করোনার জেনোম সিকুয়েন্সিং নিয়ে আবারও অতিরঞ্জন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২০ ২০২০, ২২:৪২

ড.মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন: গতকাল দেশের সব মেইনট্রিম মিডিয়াতে করোনার সিকুয়েন্সিং নিয়ে আবারো বেশ আলোচনা হয়। বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া বিভিন্ন ধরনের শিরোনাম করেছে। যেখানে অনেকগুলো ভুলের মধ্যে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষনীয় যা দেশের করোনা প্রতিরোধে নেগেটিভ প্রভাব ফেলতে পারে। বলা হচ্ছে- মিউটেশন স্টাডি করে বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে নাকি করোনা মহামারী হচ্ছে না! 

দেশের প্রায় ৩০০০ হাজার লোক মারা গেল, ২+ লক্ষ মানুষ অফিসিয়ালি শনাক্ত হয়েছে। এরপরও মহামারী হয়নি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব মহামারি ঘোষণা দিল অন্যদিকে বিসিএসআইআর উলটো কথা কথা বলার চেষ্টা করছে, তাও আবার মিডিয়াতে!!

শুধুমাত্র কিছু মিউটেশন দেখে কি এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌছে যায়? প্রথমে ভেবেছিলাম হয়ত এগুলো মিডিয়ার অতিরঞ্জন। পরে এনালাইসিস করে দেখলাম প্রায় সব মিডিয়াতেই প্রায় একই খবর এসেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ৭১ চ্যানেলে (একাত্তর জার্নাল অনুষ্ঠান দেখলাম)। সেখানে দেশের সবচেয়ে ফান্ডেড রিসার্চ প্রতিষ্ঠান BCSIR এর জেনোম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ড সেলিম খানে এর বক্তব্য শুনে বিস্মিত হলাম। কথাবার্তা শুনে মনে হলো উনার জেনোমিক ফিল্ডের প্রাথমিক ধারনা নেই! হ্যা, আমি সত্যিই বলছি!!

১। প্রথম আলো পত্রিকা রিপোর্ট করেছে- “একটা করোনা ভাইরাসে ১ হাজার ২৭৪ টি প্রোটিন থাকে”।

ড সেলিম খান একাত্তর জার্নালে বললেন করোনার ৫৭৪টি প্রোটিন রয়েছে। এগুলো দেখার পর আমি রীতিমত হতভম্ব হলাম কেননা ভাইরাসে এত প্রোটিন থাকার কথা নয়। প্রসংগত, পিএইচডি’র শুরুতে প্রায় আড়াই বছর সবচেয়ে বড় (২০০২ সালের কথা) এনিমেল ভাইরাস (WSSV, genome size 300 kb) নিয়ে কাজ করেছি যার থিউরিটিক্যাল প্রোটিনের সংখ্যা ছিল ১৫০টির মত। কিন্তু সার্স করোনা ভাইরাস-২ (কোভিট) WSSV এর চেয়ে প্রায় ১০ গুন ছোট (29 kb)। এই ভাইরাসে থিউরিটিক্যালি ২৯টি প্রোটিন রয়েছে যার ২৬টি ফাংশনাল কোভিট এত বড় ইস্যু যা নিয়ে বিশ্ব তুলপাড় চলছে।

বড় আশ্চার্য্যের বিষয় হচ্ছে যে দেশের একটি প্রিমিয়ার রিসার্চ সেন্টারের জেনোমিক ডিপার্টমেন্টের প্রধান এটি জানেন না? তিনি নিজেও বললেন ৫৭৪টি প্রোটিন রয়েছে! যে এই তুচ্ছ বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ, তিনি কীভাবে সিকুয়েন্সিং করে এত বড় বড় কথা বলার সাহস কিভাবে পান? সিদ্ধান্ত টানার চেষ্টা করলেন যে মিউটেশন স্টাডি করে বুঝা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে করোনার মহামারী হয়নি!

২। বলা হচ্ছে- “দেশে ৫৯০ বার চরিত্র বদল করেছে করোনাভাইরাস, ৮টি রূপ বিশ্বেই নজিরবিহীন”

ভাইরাসের চরিত্র এত তাড়াড়াড়ি বলদ হওয়ার রেকর্ড নেই। মিউটেশন হওয়া মানেই চরিত্র বদল হওয়া নয়। অনেক মিউটেশন non-coding region-এ হয়। এতে কোন সাধারনত চরিত্র বদল হয় না। কোভিটে একটি মিউটেশন নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক ডিবেট হচ্ছে বিজ্ঞানীদের মাঝে। এটাকে বল জি-৬১৪ মিউটেশন বা ভ্যারিয়েন্ট। অরিজিনাল সার্স-২ ভাইরাসে (যেটি চায়নাতে দেখা গিয়েছিল) ডি-৬১৪ (ডি বলতে একটি এমাইনো এসিড, Aspartic acid বুঝায়) এর জায়গা পয়েন্ট মিউটেশনের কারনে পরিবর্তন হয়ে জি-৬১৪ হয়েছে। প্রোটিনকে একটি মালা/তাজবীহ এর সাথে তুলনা করলে একটি পুতি হচ্ছে একটি এমাইনো এসিড। এই পরিবর্তনের কারনে একদল বিজ্ঞানী ধারনা করেছিলেন যে এই মিউটেশনের কারনে কোভিট বেশি সংক্রামিত হচ্ছে। বিশ্বে এই ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা মহামারি বেশি দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও এই ভ্যারিয়েন্টটি বেশী সার্কুলেট করছে। অন্যদিকে অনেক বিজ্ঞানী এর সাথে ভাইরাস ছড়ানোর কোন লিংক দেখতে পাচ্ছেন না। এই মিউটেশন আসলেই কোন ভূমিকা আছে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। প্রায় এক সপ্তাহের আগের একটি প্রকাশিত একটি ফাইন্ডিংস-এ দেখা যাচ্ছে এই মিউটেশন কারনে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা সিস্টেম তেমন কোন প্রভাব ফেলছে না। অরিজিনাল এবং মিউটেন্ট ভার্সন একই ধরনের ইমিউন রেসপন্স করে। তাই চরিত্র বদল হওয়া এত সহজ ব্যাপার নয়।

৩। বলা হচ্ছে বেশী বেশী করোনার জেনোম সিকুয়েন্স করতে হবে। ইতালি, স্পেন নাকি জেনোম সিকুয়েন্সিং এর উপর ভিত্তি করে কোভিট কন্ট্রোল করেছে। বাংলাদেশেও এলাকা ভিত্তিক জেনোম সিকুয়েন্স করে সেই এলাকাকে লকডাউন করে করোনা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বানোয়াট, অতিরঞ্জিত কথা। চিন্তা করুন- ঢাকায় আপনি থাকেন বসুন্ধরায়, কাজে যান মিরপুর, বেড়াতে গেলেন ধানমন্ডী। এখন বলেন জেনোম সিকুয়েন্স করে কিভাবে ট্র্যাক করা যাবে।

৪। করোনার সিকুয়েন্সিং করে ভ্যাক্সিন বানানোর কল্পকাহিনী দেশে এখনো প্রচলিত আছে। উনারাও সেই ভ্যাক্সিন তৈরির গালগল্প করছেন। ড সেজুতি সাহা প্রথম এই জেনোম সিকুয়েন্সের কাহিনী ফেরি করে গেছেন। এখন সেটির নেতৃত্বে বিসিআইআর আসার চেষ্টা করছে! এদের প্রজেক্ট/উচ্চাকাংখাকে মিডিয়াতে এসেছে ভ্যালিডেইড করছেন দেশের পরিচিত বিজ্ঞানীও! মনে হচ্ছে ভ্যাক্সিন তৈরী করা ছেলের হাতের মোয়া। প্রতিবার ভাইরাসের মিউটেশন দেখে বার বার ভ্যাক্সিন বানোনো যায়! বিশ্বের বড় বড় ফার্মা কোম্পানীর রিসার্চাদের বাংলাদেশে এসে বিজ্ঞান শিখে যেতে হবে।

মুদ্দা কথা- গুগল স্কলার অনুযায়ী বিসিএসআইআর এর জেনোমিক সেন্টারের প্রধান ড সেলিম খান এর পাবলিকেশন সংখ্যা মাত্র একটি এবং সর্বসাকুল্যে ৭টি সাইটেশন! তিনি এই ট্রেক রেকর্ড নিয়ে তিনি এত বড় রিসার্চ পজিশনে কিভাবে আরোহন করলেন তা-ও রিসার্চের বিষয় হতে পারে!

দেশের সরকারী রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই চলছে যারা পাবলিকেশন করার চেয়ে ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করতে উদগ্রীব। এই দেশ নিয়েই আমরা বড় বড় স্বপ্ন দেখি, উচ্ছাসিত হয়ে যাই!

ড.মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন

নির্বাহী পরিচালক,

বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন