কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ও কুফুরী আক্বীদাসমূহ
একুশে জার্নাল
জানুয়ারি ১৯ ২০২০, ২২:৩০
।। শায়েখ মুহিউদ্দীন ফারুকী ।।
প্রাককথন: সাম্প্রতিক সময়ে ভ্রান্ত কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের বিষয়টি জোড়ালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। উলামায়ে কেরাম ও তাওহীদি জনতা তাদেরকে কাফের ঘোষণা প্রদানের দাবীতে আবার সরব হয়েছেন। এমতাবস্থায় অনেক সাধারণ মানুষ তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-দর্শন এবং কার্যক্রম সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। অনেকেই তাদেরকে মুসলমানদের বিভিন্ন দলের একটি দল ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় কাদিয়ানী সম্প্রদায় যে একটি ভ্রান্ত ও কাফের সম্প্রদায়; কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা যে কাফের এবং তাদের কাফের ও ভ্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে যে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই — সে বিষয়টি সহজে জানা ও বুঝার জন্য তাদের ভ্রান্ত ও কুফুরি মতবাদসমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
পরিচিতি
কাদিয়ানী মতবাদ একটি ভ্রান্ত ও কুফুরী মতবাদ। এই মতবাদটি ১৯০০ সালে ইংরেজ উপনিবেশবাদের পরিকল্পনায় কাদিয়ান নামক এলাকার মির্জা গোলাম আহমাদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদেরকে তাদের ধর্ম থেকে দূরে রাখা; বিশেষত জিহাদের ফরয দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা; যেন তারা ইসলামের নামে উপনিবেশবাদকে মোকাবিলা করতে না পারে।
প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠাতা
মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৯ ঈ.-১৯০৮ঈ.) ছিল এই কুফুরী ও ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। সে ১৮৩৯ঈ. ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার বেড়ে ওঠা এমন এক পরিবারে, যাদের সাথে ইংরেজদের সখ্যতা ও সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। তারা দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল পূর্ব থেকেই। ইংরেজদের বিভিন্ন সহানুভূতি আর সহযোগিতার কারণে গোলাম আহমাদ তাদের গোলাম হয়ে বড় হতে থাকে। তার আচরণ আর স্বভাবে অনুগত ভৃত্যের ভাব ফুটে ওঠে। একপর্যায়ে ইংরেজরা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ তৈরী এবং তাদের বিরুদ্ধে যেন সকলেই জিহাদ থেকে বিরত থাকে সেজন্য তাকে নবুওয়ত দাবী করার জন্য মনোনীত করে এবং সেও তা মেনে নেয়। মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৯০৮ সালে ধ্বংস হয়।
আক্বীদা-বিশ্বাস
মির্জা গোলাম আহমাদ একজন মুসলিম দাঈ হিসেবে তার কর্ম তৎপরতা শুরু করে। এক পর্যায়ে সে তার কিছু সমর্থক পায়। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সে দাবী করে যে, সে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত। এরপর আরও একধাপ এগিয়ে সে নিজেকে ‘মাহদি মুনতাজার’ বা প্রত্যাশিত মাহদী ও ‘মসীহ মাওউদ’ প্রতিশ্রুত মসীহ দাবী করে। অতঃপর একপর্যায়ে সে নবুওয়ত দাবী করে। সে দাবী করে যে, তার নবুওয়ত আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওতের চেয়ে উচুঁ পর্যায়ের।
ইংরেজ শাসনের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এবং তাদেরকে খুশী করনার্থে তারা তাদের আক্বীদায় জিহাদ বাতিলের আক্বীদা প্রবেশ করায়। তারা জিহাদকে বিলুপ্ত করে ইংরেজ শাসনের আনুগত্য কারা আহ্বান জানায় এবং ইংরেজদেরকে ‘উলুল আমর’ হিসেবে ঘোষণা করে।
কাদিয়ানীরা এই আক্বীদাও পোষণ করে যে, আল্লাহ তা’য়ালা রোযা রাখেন, নামায পড়েন, ঘুমান, ঘুম থেকে জাগেন, লেখেন, ভুল করেন, সহবাস করেন। (নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক)। এসকল আক্বীদা যেমন বিবেক ও রুচি বিবর্জিত, তেমনই কোরআন ও হাদিসের সরাসরি বিরোধিতা। আল্লাহ তা’য়ালা এমনসব ধারণা ও আক্বীদা থেকে পরিপূর্ণ পবিত্র।
ভ্রান্ত কাদিয়ানীরা খতমে নবুওয়তের আক্বীদার পরিপূর্ণ বিরোধিতা করে। তারা বলতে চায় যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে রিসালাত ও নুবুওয়তের সমাপ্তি হয়নি, বরং এই ধারা চলমান। অতএব যখন প্রয়োজন হবে তখন আল্লাহ তা’য়ালা নবী প্রেরণ করবেন।
তাদের আক্বীদা হচ্ছে, যতক্ষণ না কোনো ব্যক্তি মির্জা গোলাম আহমাদকে নবী না মানবে সে চিরস্থায়ী কাফের এবং জাহান্নামী হবে। তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধন জায়েয হবে না। এমনকি তার জানাযা নামাজ পড়াও বৈধ হবে না।
তারা বিশ্বাস করে যে, গোলাম আহমাদের উপর জিব্রাইল আ. নাযিল হত এবং তার নিকট ওহী পাঠানো হতো। তার কাছে প্রেরিত ওহীগুলো কুরআনের মতই। তার মনগড়া দাবি ও ইলহামও নাকি কুরআনের মত ওহী।
তারা কুরআন এবং হাদিসকে অস্বীকার করতো। তাদের দাবী, মির্জা গোলামের কুরআনের সাথে অন্য কোরআন চলবে না। এবং তার কথা, আলোচনাই হাদিস। অতএব অন্য কোনো হাদিস চলবে না। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই কুরআনে কারীমকে কেয়ামত পর্যন্ত হেফাজত করবেন।
কাদিয়ানীদের বিশ্বাস হচ্ছে, তাদের কিতাব নাযিলকৃত। সে কিতাবের নাম হচ্ছে- “আল-কিতাবুল মুবীন”। তবে সেটি কুরআন নয়। কুরআন ভিন্ন অন্য কিছু।
তারা বিশ্বাস করে যে, তারা আলাদা নতুন এক ধর্ম ও নতুন এক শরিয়তের অনুসারী এবং গোলামের সঙ্গীগণ সাহাবীদের মত।
তারা কাদিয়ান নামক এলাকাকে মদিনা ও মক্কা থেকে পবিত্র মনে করে, এমনকি এর চাইতেও উত্তম ভাবে। কাদিয়ানের ভূমি হারাম অর্থাৎ সম্মানিত ও সংরক্ষিত। সেটা তাদের কিবলা ও হজ্জ পালনের স্থান।
মির্জা গোলাম রাসূলে কারীম সা. এর শানে অবতীর্ণ আয়াতসমূহকে নিজের ওপর প্রয়োগ করে। এর মাধ্যমে তারা আয়াতের তাহরীফ ও ভুল ব্যখ্যা করে।
ইসলামে নিষিদ্ধ এমন অনেক হারামকে তারা হালাল বা বৈধ হিসেবে মত প্রদান করে। যেমন তারা মাদকদ্রব্য ও নেশাজাতীয় জিনিসকে বৈধ মনে করে।
তারা দাবী করে যে, তাদের উপাস্য ইংরেজ। যেহেতু তিনি তাকে ইংরেজী ভাষায় সম্বোধন করেন।
তারা মনে করে যে, কাদিয়ান এলাকায় মির্যা গোলামের নির্মিত মসজিদই কুরআনে বর্ণিত মসজিদে আকসা।
তাদের ধারণা ও বিশ্বাস হচ্ছে যে, কাদিয়ান এলাকায় জলসা করা হজের সমান।
এজাতীয় আরও অনেক আক্বীদা ও বিশ্বাস রয়েছে যা কুরআন ও হাদিসের সাথে এমনকি সাধারণ বিবেকের সাথেও সাংঘর্ষিক। এসব আক্বীদা-বিশ্বাস ইসলাম ও মুসলমানদের আক্বীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী। এতে এবিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, মির্জা গোলাম প্রবর্তিত কাদিয়ানী ধর্ম একটি ভ্রান্ত ধর্ম। তাদের আক্বীদা কুফুরী আক্বীদা। তারা কোনো ভাবেই মুসলিম হতে পারে না।
কর্মতৎপরতা
কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের নিজেদের চিন্তা, আদর্শ আর আক্বীদা-বিশ্বাসকে প্রচার-প্রসার করার জন্য বিভিন্ন উপায় ও মাধ্যম গ্রহণ করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের ব্যাপক কর্মতৎপরতা রয়েছে। বাংলাদেশেও ভয়াবহভাবে বেড়েই চলেছে তাদের কার্যক্রম। তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে মসজিদ নির্মাণ করেছে। এসব মসজিদ সাধারণ মসজিদের মত নয়। বরং সেখানে শুধু তারাই উপাসনা করতে পারবে। বাইরের কেউ সেখানে যেতে পারবে না। এমনকি কোনো সাধারণ মুসলমানও তাদের মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারবে না।
বাংলাদেশে তাদের প্রধান উপাসনালয় হচ্ছে বকশিবাজারে। সেখান থেকেই তারা বাংলাদেশের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া তাদের নিজস্ব মিডিয়াও রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা তাদের কার্যক্রমের প্রচার চালিয়ে থাকে।
আমাদের করণীয়
এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া। তাদের মিথ্যাচার ও বাতিল অপব্যখ্যায় প্রতারিত না হওয়া। তাদেরকে কাফের ঘোষণা করার জন্য সামর্থ অনুযায়ী হেকমতপূর্ণ কাজ করতে থাকা। নিজে সতর্ক থাকা এবং আপনজনদেরকে এই কুফুরী ও ভ্রান্ত মতবাদ থেকে দূরে রাখা। সরলপ্রাণ মুসলমানরা যেন ধোঁকাগ্রস্ত না হয় সে জন্য দাওয়াতী কাজে ব্যাপক সময় দেওয়া। পরিকল্পিত দাওয়াহ কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করা।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, এই ছোট্ট নিবন্ধে কাদিয়ানীদের মৌলিক ভ্রান্ত আক্বিদা বিশ্বাসগুলো আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে, কাদিয়ানী সম্প্রদায় একটি ভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়। এদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ইসলামের কোনো শাখাগত দলও নয়।
এবিষয়ে আপনি বিস্তারিত জানতে চাইলে কিছু বই পাঠ করতে পারেন। এর মধ্যে অন্যতম ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায় তত্ত্ব ও ইতিহাস’ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী রহ. (মাকতাবাতুল আযহার)। ‘খতমে নবুওয়ত’ মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। ‘কাদিয়ানীরা অমুসলিম কেন? মাওলানা মানযুর নুমানী রহ. (রাহনুমা প্রকাশনী)। ‘কাদিয়ানী মতবাদ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ’ এহসান এলাহী জহীর (ইসলাম হাউজ.কম)। মাসিক আলকাউসারের সৌজন্যে প্রকাশিত ‘ইসলাম ও কাদিয়ানিয়ত দুটি আলাদা ধর্ম’ মাওলাসা মুহাম্মদ ইদরীস কান্ধলভী রহ.।
এছাড়াও কাদিয়ানী বন্ধুদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য বিনীতভাবে কয়েকটি পুস্তিকা রচিত হয়েছে। যা পড়লে আপনি তাদের ধর্মমত সম্পর্কে জানতে পারবেন। সেই সাথে তাদের বিভিন্ন যুক্তি খন্ডনসহ তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। সেই বইগুলো হচ্ছে, ‘আহমদী বন্ধু! ইসলামই তোমার আসল ঠিকানা’ মাওলানা আব্দুল মজিদ। ‘আহমদী বন্ধু ইসলামে ফিরে এসো’ মুহাম্মদ নূরুন্নবী।
এছাড়া আপনি সরাসরি প্রশ্ন করে বা আরও বিশদভাবে তাদের বিষয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে মারকাযুদ্দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার দাওয়াহ বিভাগের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে হেদায়েতের উপর অটল অবিচল রাখুন। মুমিন হিসেবে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وآله وأصحابه أجمعين.
লেখক: মুহিউদ্দীন ফারুকী, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ।