায়েজ হবে না। গাভী, মহিষ দু’বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। উট পাঁচ বছরের হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি হবে না। কোরবানির জন্য মোটা, তরতাজা, সুস্থ পশু হওয়া জরুরি। আতুর, লেংড়া, কানা, কানকাটা, লেজকাটা, দুর্বল পশু দিয়ে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না।
কোরবানির তারিখ ও দিন :
কোরবানি তিন দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোরবানির দিন হলো দশ, এগারো ও বারো জিলহজ। এ তিন দিনের মধ্যে যেকোনো দিন কোরবানি করা জায়েজ আছে। তবে উত্তম দিন হচ্ছে প্রথম দিন অর্থাৎ দশ জিলহজ। কোনো কারণ ছাড়া বিলম্ব না করা ভালো।
কোরবানির সময় :
জিলহজের দশম দিন ঈদের নামাজ পড়ার পর থেকে জিলহজের বার তাবিখ সূর্যাস্তের পুর্ব পর্যন্ত কোরবানি করা যাবে। তবে ঈদের নামাজের পূর্বে কোরবানি করা যাবে না। ঈদের নামাজ পড়ে এসে কোরবানি করতে হবে। যদি শহরের একাধিক স্থানে ঈদের নামায হয় তাহলে যেকোনো এক স্থানে নামাজ আদায় হয়ে গেলে সব স্থানেই কোরবানি করা জায়েজ হবে।
জবেহ :
কোরবানি দাতা সে নিজেও জবেহ করতে পারবে এবং কোনো আলেম তথা জানলেওয়ালা কাউকে দিয়ে কোরবানি করাতে পারবে। তবে উত্তম হচ্ছে নিজের কোরবানি নিজে করা। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরি নয় বরং অন্তরের নিয়তই যথেষ্ট। জবেহ করার সময় অবশ্য অল্লাহর নাম নিতে হবে।
কোরবানির গোশত :
কোরবানির গোশত নিজে খাবে এবং গরিব-মিসকিনগণকে খওয়াাবে। উত্তম পন্থা হচ্ছে গোশতকে তিনভাগে ভাগ করা, একভাগ গরিব-মিসকিনকে দান করা। একভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং এক অংশ নিজ পরিবারের জন্য রাখা।
পশুর চামড়া :
কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবে এবং অন্যকে হাদিয়াও দিতে পারবে। আবার মাদরাসার লিল্লাহ ফান্ডেও দান করা যাবে। কিন্তু কোরবানির চামড়া বিক্রি করে কোনো মাদরাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামের ভাতা দেয়া যাবে না। বিক্রি করলে চামড়ার টাকা একমাত্র গরিব-মিসকিনকেই দান করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে মাদরাসার গরিব ফান্ডে দান করা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক