কুরবানীর ইতিহাস, তাৎপর্য ও মাসাইল
একুশে জার্নাল ডটকম
জুলাই ২৭ ২০২০, ১৯:১৯

হুসাইন আহমদ মিসবাহ: কুরবানি’ শব্দটি আরবি ‘কুরব’ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করাই কুরবানী
শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর নামে পশু জবেহ করাকে কুরবানী বলে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণ স্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা আল-হাজ্জ্ব, আয়াত-৩৪)
কুরবানির ইতিহাস :
হযরত আদম আ. থেকে হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত সব নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুসারীরা কুরবানী করেছেন। ইতিহাসে হজরত আদম আ. এর দুই পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে প্রথম কুরবানির সূত্রপাত হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল। তখন একজনের (হাবিলের) কুরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। তাঁদের একজন বললেন, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবই।’ অপরজন বললেন, ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কুরবানী কবুল করেন”।(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭)
তারপর হযরত নূহ আ. হযরত ইয়াকুব আ. ও হযরত মুসা আ. এর সময়ও কুরবানির প্রচলন ছিল। রাসুলুল্লাহ সা. এর পিতা আব্দুল্লাহর পরিবর্তেও উঠ কুরবানী দেওয়া হয়েছিল। এজন্য রাসুল সা. বলতেন, ” আমি দুটি কুরবানির সন্তান”।
তবে সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে হযরত ইব্রাহীম আ. এর কুরবানী। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় পুত্রকে কুরবানি করার মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হযরত ইব্রাহিম আ. স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন। তিনি পর পর তিন দিন দৈনিক ১০০টি করে মোট ৩০০টি উট কুরবানী করেন। কিন্তু তা কবুল হয় না। বারবার আদেশ হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানী করো।’ শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল আ. কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হবে।
প্রিয়পুত্র হযরত ইসমাইল আ. এর সাথে এ ব্যাপারে আলোচনার পর, হযরত ইসমাইল আ. নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হযরত ইব্রাহিম আ. এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীক্ষা। তাই পিতার ধারালো ছুরি শিশুপুত্রের একটি পশমও কাটতে পারেনি, পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে জান্নাতি পশু দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল স্রষ্টাপ্রেমে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কুরবানী। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পশু কুরবানী করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাঁদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল তথা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
কুরবানির তাৎপর্য:
ইতিমধ্যে কিছুটা হলে ক্লিয়ার হয়েছে যে কুরবানী মানে ত্যাগ, বিষর্জন, স্যাক্রিফাইজ। বহুলাংশে কুরবানী বলতে পশু কুরবানি বুঝালেও, পশু কুরবানির মাঝে কুরবানী সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃত অর্থে আল্লাহর ইচ্ছা বা সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের সবকিছু ত্যাগ বা বিষর্জন দেয়াই কুরবানী। প্রভুর খুশির জন্য নিজের ইচ্ছে, অভিলাষ, কামনা, বাসনা, পরিত্যাগই কুরবানি এই কুরবানী ওয়াজিব নয় বরং ফরজ। তাই যারা সারা বছর বা সারা জীবন আল্লাহর হুকুম আহকামের তোয়াক্কা করেননা, আল্লাহর বিধান মতে জীবন পরিচালনা করেন না বা চেষ্টা করেন না, তারা সারা বছর ফরজ কুরবানী আদায় করেন না। সুতরাং সারা বছর বা সারা জীবন ফরজ কুরবানী আদায় না করে বছরে একদিন ওয়াজিব কুরবানী আদায় করলে সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য হবে কি না, আল্লাহই ভাল জানেন।
কুরবানী কাদের উপর এবং কখন ওয়াজিব:
যার মধ্যে নিম্নবর্ণিত ৬টি শর্ত পাওয়া যাবে, তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। শর্ত হলো-
১. মুসলমান হওয়া,
২. স্বাধীন হওয়া,
৩. মুক্বীম হওয়া, (মুসাফির না হওয়া)
৪. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া,
৫. সুস্থ মস্তিস্কে থাকা,
৬. নিসাবের অধিকারী হওয়া।
তাই প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক স্বাধীন মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নিসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
নিসাব:
আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) তোলা, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) তোলা, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল তার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি একক ভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহিতুল বুরহানী ৮/৪৫৫)
কুরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা আবশ্যিক নয়, বরং কোরবানির তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।) বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)
কুরবানীর সময় হল যিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। (মুয়াত্তা মালেক ১৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮, ২৩ ।)
কুরবানীর পশু:
ছাগল, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা, উট ইত্যাদি পশু কুরবানী দেয়া যাবে। গাভী, ছাগী, ভেড়ী ও উটনী দিয়েও কুরবানী দেওয়া যায়। কারণ যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫।)
কুরবানী শুদ্ধ হতে পশুর শর্ত।
১. বয়স : পশুগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে। গরু, মহিষ হলে বয়স হয়ে হবে কমপক্ষে দুই বছর। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা কমপক্ষে এক বছর। উট কমপক্ষে পাঁচ বছর। অবশ্য ছয় মাসের ভেড়া যদি দেখতে মোটাতাজা হয় এবং এক বছর বয়সের মনে হয় তাহলে তা দিয়ে কুরবানী বৈধ।
(কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)
২. সুস্থতা : যে পশুই কুরবানী দেয়া হোক না কেন তা হতে হবে সুস্থ ও সবল। কুরবানীর পশু চয়নের ক্ষেত্রে মনে রাখবে, এই পশুটি আল্লাহর দরবারে উপহার দেয়া হচ্ছে। তাই উৎকৃষ্ট পশু উপহার দেয়া উচিত। দুনিয়াতে আমরা কোনো উচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তির নিকট যদি কোন উপহার পাঠাই, তাহলে সবচে’ ভাল এবং উৎকৃষ্ট জিনিসটি পাঠাই। তাহলে মহান আল্লাহর নিকট পাঠানো জিনিস কেন উৎকৃষ্ট হবে না?
৩. নিখুত : কুরবানীর হতে হবে নিখুত। পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কুরবানী দেয়া যাবে না, তাহল-
১. যে পশুর দৃষ্টিশক্তি নেই।
২. যে পশুর শ্রবণশক্তি নেই।
৩. এই পরিমাণ লেংড়া যে, জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না।
৪. লেজের অধিকাংশ কাটা।
৫. কানের অধিকাংশ কাটা।
৬. অত্যন্ত দুর্বল, জীর্ণ-শীর্ণ প্রাণী।
৭. গোড়াসহ শিং উপড়ে গেছে।
৮. পশু এমন পাগল যে, ঘাস পানি ঠিকমত খায় না। মাঠেও ঠিকমত চরানো যায় না।
৯. জন্মগতভাবে কান নেই।
১০. দাঁত মোটেই নেই বা অধিকাংশ নেই।
১১. স্তনের প্রথমাংশ কাটা।
১২. রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে গেছে।
১৩. ছাগলের দুটি দুধের যে কোন একটি কাটা।
১৪. গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোন দুটি কাটা।
১৫. জন্মগতভাবে একটি কান নেই।
পশুর হালকা ত্রুটি:
পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কুরবানী দেয়া যাবে : (তবে উত্তম হচ্ছে পরিপূর্ণ সুস্থ পশু দেয়া, ত্রুটিযুক্ত প্রাণী না দেয়া)
১. পশু পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমত খায়।
২. লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে অধিকাংশ আছে।
৩. জন্মগতভাবে শিং নেই।
৪. শিং আছে, তবে ভাংগা।
৫. কান আছে, তবে ছোট।
৬. পশুর একটি পা ভাংগা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে।
৭. পশুর গায়ে চর্মরোগ।
৮. কিছু দাঁত নেই, তবে অধিকাংশ আছে। স্বভাবগত এক অন্ডকোষ বিশিষ্ট পশু।
১০. পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম।
১১. পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম।
১২. বন্ধ্যা পশুর কুরবানী জায়েয। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫)
পশু ক্রয়ের পর ত্রুটিযুক্ত হয়ে গেলে :
কুরবানীর উদ্দেশ্যে ভাল পশু ক্রয়ের পর যদি তা এই পরিমাণ ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়, যা দ্বারা কুরবানী জায়েজ হবে না তাহলে দেখতে হবে ক্রেতা ধনী না দরিদ্র? ক্রেতা যদি দরিদ্র হয় তাহলে সেই ত্রুটিযুক্ত পশু দিয়েই সে কুরবানী দিবে। আর যদি ক্রেতা ধনী হয়, তাহলে দ্বিতীয় আরেকটি পশু কিনে কুরবানী দিতে হবে। প্রথমটি দিয়ে কুরবানী শুদ্ধ হবে না। (ফতোয়ায়ে শামী, ৫ম খন্ড, ২৮৪ পৃষ্ঠা, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাওয়াযেল ২৩৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫)
শরীকানা কুরবানী:
অনেকের একক ভাবে গরু ক্রয় করতে না পারায় কুরবানী দেননা। তারা চাইলেই কয়েকজন মিলে কিংবা অন্যের সাথে শরীক হয়ে কুরবানী দিয়ে পারেন।
ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবেন। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোরই কুরবানী হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী আদায় হবে না। (সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)
শরীকানা কুরবানী ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় শরীকের কারণে সবার কুরবানী নষ্ট হয়ে যায়।
১. সমতা : একাধিক শরীক মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। সাতজন মিলে কুরবানী দিলে কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। অর্থাৎ মোট সাত অংশের মধ্যে হিস্যানুযায়ী প্রত্যেককে তার পুরো অংশ বুঝিয়ে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
শরীকানা কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১)
২. নিয়ত : কুরবানী দিতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে। যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কিংবা আভিজাত্য রক্ষায় কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। এমন কোন লোককে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯)
৩. হালাল টাকা : হালাল পথে উপার্জন করা টাকা দিয়ে কুরবানী দিতে হবে, হারাম টাকা বা হারাম মিশ্রিত টাকা দিয়ে কুরবানী দিলে কুরবানী হবেনা। শরীকদের মধ্যে কারো পুরো বা আংশিক উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।
৪. সমানাধিকার : শরীকানা কুরবানীর সকল ক্ষেত্রে সমানাধিকার থাকতে হবে। এমনকি কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ওয়ারিসদেরকে ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১)
৫. ক্রয়ের সময় নিয়ত : যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে ক্রয় করে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই উত্তম। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দিতে হবে। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, তাহলে সে অন্যকে শরীক করতে পারবে না। এমন গরীব ব্যক্তি যদি কাউকে শরীক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করতে হবে। (কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০)
কুরবানীর পশু জবাই:
কুরবানীর পশু জবাই করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেক সময় জবাই সংক্রান্ত জটিলতা বা জবাইয়ে সিস্টেমলসের কারণে কুরবানী নষ্ট হয়ে যায়, আমরা টেরই পাইনা। তাই জবাই নিয়ম জানা খুবই আবশ্যক।
কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। (মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪)
জবাইয়ের সুন্নাতি নিয়ম:
কুরবানীর পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ ক্বিবলামুখী করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর জবাই করতে হবে।
জবাইয়ের শর্ত :
কুরবানীর পশু জবাই করার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে।
১. জবাইকারী ব্যক্তি মুসলমান হতে হবে।
২. জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে। ইচ্ছে করে আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করলে কুরবানীতো হবেই না, সেই পশুর গোশত খাওয়াও হালাল হবে না।
৩. পশুর গলার চারটি রগ, নুন্যতম তিনটি রগ কাটতে হবে। গলার সম্মূখভাগে দু’টি- খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এবং দু’পার্শ্বে দু’টি রক্তনালী। এ চারটির মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দুটি রক্তনালীর মধ্যে একটি অবশ্যই কাটতে হবে। অর্থাৎ চারটি রগ বা নালীর মধ্যে তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে, অন্যথায় কুরবানী হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, ২য় খন্ড, ৩৭৫ পৃষ্ঠা।)
জবাই করার পূর্বে লক্ষণীয় :
১. জবাই করার পূর্বে পশুকে ঘাস, পানি ইত্যাদি ভালভাবে খাওয়াতে হবে। কোরবানীর প্রাণীকে ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত রাখা ঠিক নয়।
২. পশুকে কোরবানী করার স্থানে টেনে হিঁচেড়ে নেয়া ঠিক নয়।
৩. জবাই করার জন্য পশুকে শোয়াতে হবে সহজ সুন্দরভাবে। কঠোরভাবে নয়।
৪. কেবলার দিকে ফিরিয়ে শোয়াতে হবে, বাম পার্শ্বের উপর।
৫. পশুর চার পায়ের মধ্যে তিনটি বাঁধবে। একটি খোলা রাখবে।
৬. কার কার নামে কুরবানী হচ্ছে, জবাইকারী সেটা জানবেন।
৭. আগে থেকেই ছুরি ধার দিয়ে রাখবে। ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই করবে না।
৮. ছুরি যদি ধরাতে হয় তাহলে পশুর সামনে ধারাবে না। আড়ালে ধারাবে।
৯. কোরবানীর পশু শোয়ানোর পর ছুরি ধারানো অন্যায়, বরং আগে থেকেই ধার দিয়ে নিবে।
১০. এমনভাবে জবাই করা যাবে না যাতে গলা পুরাপুরি আলাদা হযে যায়।
১১. জবাই করার সময় ‘দোয়া’ বলতে হবে।
১২. যাতে দ্রুত জবাই হয়ে যায় এবং পশুর কষ্ট কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে।
১৩. একটি পশুকে আরেকটি পশুর সামনে জবাই না করা ভাল।
১৪. পশুর প্রাণ বের হওয়ার পূর্বে চামড়া খসানোর কাজ শুরু করা যাবেনা।
১৫. ঘাড়ের দিক থেকে জবাই করা যাবে না।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে আববাস রা. এর মত অনুযায়ী ঘাড়ের দিকে থেকে জবাইকৃত পশুর গোশত খাওয়া বৈধ নয়। (জাওয়াহিরুল ফিক্হ, ২য় খন্ড, ২৭৩ পৃষ্ঠা)
জবাইয়ের দোয়া :
কোরবানীর পশু জবাই করার মুহুর্তে জবাই কারী “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বা আল্লার নাম বলতে হবে, নতুবা কুরবানী হবেনা, পশুও হালাল হবেন। আর কুরবানীর ক্ষেত্রে যেসব দোয়া পড়া সুন্নত তাহলো:-
পশুকে শোয়ানোর পর প্রথমে এই দোয়া পড়বে, “ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়ালআরযা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারীকালাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন”।
তারপর জবাই করার সময় এই দোয়া পড়বে, “আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’।
জবাই করার পর এই দোয়া পড়বে, “আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিন ওয়া খলিলিকা ইব্রাহিমা আলাইহিমাস সালাম’। (মেশকাত শরীফ, ১ম খন্ড, ১২৮ পৃষ্ঠা)।
কুরবানীর গোশত বন্টন:
আগেই বলা হয়েছে, গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী দিলে কুরবানীই হবে না। তাই কুরবানী হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে। কিন্তু আল্লাহর জন্যে কুরবানী দিলেও গোশত খাবে মানুষই। তাই গোশত বন্টননীতি জানা প্রয়োজন।
কুরবানীর সম্পূর্ণ গোশত ইচ্ছে করলে কুরবানী দাতা খেতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলে কুরবানীর সসম্পূর্ণ গোশত বিলিয়েও দিতে পারেন, তবে গোশত বন্টনের সুন্নতি রীতি হল, কুরবানীর সমস্ত গোশত তিন ভাগ করা হবে।
১ ভাগ : কুরবানী দাতা নিজের ও পরিবারের খাওয়ার জন্য রাখবেন।
২য় ভাগ : নিকট আত্মীয় গরীব, যারা কুরবানী দিতে পারেননি, তাদের মাঝে বন্টন করে দিতে হবে।
৩য় ভাগ : অসহায়, গরীব, মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।
আল্লাহ বলেন, “অতপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাব গ্রস্থকে আহার করাও”।(সূরা হাজ্জ্ব ২৮)
“তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যেসব অভাবগ্রস্ত চায় এবং যেসব অভাবগ্রস্ত চায় না, তাদেরকে। এমনভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর”। (সূরা হাজ্জ্ব ৩৬)
রাসূল সা. কুরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেন,
“তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৬৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭১)
অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করা যায়। একভাগ নিজেদের ও একভাগ প্রতিবেশীদের যারা কুরবানী করেনি এবং এক ভাগ ফকীর-মিসকীনদের। প্রয়োজনে বণ্টনে কমবেশী করাতে কোন দোষ নেই (সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম ৪/১৮৮; আল-মুগনী ১১/১০৮; মির‘আত ২/৩৬৯; ঐ, ৫/১২০ পৃঃ)
তবে সাবধান!
কুরবানীর গোশত পারিশ্রমিক কিংবা কোন বিনিময়ে দেওয়া যাবেনা। এতে কুরবানী নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যেমন কুরবানীর কাজে সহযোগিতা করার জন্যে কাউকে অতিরিক্ত গোশত দেওয়া, কেউ সব কাজে সহযোগিতা করে সেজন্যে অতিরিক্ত গোশত দেওয়া, অথবা অন্য কোন দুর্বলতা থেকে কাউকে অতিরিক্ত গোশত দেওয়া, অর্থাৎ যে কোন বিনিময়ে কাউকে গোশত দেওয়া ইত্যাদি।
তাই কুরবানীর গোশত থেকে অসচ্ছল আত্মীয়-স্বজন ও অসহায় মিসকিনদের কাছে তাদের প্রাপ্য অংশ যথাযথ ভাবে পৌছে দিতে হবে। এর ফলে কুরবানীদাতার অন্তর পরিশুদ্ধ হবে। আর এটাই হ’ল কুরবানীর মূল প্রেরণা। আজকাল অনেকে গোশত জমা করে সেখান থেকে প্রতিবেশী ও ফকীর-মিসকীনদের কিছু কিছু দিয়ে বাকী গোশত পুনরায় নিজেদের জন্যে রেখে দেন। এটি একটি কুপ্রথা। এর মাধ্যমে কৃপণতা প্রকাশ পায়। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
কুরবানীর পশুর চামড়া:
কুরবানীর পশুর চামড়া ইচ্ছে করলে পরিশোদ্ধ করে কুরবানী দাতা ব্যবহার করতে পারবেন। নিজে ব্যবহার না করলে সেটা গরীব-মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে। আর চামড়া বিক্রি করলে সমস্ত টাকা গরিব, ইয়াতিম, অসহায়দের দিতে হবে। কুরবানি দাতা নিজে চামড়ার মূল্য খরচ করতে পারবে না। যারা জাকাত, ফিতরা পাওয়ার উপযুক্ত তারাই কুরবানির চামড়ার অর্থ পাওয়ার হকদার।
চামাড়া বা চামড়ার মূল্য দেওয়ার বেলায় নিচের ধাপগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. নিজে ব্যবহার।
২. গরীব-মিসকিনকে দেওয়া।
৩. সাধারণ গরীব থেকে নিকট আত্মীয় গরীবকে দেওয়া উত্তম, কারণ এক সাথে দুটি হক্ব আদায় হয়, গরীবের হক্ব ও আত্মীয়তার হক্ব।
৪. আরো উত্তম গরীব মাদরাসা ছাত্রকে দেওয়া। এতে গরীবের হক্ব আদায় হয়, নবীর মেহমানকে সাহয্য করা হয়, সদকায়ে জারিয়া হয়।