কওমী মাদরাসার জন্য টাকা বা চামড়া সংগ্রহ, মানের না অপমানের?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ২৪ ২০১৮, ১৩:১৬

সৈয়দ মবনু  : আমার জনৈক বন্ধু বিদ্বেষ থেকে নয়, মমতার কাকুতি থেকে লিখেছেন কৌমি মাদরাসার সাথে আমাদের আত্মার সর্ম্পক। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই আমরা প্রকৃত প্রাণ সঞ্চার করেছি। তাই তাঁর বক্তব্য হলো, এই প্রতিষ্ঠানের সন্তানরা বিবেকহীন না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ রাখতে পারে না। তিনি তাও স্বীকার করেছেন, কৌমি মাদরাসা কুরআন হাদিসের জ্ঞানের ধারক। তাই মানবজাতি বলতে সকলের প্রাণ এসব প্রতিষ্ঠান। এটা কেবল অনাথের প্রাণ নয়। কেবল গরীবরে আশ্রম নয়। কেবল নিঃস্বের আশ্রয়কেন্দ্র নয়, কেবল এতিমের লঙ্গরখানা নয়। বরং এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভকারীরাই জাতির প্রকৃত নেতৃত্বদানকারী।

তাঁর এই কথাগুলোর সাথে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। এরপর তিনি যখন মমতাপূর্ণ অভিযোগে বলেন, ‘কিন্তু আমরা আমাদের কাজর্কমে যদি এসব প্রতিষ্ঠানকে গরিবের আশ্রম ও এতিমের লঙ্গরখানা ইত্যাদিরূপে প্রকাশ করি তবে সমাজের মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমতা রাখলে এখানে শিক্ষালাভকারিদের দয়া ও সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হিসেবে দেখবে, মমতা না রাখলে হেয় দৃষ্টিতে দেখবে। মাদরাসার ঘরের কোণে বসে থাকা বদ্ধপ্রাণী ছাড়া সবাই এর বাস্তবতা দেখছেন। ভিক্ষুককে আদরের সাথে ভিক্ষাদানকে যদি সে মনে করে লোকটি তার প্রতি খুবই আন্তরিক, তবে এটা ভিক্ষুকের ভুল ধারণা। মাদরাসা কমিটির সভাপতি তার ছেলেকে যখন মাদরাসায় পড়াতে অনীহা দেখান এবং স্কুলে পড়ান, তখন এই সভাপতরি মাদরাসার প্রতি আন্তরকিতার স্তর আপনারাই নির্বাচন করুন।’

আমার বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি তাঁর কথায় দ্বিমত প্রকাশ করছি। তিনি যদিও কওমী মাদরাসার ছাত্র ছিলেন, হয়তো আজ শিক্ষকও হয়েছেন, কিন্তু কওমী মাদরাসার মূল গতি বা কনসেপ্টকে অনুভব করতে তিনি কিছুটা যে ব্যর্থ, তা এই বক্তব্য থেকেই প্রমাণ। কওমী মাদরাসা গরিবের আশ্রম না হলেও জ্ঞানপিপাসু গরিবদের আশ্রয়স্থল কিংবা সম্বল তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। ভারতের সেই দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে আজকের সময় পর্যন্ত গোটা বিশ্বে কওমী মাদরাসাগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ এবং মানবিক দায়িত্ব আদায় করে একদিকে ইলমে দ্বীনকে রক্ষার আন্দোলনকে অভ্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে গরিবদেরকে শিক্ষিত করে প্রতিটি রাষ্ট্রে অশিক্ষিতের হার কমিয়ে আনতেছে। কথা থাকলো সাহিয্যকারিরা ‘মমতা না রাখলে হেয় দৃষ্টিতে দেখবে’, পৃথিবীতে সব মানুষের মমতা লাভ স্বয়ং হযরত রাসুল (স.)-এর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। আজও হবে না। দয়া কিংবা মমতা না থাকলে যে কেউ যে কাউকে হেয়-এর দৃষ্টিতে দেখে। এটাই নিয়ম। এখানে শুধু কওমী মাদরাসার ছাত্র কিংবা শিক্ষক নয়, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত ভিক্ষা আর চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য সমাজসেবামূলক কাজকে যারা সমার্থক মনে করেন, তাদের বিশ্বসমাজের ইতিহাস কিংবা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান খুব যে নেই তা তাদের বক্তব্যই প্রমাণ করে। তিনি বলেছেন, ‘মাদরাসা কমিটির সভাপতি তার ছেলেকে যখন মাদরাসায় পড়াতে অনীহা দেখান এবং স্কুলে পড়ান, তখন এই সভাপতির মাদরাসার প্রতি আন্তরিকতার স্তর আপনারাই নির্বাচন করুন।’ তাঁর একথাও সত্য নয়। কিছু মাদরাসায় হয়তো এমন আছে। কিংবা তিনি যে মাদরাসায় পড়েছেন সেই মাদরাসার অবস্থা হয়তো এমন। আমি নিজেও একটি মাদরাসার সভাপতি। আমি আমার ছেলে-মেয়েকে ইংল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে এনে কওমী মাদরাসায় পড়িয়েছি। এভাবে আরও রয়েছে। তা ছাড়া কওমী মাদরাসা মানে জনগণের মাদরাসা, জনগণের মাল জনগণই রক্ষণাবেক্ষণ করবে। রাষ্ট্রকে জনগণ টেক্স দেয়, টেক্স যে উঠায় সে কি নিজকে খুব অপমানিত মনে করে? কওমী মাদরাসা জনগণ থেকে চাঁদা গ্রহণ করে। চাঁদা যে উঠায় সে এত হীনমন্য কেন যে লজ্জাবোধ করে? সে কি এই চাঁদা তার নিজের জন্য সংগ্রহ করছে? মূলত সে হীনমন্য হয় তাঁর নিজের হীনমন্যতা থেকে। আমার তো খুব ফখর বা অহম হয় মাদরাসা, মসজিদ কিংবা সমাজসেবামূলক কোন কাজের জন্য চাঁদা সংগ্রহে। এই অহংকার এবং ফখরের মূল কারণ, আমি আমার জন্য নয়, বরং আল্লাহ এবং রাসুলের প্রতিষ্ঠানের জন্য কিংবা আল্লাহর বান্দাদের খেদমতের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করছি। আমি যতক্ষণ এই কাজে থাকি ততক্ষণ নিজকে মনে করি আল্লাহর সৈনিক বা কর্মচারী। অবশ্যই বেতনশূন্য নয়, জান্নাত হলো এই কাজের বেতন।

আমার সেই বন্ধু বলেছেন, কওমী মাদরাসায় যে কোরবানীর সময় চামড়া সংগ্রহ করে তা লজ্জাজনক। তাঁর বক্তব্য হলো, কমপক্ষে ৯৫% নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই চামড়া কালেকশনকে একটি লাঞ্চনামূলক কাজ বলে স্বীকার করেছেন। বাকী ৫% তারা হয় লাঞ্চনার র্অথ বোঝেন না, অথবা কেবল আদেশ দিয়ে এসব করাতে জানেন, নিজে কখনো সম্মুখিন হননা। অফিসে বসে র্অডার দিয়ে কালেকশন করালে তিনি ঐ ছাত্রের অপমানের কী বোঝবেন?
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই, তার বক্তব্যটি নিজেরই হীনমন্যতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তিনি তাঁর ফেসবুক বন্ধু ৯৫% জন দিয়ে হিসাব করেছেন। নিজের ফেসবুকের বন্ধুরা কিছুটা নিজের মতোই থাকে। তাদের বক্তব্য আমি পড়িনি তবে তাঁর কথা সত্য হলেও বলবো, ওরাও হীনমন্য। এখানে মনোবিজ্ঞানের একটা কথা বলতে হয়। আপনি কাউকে এহসান করলে সে হয়তো কৃতজ্ঞ হবে, নতুবা হবে হীনমন্য। কৃতজ্ঞতা মানে হীনমন্যতা নয়, বরং তা বড় মনের পরিচয়। গরীবের যে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে নিজের মা-বাপের গরিব হওয়া নিয়ে লজ্জিত থাকে, তারা বড়ই হীনমন্য হয়। ওরা কেউ কেউ শিক্ষার শক্তিতে ধনী পরিবারে বিয়ে-শাদী করে নিজের অতীতকে নিয়ে হীনমন্যতায় থাকে। এই হীনমন্যতা থেকে এক সময় সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করে। কওমী মাদরাসায় পড়ুয়া অনেকের মধ্যেও এমন হীনমন্যতা স্পষ্ট দেখা যায়।

আমার বন্ধু তাঁর বক্তব্যের বাস্তবতা প্রমাণে হীনমন্যের মতো এমন একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যার সাথে এর কোন মিল নেই। তিনি বলেছেন, এক ভিখারীনি তাদের বাসায় গেলে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, এই লাঞ্চনার কাজ ছেড়ে কোন কাজ করে সম্মানের সাথে খেতে পারো না? সে উল্টো আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে, কী বলেন? এখানে লাঞ্চনার কী? আমার সাত সাঁড়ি এই পশো করে আসছে। এবার বলুন, এই মহিলা মান অপমানরে কী বোঝবে?’

যিনি ব্যক্তিগত ভিক্ষা আর প্রতিষ্ঠান বা সমাজ পরিচালনার জন্য চাঁদায় ব্যবধান বুঝেন না তার তো বিশ্ব অর্থনীতি কিংবা বিশ্বসমাজ সম্পর্কে কোন ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তিনি যেহেতু কওমী মাদরাসার ছাত্র, নিশ্চয় জানেন ওজনে ওজন আসে। ফয়ালার ওজনে নাসারা, জারাবা হয়। এখানে যদি ফায়ালার ওজনে জারাবাত, নাসারাত করা হয় তবে নিশ্চয় ওজন সহীহ হবে না। তেমনি কেউ যদি ব্যক্তির জন্য করা ভিক্ষাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য করা চাঁদার সাথে ওজন করেন, তা হলে হিসাবটা নিশ্চয় ভুল হবে। আমার বন্ধু এখানেই ভুল করছেন। আমি জানিনা তাঁর বাপ-দাদা কতটুকু ধনী ছিলেন এবং তিনি কোন মাদরাসায় কত টাকা দিয়ে পড়েছেন? তবে আমরা কওমী মাদরাসায় পড়েছি টাকা দিয়ে এবং আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ইতিহাস আমাদের কাছে পারিবারিকভাবে সংগ্রহীত রয়েছে। আমরা নিজেরা কয়েক পুরুষ থেকে এতটুকু আত্মমর্যাদাশীল যে বাপ-দাদার সম্পত্তি থাকার পরও আমরা তারা বেঁচে থাকতে তাদের সম্পদ স্পর্শ করি না, নিজেরা রুজি করে চলি। তাদের মৃত্যুর পর আমরা ফারায়েজের সম্পত্তি ভাগ করি। তারপরও মাদরাসা, মসজিদ, স্কুল, কলেজ কিংবা গবীর ছাত্র-ছাত্রীর জন্য টাকা সংগ্রহে গর্ববোধ করি। আমার বাবা বলেছেন, খলিফায়ে মাদানী মাওলানা সৈয়দ আব্দুল খালিক (র.) কর্তৃক সৈয়দপুর টাইটেল মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালে তিনি নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাউল সংগ্রহ করেছেন। আমরা নিজেরাও দারুস সালাম মাদরাসা, দরগাহ মাদরাসার ছাত্র থাকতে কোরবানির চামড়া উঠিয়েছি, আমার ছেলেকেও আমি তা করতে উৎসাহ দিয়ে থাকি। এই কাজে আমি ফখর বা অহম অনুভব করি। কেউ গালি দিলে মনে হয় আল্লাহ ও তাঁর বান্দাদের জন্য কিছু গালি শোনছি। খুব আনন্দ অনুভব করি। স্মরণ হয় হযরত নবী করিম (স.)-এর মক্কি জীবনের কথা।
(চলবে)