করোনাকালের ঈদ ও ইসলামে মানবতাবোধ
একুশে জার্নাল
মে ২৭ ২০২০, ১৪:২০

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। বর্ণিল বসুন্ধরার সকল আয়োজন শুধু মানবজাতির কল্যাণের জন্য। মহান প্রভুর অমোঘ নীতিতে আমাদের কেউ বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী আবার কেউ রিক্তহস্ত। কেউ বাস করে বিশালাকার প্রাসাদের চূড়ায় আবার কেউ রাতদিন কাটায় রাস্তায়, ফুটপাতে। কারও খাবারের মেনুতে বিলাসিতার কোনও কমতি নেই, আবার কেউ মানুষের উচ্ছিষ্ট আর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া অখাদ্য থেকে বেঁচে থাকার অন্ন কুড়ায়।
মহান প্রভুর কী কারিশমা! কারও রয়েছে ব্যাংক ভর্তি বেহিসেব টাকা, অঢেল সম্পদ। রাজকীয় বাসায় রয়েছে দুর্লভ-উচ্চমূল্যের সকল আহার্য, খাদ্যসামগ্রী। কিন্তু সব- শুধু ওই থাকার মধ্যেই সীমিত। এসবের ন্যূনতম কিছু জিহবায় দেওয়ার মতো সাধ্য যে তার নেই! আবার কেউ ক্ষুধা মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত পরিশ্রম, বিনিদ্র রাতদিন, মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রার্থনা ইত্যাদি কত কিছুই না করছে…। অস্বীকার করার কোনও জো নেই, ওই মানুষেরা যে আমাদের মতোই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব- মানুষ।
করোনাকালের এ সময়ে সকলের জীবন নিরাপদ রাখতে যখন ঘরে অবস্থান আর লকডাউন চলছে। তখন কত শিশু, নারী আর বৃদ্ধের নিরাপদ নিবাস যে, রাস্তার ফুটপাত আর ড্রেনের স্লেব! বারবার হাত ধোঁয়া আর পিপিই’র এ সময়ে ধুলোবালি, আবর্জনাই তাদের স্যানিটাইজার আর পোষাক! তারা কিন্তু মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি, আমাদের মতো এ পৃথিবীতেই তাদের জন্ম-কর্ম, ওঠাবসা, চলাফেরা।
আমাদের চারপাশে রয়েছেন অসংখ্য অসহায়, নিঃস্ব, বাস্তুহীন, অভাবগ্রস্থ এবং খেটে-খাওয়া মানুষ। কঠিন এ ক্রান্তিকালে তাদের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে। অপরদিকে নিম্নবিত্তদের মতো মধ্যবিত্তরাও চরম কষ্ট আর দুর্ভোগে সময় পার করছেন। কেউ মুখ খুলে কারও কাছে বলছেন, আবার কেউ লজ্জাবোধ করে তাদের দূরাবস্থার কথা কারও কাছে প্রকাশ করা থেকে বিরত রয়েছেন। বিত্তবানরা অসহায়দের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি মধ্যবিত্ত অভাবগ্রস্থদের প্রতি কল্যাণের হাত প্রসারিত করাও এখন সময়ের দাবি। নিজ নিজ সাধ্যের আলোকে পারস্পরিক দয়াপরবশ হতে হবে। মানবতার প্রেম, ভালবাসা দিয়ে করোনাকে জয় করতে হবে। বস্তুত, মানবসভ্যতায় সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, ভালবাসা আছে বলেই পৃথিবীটা এতো সুন্দর, আকর্ষণীয়, উপভোগ্য এবং ছন্দময়।
ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুর্বল, দুঃখীজনের প্রতি সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ, কোমল আচরণ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতি ও আদর্শ।
স্মর্তব্য যে, পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ ও সহানুভূতিশীল জীবনাচার ইসলামি সমাজনীতির অন্যতম দর্শন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘সৎকাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না…।’ (সুরা মায়েদা : ২)
আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘আর আত্মীয়স্বজনকে দাও তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপচয় কর না।’ (সুরা ইসরা, আয়াত : ২৬)
আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, ‘তাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ১৯)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ)
করোনাকালের এ ঈদে দুঃখীদের মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দেওয়া আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। প্রয়োজন, তাদের মুখাবয়বে একটুকরো হাসি ফুটানো, খুব বেশি প্রয়োজন। পারবো তো- পারস্পরিক সুখ-দুঃখ, হাসি-খুশি ভাগাভাগি করতে?
সময় এখন পারস্পরিক কল্যাণকামীতা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কল্যাণকামীতাই দ্বীন।’ (মুসলিম) কোনোপ্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বিষয়টির গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ইসলাম কল্যাণকামীতাকে শুধু দ্বীনের সাথে সম্পৃক্তই করেনি বরং কল্যাণকামীতাকে দ্বীন (ধর্ম) আখ্যায়িত করেছে। অর্থাৎ, অপরের মঙ্গল ও কল্যাণকামীতাই দ্বীন।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক লোক রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করল, ‘ইসলামের উত্তম কাজ কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, ‘কারও মুখে আহার তুলে দেওয়া…।’ (বুখারি)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট হবে, মহান আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামত দিবসে তার কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেবেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
আবার কঠিন হৃদয়ের লোকদের সতর্ক করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুল (সা.) ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরোপকারী, দানশীল, কল্যাণকামী ও মহান হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সকলের একান্ত আপনজন। কারোও কষ্ট দেখলে তিনি ব্যথিত, অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়তেন। রাসুল (সা.) কোনোদিন কোনও সওয়ালকারীকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেননি। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিম দুর্বলদের প্রতিও তাঁর দান-অনুগ্রহ বিস্তৃত ছিল। অসহায়-দুঃখীজনের মুখে হাসি ফোটানো ছিল তাঁর নির্মল চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট। অভাবগ্রস্থদের প্রতি সর্বদা তাঁর অনুগ্রহ, সহযোগিতার হাত প্রসারিত থাকতো। অন্যের কষ্ট লাঘবে তিনি পাগলপারা হয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন সম্বলহীনের সর্বোচ্চ নিবেদিতপ্রাণ সহযোগী।
আনাস (রা.) বলেন- ‘আমি রাসুল (সা.) এর চেয়ে অধিক দয়ালু লোক দেখিনি।’ (মুসলিম)
আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এর দানের হাত এতোটা প্রসারিত ছিল যে, আমার মনে হয়, সকাল বেলা যদি তাঁর কাছে ওহুদ পরিমাণ সম্পদ রাখা হয়, তবে সন্ধ্যার আগেই তিনি সব দান করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসসিম)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই ব্যক্তি উত্তম যে মানুষের অধিক উপকারী।’ (তাবরানি)
আমাদের সবার জানা, একবার ঈদের দিন সকালবেলা রাসুল (সা.) দেখেন, পুরো শরীর কাদায় মাখানো, ছিন্নবস্ত্র পরিহিত একটি শিশু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার কাছে গিয়ে জানতে পারেন, ছেলেটি এতিম, অসহায়। তার মা-বাবা কেউ নেই। এ কথা শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। শিশুটির প্রতি তাঁর মায়া হলো। তাকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং আয়েশা (রা.) কে বলেন, শিশুটিকে ভালোভাবে গোছল করিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দাও। আয়েশা (রা.) গোসল করানোর পর তিনি নিজ হাতে তাকে নতুন পোশাক পরিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে নিয়ে গেলেন। আদর করে শিশুটিকে বললেন- ‘আজ থেকে আমি তোমার বাবা আর আয়েশা তোমার মা।’
দেখুন, নিঃস্বদের ব্যাপারে ইসলামের দর্শন কী অনুপম! পথশিশুর প্রতি মানবতার প্রাণপুরুষ রাসুল (সা.) এর অতুলনীয় এ মহানুভবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- অসহায়, অনাথ, শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী? দুর্বলদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হবে?
বৈশ্বিক বিপর্যয় কভিড-‘১৯ থেকে পরিত্রাণ লাভ করা এখন গোটা বিশ্ববাসীর একান্ত প্রার্থনা, প্রাণের দাবী।
এ কঠিন দুঃসময় কাটিয়ে ওঠতে আমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর এবং ফলপ্রসূ পন্থা হচ্ছে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্য, সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও দান-সদকার প্রতি আরোও মনোযোগী হওয়া।
আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা ভাল; আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্থকে দাও তা তোমাদের জন্য আরও ভাল; এবং এতে তিনি তোমাদের জন্য কিছু পাপমোচন করবেন। আর তোমরা যে আমল কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্মক অবহিত।’
(সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭১)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের প্রতিদান তাদের রব-এর নিকট রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৪)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘বান্দা যতক্ষণ তার অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করে আল্লাহও ততক্ষণ তার সাহায্য-সহযোগিতা করেন।’ (মুসলিম)
অন্যান্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দান-সদকা বিপদ-বিপর্যয় দূরীভূত করে, জীবনে সমৃদ্ধি এনে দেয়। পাপমোচন করে, ক্ষমা লাভের মাধ্যম হয়। আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। অসুখ-বিসুখ থেকে সুস্থতা পাওয়া যায়।
আসুন, আমরা একটু সচেষ্ট হই। দয়া-মমতার উদার হস্ত বিস্তৃতভাবে প্রসারিত করি। আমাদের উদ্যোগ, প্রচেষ্টায় হয়তো
অসহায়-ক্লিষ্টদের দুঃখ যন্ত্রণার অবসান হবে না; তবে আমাদের এ প্রেম, এ মানবতাবোধ একটি বারের জন্যে হলেও, তাদের বিষন্ন মুখে ফুটিয়ে তুলবে প্রাণখোলা হাসি। আমরা প্রিয় বস্তু লাভ করার মাধ্যমে যেভাবে আনন্দ-খুশির জোয়ারে নেচে ওঠি, তারা আমাদের ওই একটু ভালবাসায় আনন্দ-সুখে এর থেকেও বেশি তৃপ্তি, প্রশান্তি অনুভব করতে পারে।
কবির মতো আমাদেরও উপলব্ধি হোক- ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’