কওমি মাদ্রাসায় জেনারেল শিক্ষার প্রচলনের পথিকৃৎ আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ.
একুশে জার্নাল
অক্টোবর ১৪ ২০২০, ১০:২৯
মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
একজন মানুষ তার মনোভাব, আদর্শ, চিন্তা-চেতনার কথা নিজ মাতৃভাষায় যে ভাবে প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় সেভাবে পারে না৷ তাই আমাদের সকলকে মাতৃভাষার গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাধিক৷
মাতৃভাষাকে অবহেলা, অবজ্ঞার কোন সুযোগ নেই৷ মাতৃভাষাকে অবহেলা করে কোন জাতির আদর্শিক বিপ্লব ঘটান অসম্ভব৷ যারা নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করেছে তারা স্বজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷
এক সময় আমাদের দেশের কওমী মাদরাসায় বাংলা ভাষা অবহেলিত ছিল৷ কওমী মাদরাসায় অন্য ভাষায় লেকচার দেয়া হত৷ এখনো কোথাও কোথাও দেয়া হয়৷
সে পাক আমলে তবীবুল মিল্লাত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ, বাংলার প্রতি জোর দেন৷ তিনি বাংলায় বহু কিতাব রচনা এবং অনুবাদ করেন৷ বলতে গেলে তিনিই ছিলেন এর পথিকৃত৷ তারপরও সে সময় লালবাগ মাদরাসায় বাংলাকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত করতে পারেননি৷ সে সময় কোন কওমী মাদরাসায় বাংলা পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে দাবী করা দুস্কর৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার আব্বাজী মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামছুদ্দীনকাসেমী রহ, আরজাবাদ মাদরাসায় বাংলা, অংক, ইংরেজী, ভুগোল, সমাজ ও পৌরনীতিকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামুলক পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত করেন৷ পরীক্ষায় নম্বর অন্যান্য বিষয়ের সমমানের ছিল৷ কেউ আরবীতে পাশ নম্বর পেয়ে এ বিষয়গুলোতে ফেল করলে তাকে ফেল ধরা হত৷
দশম শ্রেণি পর্যন্ত জেনারেল শিক্ষাকে বাধ্যতামুলক করায় আরজাবাদকে সেমি আলিয়া বলতে অনেককে শুনেছি৷ আরজাবাদকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হত৷
বর্তমানে সে দৃশ্যপট নেই৷ সর্বত্র পরিবর্তনের হাওয়া বইছে৷ যারা বাংলাকে অবহেলা করতেন তাদের পরিচালিত মাদরাসায় এখন বাংলায় দরস দেয়া হয়৷
কওমী মাদরাসার কর্ণধারগণ যদি এ ব্যাপারে আরো পুর্বে দৃস্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতেন, তাহলে এ ভূখন্ডের মুসলমানদের উপকার আরো দ্রুত হত৷
বাংলাকে অবহেলা করার ফলাফল যে শুভ হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ আমাদের দেশের সর্বজন পরিচিত একজন রাজনীতিবীদ আলেম মুফতী, একটি প্রাচীন মাদরাসার প্রিন্সিপাল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলায় ফরম পুরণ করতে ব্যর্থ হয়ে অন্যের সহায়তা নেন৷ অথচ তিনি একজন অনলবর্ষি বক্তা ছিলেন৷ আরবী, উর্দুতে তার ভাল দখল ছিল৷ আমার এ কথা হয়ত কারো কারো বিশ্বাস করতে কস্ট হবে৷ চাটগাঁয়ে এখনো এমন এক মনীষী আছেন যাকে আরবী, উর্দুর আদীব বলা হয়৷ মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর বেশ কদর রয়েছে৷ কিন্তু তিনি বাংলায় কলম চালাতে আরবীর ন্যায় সফল নন৷ তিনি যদি আরবীর ন্যায় বাংলায় পাকা মুন্সি হতেন, তাহলে দেশ, জাতি তার দ্বারা উপকৃত হত আরো বেশী৷ এতে কোন সন্দেহ নেই৷
এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলে নয়৷ দারুল উলুম দেওবন্দ যে সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সময়ও উপমহাদেশে ফার্সীর প্রভাব ছিল বেশী৷ তখনো দেওবন্দে শিক্ষার মাধ্যম ভাষা হিসেবে উর্দু কে নির্ধারণ করা হয়৷ এর কারণ হল উর্দু ছিল তখন গণমানুষের মুখের ভাষা৷ গণমানুষের উপকারের কথা ভেবে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম করা হয়৷
চিন্তা করুন! আমাদের আকাবিরগণ কতো দুরদর্শি ছিলেন৷ এখনো দারুল উলুম দেওবন্দে পরীক্ষার প্রশ্ন আরবীতে না করে উর্দুতে করা হয়৷ তাদের নিকট মাতৃভাষার গুরুত্ব কি পরিমাণ তা এ থেকে প্রমাণিত হয়৷ তাই আমাদেরও মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে৷
লেখক পরিচিতি: মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, সাহেবজাদা, আল্লামা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ.; মুহতামিম, জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ (মাদ্রাসা); সহ-সভাপতি, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ; সদস্য, আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ।