করোনা সঙ্কটকাল: অভাবী ঋণগ্রস্তকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ইসলাম কী বলে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১১ ২০২০, ১৪:৩১

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দিন আহমদ

আল্লাহ পাক বলেন,তোমরা যে কোন সৎকাজ কর না কেন,আল্লাহ তা’য়ালা তা সম্যকরূপে অবগত । ( সুরা বাকারা: আয়াত ২৪৫ )

কোভিড ১৯ প্রাণঘাতী ভাইরাস বা সংক্রামক রোগ। যা করোনা কোভিড১৯ নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত। গেল বছর ডিসেম্বর মাসে চীনের ওহান শহর থেকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির সূচনা হয়।

দীর্ঘ ছয়টি মাসের অধিক সময় ধরে নভেল কোভিড ১৯ তথা করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব সমগ্র বিশ্বে আদৌ চলমান ।

প্রাণঘাতী এ করোনা ভাইরাসের ভয়াল সংক্রমণে লক্ষ লক্ষ মানুষের পার্থিব জীবনের ইতি ঘটেছে ।

সমগ্রর বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ উক্ত ভাইরাসের আঘাতে আক্রান্ত হয়ে আছেন মৃত্যুর পথের যাত্রী।

তদুপরি উক্ত ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতা এতটাই সর্বনাশা যার আতঙ্কে সমগ্র বিশ্বের সামাজিক জীবন ব্যবস্থা আজ খুবই বিপর্যস্ত ও নিস্তব্ধ । ব্যক্তিগত জীবন,পারিবারিক এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা আজ কঠিন সঙ্কটে উপনীত।

শুকরান-লিল্লাহ্:এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও দেখা যাচ্ছে রব্বে কারিমের অশেষ দয়া ও কৃপায় করোনায় আক্রান্ত অনেক রোগী সুস্থ হয়েও ফিরছেন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ।

প্রাণঘাতী নভেল এই করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা আজ স্পষ্ট । মানুষ বুঝেছে, যদি এবার তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, তাহলে তাদেরকে অনেক কিছুই করতে হবে।

করোনায় ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যাংকিং লেন-দেনে সঙ্কট তৈরীর ফলে দেশের অর্থনৈতিক শক্তিও আজ চরম ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে ।

করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি কেমন হবে, কীভাবে এই আর্থিক মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে- তা নিয়ে প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদের মতো করে পলিসি তৈরি করছে; দিচ্ছে প্রণোদনা।

অসহায় অসচ্ছল কর্মহীন মানুষের পাশে সরকারের পাশাপাশি এদিকে সাহায্য সহযোগীতার হাত প্রসারিত করেছেন অনেক ভিত্তশালী দানশীল ব্যক্তিরাও ।

এই সঙ্কটময় মুহূর্তে অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে। যা অত্যন্ত ভালো ও প্রশংসনীয় কাজ।

মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করে কীভাবে এই কঠিন সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসা যায়,সেটাই এখন সব দেশের সরকার এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

সে হিশেবে বাংলাদেশ সরকার দেশের অর্থনীতি সঙ্কট কেটে উঠতে এবং আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ফ্যাক্টরি,কল-কারখানা ও অফিস আদালত ঈদের পর উন্মুক্ত করে দেয় ।

সারা দেশে সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য শপিং মল এবং সড়ক ও রেল পথগুলো সাময়িকভাবে কিছুদিন চালু থাকলেও আবার বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা চলছে সরকারের পক্ষ থেকে ।

কারণ দেশে এখন নভেল করোনা পরিস্থিতি দিনদিন অবনতির দিকে হাটছে । প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে ।

এদিকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ এবং ভার্সিটিগুলোর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম দীর্ঘ তিন মাসের অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে ।

করোনায় দেশের আর্থিক সঙ্কটের পাশাপাশি শিক্ষা ও মেধা বিকাশের সম্ভাবনাটুকু আজ হুমকির মুখে ।

কবে থেকে যে শুরু হবে নতুন বর্ষের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম তা এখন অনিশ্চিত। শুধু তাই নয়, বরং লকডাউনের ফলে দেশে দরিদ্রতার হার বৃদ্ধি পাাচ্ছে বা পাবে প্রতিনিয়ত।

দেশের প্রতিটি কৃষকশ্রমিক ও খেটে খাওয়া দিনমজুর, গরীব-অসহায় অসচ্ছল লোকজন কর্মহীন হয়ে আজ মানবেতর জীবনযাপন করতেছেন।

কঠিন এই সঙ্কট মুহূর্তে অনেকে আবার তাদের উপর অতিরিক্ত নতুন ঋণের বোঝা নিয়েও অসচ্ছলতাকে আরো বৃদ্ধি কতেরছেন।

বিশেষ করে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যারা অল্প বেতনের চাকরি করেন,এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেন, ছোট ব্যবসা করেন, তাদের বিপদ তারা নিজেরাও।

এমনকি অনেক ব্যবসায়ীরা দোকান মালিকের ভাড়ার টাকা,ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালাদের বাসা ভাড়ার টাকা ও পুরাতন ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ আদায়ের টেনশন নিয়ে কঠিন সময় পার করতেছেন ।কারণ,এদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে তাদেরকে কেউ সাহায্য করবে। তাই তাদের অনেকেই এমন আছেন অসহায়ত্ব ও অসচ্ছলতার কষ্টকে যারা মনের ভিতরে চাপা দিয়ে রেখেছেন ।

নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে পার করছেন পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নিয়ে জীবনের সঙ্কটময় মুহূর্তগুলো । যাদের প্রকৃত অবস্থা মহান আল্লাহ পাক ভালোই জানেন ।

তাই এখানে সরকারের পাশাপাশি ভিত্তশালী ও সকল সামাজিক সংগঠনেরও দায়িত্ব রয়েছে অনেক। এখনি সময় একটা সুশৃঙ্খল ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা তৈরি করে এই সকল মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

চলমান করোনা সঙ্কট মুহূর্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করতে দোকান পাট ওপেন করতে পারছেন না,তাদের দোকান ভাড়া মাফ বা মওকুফ করার ব্যাপারে রয়েছে মালিকদের উদারতা দেখানোর দায়িত্ব ।

এভাবে দিনমজুর খেটে খায়,কর্মহীন হয়ে যারা আর্থিক সঙ্কটের ফলে বাসা ভাড়া স্বল্প কিংবা বেশি যা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন,তাদের ব্যাপারেও বাড়ির মালিকদের উদারতা দেখানো সময়ের দাবী ।

তাছাড়া পুরাতন ঋণগ্রহীতা যারা আদায়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করোনা সঙ্কট পরিস্থিতির ফলে ঋণ পরিশোধে অক্ষম তাদের প্রতি ভিত্তশালী প্রাপকদের পক্ষ থেকেও উদারতার দৃষ্টি দেখানো বা সহযোগিতা করা মানবিক উত্তম গুণের চাহিদা। তখন এটাও হবে সামাজিকতার প্রকৃত একটি রূপ ।

এমনকি সামাজিকতাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে ইসলাম। নানাভাবে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান করেছে মানুষের সামাজিক পথচলায়।

মানব জীবনের পথচলায় ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করা বা পারস্পরিক সহযোগিতা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সামাজিক বিষয়।

ইসলাম এ বিষয়ে বেশ ভালো পদ্ধতি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। বিপদে-আপদে, বিভিন্ন প্রয়োজনে এক মুসলমান অপর মুসলমানের কাছে সাহায্যসহযোগিতা চাওয়া ও ঋণ গ্রহণ করার অনুমতি বা সুযোগ প্রদান করেছে ইসলাম। ঋণ গ্রহণ করা হলে সঠিক সময়ে তা পরিশোধ করার প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।

তাই এই করোনা মহামারীর সঙ্কট মুহূর্তে বিপদ গ্রস্ত ও প্রয়োজন গ্রস্ত লোকদের পাশে উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে দাড়ানো সময়ের দাবী।

কুুরআন হাদিসে এব্যাপারে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দিক নির্দেশনা ও ক্ষমা এবং মহা পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে।

আল্লাহ পাক কুরানের ইরশাদ করেন, যদি ঋণগ্রহীতা অভাবগ্রস্ত হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও, তবে তা খুবই উত্তম, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। (সুরা বাকারার:২৮০)

হযরত আবুল য়ুসর (রা:) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, যে ব্যক্তি কোন দরিদ্রকে ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেয় অথবা নিজের পাওনা সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক মাফ করে দেয় । আল্লাহ পাক তাকে কেয়ামতের দিন তার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন । (মুসলিম ৩০০৬)

হযরত আবু কাতাদাহ (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(সা:)কে বলতে শুনেছি,যাকে একথা আনন্দ দেয় যে,মহান আল্লাহ পাক তাকে কিয়ামতের দিনের অস্থিরতা ও বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন,তাহলে সে যেন পরিশোধে অসমর্থ ঋণগ্রহীতা ব্যক্তিকে অবকাশ দান করে অথবা তার ঋণ মওকুফ করে দেয় । (মুসলিম শরীফ : ১৫৬৩)

আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, (প্রাচীনকালে) একটি লোক লোকদের ঋণ দিত এবং তার চাকরকে বলত যে, যখন তুমি কোন পরিশোধে অসমর্থ ঋণগ্রহীতা ব্যক্তির কাছে যাবে,তাকে ক্ষমা করে দেবে । হয়তো (এর প্রতিদান )মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।

সুতারাং সে আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাৎ করলে(অর্থাৎ মারা গেলে) আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিলেন । (বুখারী শরীফ ২০৭৮ , মুসলিম শরীফ: ১৫৬২)

হযরত আবু হুরাইরা (রা:) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন,যে ব্যক্তি পরিশোধে অক্ষম কোন ঋণগ্রহীতাকে (তার সচ্ছলতা আসা অবধি) অবকাশ দেবে বা তাকে ক্ষমা করে দেবে,আল্লাহ পাক তাকে কিয়ামতের দিনে নিজ আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন,যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। (তিরমিযী শরীফ হাদিস নম্বর:১৩০৬)

আল্লাহ পাক করোনাভাইরাস মহামারী ও এর প্রভাবে তৈরী সার্বিক সঙ্কট থেকে যেন আমাদের সবাইকে সুরক্ষা করেন ।

আবারো যেন আমরা স্বাভাবিক জীবন পেয়ে আল্লাহর একনিষ্ঠ উপাসনা করতে পারি । আমীন