কাতার বিশ্বকাপ: একটি সাংস্কৃতিক লড়াই ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়
একুশে জার্নাল ডটকম
নভেম্বর ২১ ২০২২, ২৩:৪৩
সৈয়দ শামছুল হুদা:: কাতার বিশ্বকাপ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এটা নিয়ে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী আইডিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে ট্রলবাজি। তাদের অনেকের লেখায় মনে হয়, কাতারের আমীর বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্বে ইসলামী খেলাফত কায়েমের ডাক দিয়েছিলেন, আবার কারো কথায় মনে হয় এটা করে কাতার মুসলিম বিশ্ব থেকেই খারিজ হয়ে গেছে। আসলে আমি এর কোনোটাই মনে করি না। আমি মনে করি, আর দশটা বিশ্বকাপের মতোই এটা একটা সাধারণ খেলা। এটা নিয়ে বাড়তি মাতামাতির কিছুই নেই। এখানে আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় ফেসবুকীয় মুফতিগণ রাতদিন ফতোয়া দিয়েই যাচ্ছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি নিজেও যে হাসির পাত্র হচ্ছেন, ইসলামকেও হাসির পাত্র বানাচ্ছেন তা অনুভব করছেন বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে কাতারের আমীর – ডা. জাকির নায়েককে কেনো সেই খেলার মুহুর্তে ডেকে নিলেন, এটা নিয়েও নানামুখি চুলকানি। আবার তৃতীয় পক্ষের কিছু কুচক্রী পুরাতন নানা খবর দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন সাধারণ মানুষকে। এতজন ইসলাম গ্রহণ করেছে, বিশ্বকাপের আগেই এতজন মুসলিম, মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, এসব খবরে ফেসবুকের ওয়াল ভরে যাচ্ছে। খেলাকে কেন্দ্র করে এসব বিষয় ভালোই উপভোগ করছেন আমার দেশের ফেসবুকাররা। আমি মনে করি, আসলে খেলা নিয়ে এত মাতামাতিরও কিছু নেই, আবার এটা নিয়ে একটি মুসলিম দেশকে তুলোধুনো করারও কিছু নেই। তবে, আমি এ প্রসঙ্গেই ভিন্ন কিছু কথা বলবো।
দুনিয়ার অনেক দেশের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে, সেটার কোনো দেশ হিন্দু, কোনো দেশ ইহুদী, কোনো দেশ বৌদ্ধ, কোনো দেশ খ্রীষ্টান। কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্রকেই সে দেশের ধর্ম দিয়ে আখ্যায়িত করা হয় না। ব্যতিক্রম একমাত্র পাকিস্তান। মুসলিম দেশের কাছে কেনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে? অতএব, এটার নাম হলো, ইসলামী বোমা। ইসরাইলেরটা ইহুদী বোমা না, চীনেরটা বৌদ্ধ বোমা না, ভারতেরটা হিন্দু বোমা না, আমেরিকারটা খ্রীষ্টান বোমা না। কিন্তু পাকিস্তানেরটা ইসলামী বোমা। এ প্রেক্ষিতেই আজকের কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যেও একই আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশে খেলা হয়েছে। সেটা নিয়ে ধর্মীয় মাতামাতি হয় নাই। প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে তুলে ধরেছে। এ নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু কাতার যখনই তার নিজ খরচে, নিজ দেশে খেলার আয়োজন করতে গিয়ে কাতারের দীর্ঘদিনের নানা সংস্কৃতি তুলে ধরতে চাইছে, তখন সেটাই হয়ে যাচ্ছে ইসলামী বিশ্বকাপ। আমরা মুসলিমরাও এটা নিয়ে ট্রলবাজি করছি।
তবে মনে রাখবেন, আমরা কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে যতই ট্রলবাজি করি না কেন, এর সুদূর প্রসারী সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আছে। কাতার বিনা কারণেই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে নাই। কাতারের একের পর এক কঠিন সিদ্ধান্ত গোটা দুনিয়ার সকল শক্তিকে মেনে নিতে হচ্ছে। বিশ্বকাপ হবে আর আকামের ছড়াছড়ি হবে না, মদ, গাঁজা আর নারীবাদীদের উলঙ্গ মাতামাতি হবে না তা কি কোনোদিন কল্পনা করা গেছে? আজ সেটাই করে দেখাচ্ছে কাতার। এই খেলাটাই আরবদের অন্য কোনো দেশে হলে সেটা লেজে-গোবরে অবস্থা হয়ে যেতো। পশ্চিমাদের খুশি করতে গিয়ে ইসলামকে তাদের পদতলে সপে দিতো। কিন্তু কাতার ছোট্ট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটি সিদ্ধান্তে সে কঠোর ও অনঢ়। খেলার আসরে মদ চলবে না, অশ্লীল পোশাক চলবে না, সমকামিতা চলবে না, এটা গোটা ইউরোপের পাগলা সমর্থকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে।
ইউরোপ কাতারের সমালোচনায় মাঠে নেমে আসে। তারা কাতার নিয়ে নানা ব্যঙ্গ করতে থাকে। কিন্তু কাতার চুল পরিমাণ ছাড় দেয়নি। উপরুন্তু ফিফা সভাপতির মুখ দিয়ে যে কথাটা বের হয়েছে এটা হাজার কোটি টাকা খরচ করেও হয়তো বের করা যেতো না। কাতারের অসাধারণ আয়োজন, সামর্থের প্রমাণ প্রদর্শন ইত্যাদিতে মুগ্ধ হয়ে ফিফা সভাপতি গোটা ইউরোপকে যে বার্তা দিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। তিনি বলেন, ইউরোপ অতীতে মুসলিম বিশ্বের সাথে যে অসভ্য আচরণ করেছে, গত ৩হাজার বছর ধরে যা করেছে, তার জন্য আগামি ৩হাজার বছর তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
কাতার বিশ্বকাপ গোটা ইউরোপে একটি সাংস্কৃতিক বার্তা দিতে সক্ষম হবে। দর্শকদের কাছে ইসলামকে আধুনিক যুগের উন্নত প্রযুক্তির ব্যাবহার করে সমুন্নত করতে যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে কোনো মুসলমান তিরস্কার করতে পারে না। কাতার বিশ্বকাপে এগুলো না করে মাগী আর মদ নিয়ে মাতামাতির আসর জমালে আমাদের কি কিছু করার ছিল? কিছুই ছিল না। কিন্তু কাতার সেটা করেনি। তারা মেরুদন্ড সোজা রেখেছে। আমি মনে করি, এজন্য কাতারকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। গোটা পাশ্চাত্য শক্তির কাছে একটি ছোট্ট দেশ কাতার তার অর্থনৈতিক সামর্থের যে আলোরছটা ছিটিয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। সারা দুনিয়ার মানুষ মুসলমানদেরকে সবসময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। মুসলিম দেশগুলোকে ফকীর-মিসকীনের দেশ বলতো। আজ তারা যখন দেখবে যে, একটি ছোট্ট মুসলিম দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক সামর্থ কতটা উন্নত, তখন তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে। অজান্তেই তারা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে হেরে যাবে। তাদের সভ্যতা যে মিথ্যে, ভুঁয়া, অনৈতিকতায় ভরা সেটা প্রমাণিত হবে।
সর্বোপরি, সারা দুনিয়ার চোখ এখন কাতারের দিকে। কাতার কী করছে, খেলায় তারা কী ব্যতিক্রম আয়োজন করেছে, কাতার কীভাবে এতবড় একটি আয়োজনকে সম্ভব করেছে তা নিয়ে ভাববে। অতএব খেলাকে খেলার দৃষ্টিতেই দেখুন। এখানের প্রতিটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করুন। সময় নিন। তারপর বিশ্লেষণ করুন, কাতার এই খেলা আয়োজন করে মুসলমানদের ক্ষতি করেছে না কি ভালো করেছে। কাতারের এই আয়োজনে মুসলমানদের পক্ষে ভবিষ্যতে ভালো কিছু হবে নাকি ক্ষতিই হবে। তবে, কাতার ইতিমধ্যেই নিজেকে একজন সক্ষম ও সামর্থবান বিশ্ব খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেছে। কাতারের জন্য শুভকামনা।