কিওয়ামাহ : মুসলিম পরিবারে পুরুষের ভূমিকা 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২০, ১৪:৪৬

•ইফতেখার জামিল•


আমাদের পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা। পরিবার মানুষের প্রথম ও শেষ আশ্রয়। পার্থিব কোন সম্পর্কই পারিবারিক সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে বাড়ছে হতাশা, বিষাদ, আত্মহত্যা, অপরাধ প্রবণতা, মাদকে আসক্তি ও মানসিক সমস্যা। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার জন্য পুরুষের দায় অনেক বেশী। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজে দায়িত্বশীল বাবা ও স্বামীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে দায়িত্বশীলতাকে ইসলামের ভাষায় কিওয়ামাহ বলে। এই লেখায় কিওয়ামাহ’র ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করবো।

 

আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার মধ্যে ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ নারীর দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। কেননা পুরুষ এই দায়িত্বশীলতার বিশিষ্টতার অধিকারী, পাশাপাশি খরচের জিম্মাও তার ওপর। ( সূরা নিসা, আয়াত ৩৪) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাংসারিক পরিচালনার দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছেন, সরল দৃষ্টিকে একে অপ্রয়োজনীয় ও অসম্মানজনক মনে হলেও তলিয়ে দেখলে এর গুরুত্ব বুঝা যাবে। ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব অনেক। তিনজনের ছোটদলও যদি সফর করে, তাহলে যে কোন একজনকে দায়িত্বশীল নির্ধারণের নির্দেশনা রয়েছে হাদিস শরীফের মধ্যে।

ইসলামে একাকী সমাজবিচ্ছিন্ন থাকার কোন সুযোগ নেই। নবীজির হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একাকী নফল ইবাদত করার চেয়ে সামাজিক জীবন যথাযথভাবে পালন করা বেশী প্রয়োজনীয়। কেননা একাকী জীবনে পদস্খলনের আশঙ্কা অনেক বেশী, বিষাদগ্রস্থতা, দায়িত্বহীনতা ও অপ্রাসঙ্গিক জীবন যাপনের ঝুঁকিও অনেক বেশী। ইসলাম সামাজিকভাবে জীবন যাপনে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়। মানুষ তো আল্লাহর খলিফা, শুধু আল্লাহর ইবাদত নয়, সামাজিক জীবনে আল্লাহর আহকাম বাস্তবায়ন করাও মানুষের মৌলিক দায়িত্ব। এখান থেকেই সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ এসেছে। এই পারিবারিক দায়িত্বশীলতাকেই কিওয়ামাহ বলা হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু পুরুষ কেন মূল দায়িত্বশীল হবে, সব পুরুষ কি নারীদের চেয়ে অধিক যোগ্য, এটা তো সরাসরি নারীবিদ্বেষী অবস্থান। আদতে অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর থেকে স্ত্রী বেশী যোগ্য হতে পারেন, অধিক মেধাবী ও দ্বীনদারও হতে পারেন। আল্লাহ কোরআনের মধ্যে বারবার বলেছেন, সৎ কর্মের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষ সমান প্রতিদান পাবে। পুরুষ মাত্রই নারীর চেয়ে বেশী যোগ্য ও মেধাবী, এটা ইসলামি অবস্থান নয়। সূরা হুজুরাতে আল্লাহ বলেছেন, শুধুমাত্র তাকওয়া ও দ্বীনদারিতার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হতে পারে।

বস্তুত যিনি দায়িত্বশীল হন, তিনিই সবসময় শ্রেষ্ঠ হবেন, সেটা জরুরী নয়। দায়িত্বশীলতা তো বিশেষ জিম্মাদারী, শ্রেষ্ঠত্বের সনদ নয়। তাই কোন পুরুষ যদি কিওয়ামাহ’র ভিত্তিতে নারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে একে কোনভাবেই সমর্থন করা যাবে না। আবু জর গিফারি রাঃ দ্বীনদারিতায় অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও কখনো দায়িত্বশীল হননি। দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ উপযুক্ততার সাথে সম্পৃক্ত, যে যে কাজের উপযুক্ত সে সেই কাজের দায়িত্বগ্রহণ করবে। পাশাপাশি ইসলামে কর্তৃত্বপরায়ণ হবার সুযোগ নেই। উপযুক্ত ব্যক্তি পরামর্শের মাধ্যমে দায়িত্বপালন করবেন।

ফলে কিওয়ামার অনুবাদে কর্তা শব্দ উল্লেখ করা ঠিক নয়, পাশাপাশি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বও দায়িত্বশীলতার কারণ নয়। তাহলে তবুও কেন পুরুষকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, পুরুষ কেন এই কাজের উপযুক্ত? আল্লাহ তাআলা এখানে দু’টি কারণ উল্লেখ করেছেন। ক) পুরুষ রক্ষা ও দায়িত্বশীলতায় নারীর চেয়ে বেশী দক্ষ। পুরুষ শারীরিকভাবে কঠিন কাজে অধিক অভ্যস্ত। খ) পুরুষ নারীদের খরচের দায়দায়িত্ব বহন করেন। নারীও সুযোগ থাকলে উপার্জন করতে পাড়ে, তবে খরচ নির্বাহ করা তার দায়িত্ব নয়। এজন্যই আমরা দেখবো, পশ্চিমা সমাজেও নারীবাদের উত্থান ঘটলেও পুরুষকে বলশালী, বডিবিল্ডার ও শারীরিকভাবে ক্ষমতাবান হিসেবে দেখানো হয়।

পরিবার হচ্ছে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। সমাজকে যদি শরীর হিসেবে ধরেন, তাহলে পরিবার সেই শরীরের কোষ। ইসলাম পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে ভাগ-বণ্টন করে দিয়েছে। এই ভাগ-বণ্টনের ভিত্তি নারীপুরুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ নারী ও পুরুষকে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দায়িত্বে ভাগ-বণ্টন করে দিয়েছে। আমরা পুরুষের মধ্যে দৈহিক মোকাবেলা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেবার প্রবণতা দেখি। আক্রমণাত্মক মানসিকতা দেখি। এর সাথে পুরুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন বিশেষ ভাবে জড়িত।

এখনো নারীপুরুষদের একইসাথে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয় না। ঐতিহাসিকভাবে আমরা পুরুষদেরকেই প্রধানত যুদ্ধ করতে দেখি। শারীরিক ও মানসিক বিশেষ গঠনের কারণে তারাই সবচেয়ে বেশী সহিংসতা ও মারামারির সাথে যুক্ত। জেলখানাগুলোতেও এই কারণে পুরুষ আসামীর সংখ্যা অনেক বেশী। অপরদিকে নার্স-প্রাথমিক শিক্ষকতায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশী। একইভাবে লিডারশীপের পজিশনে পুরুষদের সংখ্যা বেশী। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, পুরুষদের শারীরিক ও মানসিক বিশেষ সামর্থ্য বিষয়টি সাধারণভাবে প্রযোজ্য, সর্বক্ষেত্রে নয়। কোন বিশেষ নারীর চাইতে অনেক পুরুষ শারীরিক সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকতে পারেন।

এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যতার ভিত্তিতে আল্লাহ পুরুষকে পারিবারিক দায়িত্বশীলতা ও খরচের দায়িত্ব দিয়েছেন। নারীকে সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন, স্তনদান, ঘরের দায়িত্ব ও বৈবাহিক আনন্দ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, পুরুষ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও একে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ববাদ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কেননা আগেই যেমন বলেছি শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি তাকওয়া। পাশাপাশি ইসলামে সকল পরিচালনা শুরা ও মুশাওয়ারার ওপর নির্ভরশীল। একক কর্তৃত্ববাদ ফিরাউনি বৈশিষ্ট্য। ফিরাউন কোনভাবেই ইসলামি আদর্শ নয়।

যদি একটি চিত্রের কথা চিন্তা করেন। রাতের বেলা দরজায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হচ্ছে। ইতিহাসে এই বিষয়ে যত লেখাজোখা আছে, সেগুলোর পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পুরুষই সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দরজা খুলতে যান, নারীদেরকে গোপন আশ্রয়ে যেতে বলা হয়। এই আক্রমণকামী প্রবণতার কারণেই পুরুষ ধর্ষকদের সংখ্যা নারী ধর্ষকদের চাইতে অনেক ও অনেক বেশী। এর যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়, তবে ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

অনেকে দাবী করেন, নারী-পুরুষের এই শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য সমাজ তৈরি করেছে, এই বৈশিষ্ট্য তাদের দৈহিক বিষয়। তারা বলেন, সমাজ নারী ও পুরুষের ধারণা সৃষ্টি করেছে। জন্ম থেকে পুরুষকে নারী হিসেবে বড় করলে সে নিজেকে নারী হিসেবেই চিহ্নিত করবে, নিজেকে পুরুষ হিসেবে ভাববে না। তবে এই দাবী সত্য নয়। কেননা এখন আপনি চাইলে অপরেশনের মাধ্যমে লিঙ্গপরিবর্তন করতে পারবেন। তবে লিঙ্গ পরিবর্তন করলেই শারীরিক গঠন পরিবর্তন করা যায় না। নির্দিষ্ট অঙ্গের গোশত কর্তন বা সংযুক্তির মাধ্যমে সারা শরীরের পেশি ও মানসিক গঠন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

এসব কারণে আরটি থেকে প্রকাশিত এক ডকুমেন্টরিতে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবর্তিত লিঙ্গের লোকেরা আগের লিঙ্গে ফেরত যেতে চায়, অনেকে আত্মহত্যা করে। ফলে শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যকে নিছক সামাজিক সৃষ্টি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু লিঙ্গের পরিবর্তনে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে না, তাই লিঙ্গ পরিবর্তিত নারীদের প্রকৃত নারীদের সাথে খেলায় অংশগ্রহণ করা এখনো বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে নানারকম কেমিক্যাল ব্যবহার করে নারী বানানোর চেষ্টা করা হয়। তবে কখনোই নারী-পুরুষকে একইসাথে খেলায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু পুরুষ কেন খরচের দায়িত্ব বহন করবে, নারীরাও তো উপার্জন করতে পারে। সময় ও সুযোগ থাকলে নারীদের উপার্জনে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ কোন বাঁধা নেই। তবে ইসলাম নারীর কাঁধে এই দায়িত্ব দেয়নি। কেননা নারীরা কঠিন কাজের দায়িত্ব নিলে তাতে তাদের ঘরের কাজ ব্যাহত হতে পারে। ফুলটাইম জবের যে পরিমাণ ক্লান্তি ও পরিশ্রম, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক নারীর পক্ষে সবকিছু কুলিয়ে উঠা সম্ভব হয়ে উঠে না। পাশাপাশি এই সুযোগে অনেকে নারীর রুপ ও শরীর ক্রয়ের চেষ্টা করেন। রিসিপশন ও বিজ্ঞাপনের মতো স্পর্শকাতর কাজে নারীকে ব্যবহার করা হয়।

পাশাপাশি ঘরে ফিরে নারীকে তার সেই আগের দায়িত্বই পালন করতে হয়। সন্তান যথাযথ যত্ন ও আদর থেকে বঞ্চিত হয়। ঘন ঘন একাধিক বাচ্চা হলে হয়তো নারীকে তার ফুলটাইম কাজে অনিয়ম করতে হয় বা সন্তানের যত্নে ত্রুটি হয়। আমরা জানি, কাজের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দায়িত্বের বিশেষ ভূমিকা আছে। প্রত্যেকে এক কাজ না করে দায়িত্ব ভাগ করে নিলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে সমাজ ও জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হয়। যে নারী সমাজে বিশেষ সার্ভিস দিতে চান, তিনি পরিবারে বিশেষ সময় দিয়ে সমাজের একটা বিশেষ ইউনিটকে শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। এভাবেই প্রকৃতপক্ষে সমাজ বেশী উপকৃত হয়।

তবে বলে রাখা ভালো, মৌলিক দায়িত্বপালন করতে পারলে নারীর জন্য চাকরীতে যোগ দেবার সুযোগ রয়েছে। ঘরে গৃহকর্মী ও সাহায্যকারী রেখে পরিশ্রম ভার কমিয়ে গৃহিণীর দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি সামাজিক কাজ ও শ্রমেও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে বাঁধা দেয়নি। তবে কোনভাবেই নারীর ওপর বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক দায়িত্ব চাপায় নি। যেমন পুরুষের ওপর সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন, স্তনদান, ঘরের পরিচালনা ও বৈবাহিক আনন্দ আয়োজনের দায়িত্ব দেন নি।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়কে তার পরিমাপ মতো সৃষ্টি করেছেন। ( সূরা কাদর, আয়াত ৪৯)। আল্লাহ দুনিয়াতে অনেক প্রাকৃতিক নীতি তৈরি করে দিয়েছেন, মানুষ চাইলেও এগুলোকে অতিক্রম করতে পারবে না।