ওয়াজ নসীহত: বক্তা এবং শ্রুতার আবশ্যিক গুণাবলি
একুশে জার্নাল ডটকম
ফেব্রুয়ারি ১৭ ২০২২, ১৮:৪৯

মাওলানা আহমদ কবীর খলীল: মানুষের আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সংস্কার, শান্তি সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করণ ইত্যাদি কারণে ওয়াজ নছীহতের দরকার হয়। আল্লাহর দীনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়া এবং ইহ ও পরকালীন মুক্তির পথে আহবান করার ক্ষেত্রেও ওয়াজ নসীহত অত্যন্ত চমৎকার পদ্ধতি এবং ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। এ কারণে আবহমান কাল থেকে এ পদ্ধতি চর্চিত ও অবলম্বিত হয়ে আসছে। আল্লাহ তা’লা তাঁর অনেক নবীর ওয়াজ নসীহতের বর্ণনা স্বয়ং কুরআনের ভিতরেই উল্লেখ করে দিয়েছেন। আপন আপন জাতির প্রতি হযরত নূহ আ. -এর নসীহত, হযরত ইব্রাহিম আ.-এর নসীহত, হযরত মুসা আ.-এর নসীহত, হযরত শুয়াইব আ., হযরত সালেহ আ. হযরত ইউনুস আ. হযরত লুত আ. হযরত সুলাইমান আ. এবং হযরত ঈসা আ. প্রমুখ পয়গাম্বরদের ওয়াজ নসীহতের বিবরণ কুরআন হাদিসে ভরপুর রয়েছে। হযরত লুকমান আ. তাঁর সন্তানদেরকে যে ওয়াজ করেছিলেন তার বিবরণ দিয়ে পবিত্র কুরআনের ভিতরে সূরা লুকমান নামে একটা সূরা নাযিল করে দেয়া হয়েছে। মোটকথা, মানুষকে পথপ্রদর্শন এবং সঠিক পথে পরিচালনা করণের জন্য ওয়াজ নসীহতের এই ধারা পৃথিবীর শুরু লগ্ন থেকেই আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের মাধ্যমে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়ে আসছে। মানুষের হেদায়েতের জন্য এটা আল্লাহর নির্দেশিত এবং নবীদের দ্বারা প্রদর্শিত একটা মাধ্যম।
যিনি ওয়াজ নসীহত করেন তাকে ওয়ায়িজ, বক্তা বা উপদেশ দাতা বলা হয়। ওয়াজকে ফলপ্রসূ করতে হলে প্রথমেই বক্তার মাঝে কাংখিত যোগ্যতা ও নির্দিষ্ট কিছু গুণাবলি থাকতে হবে। অন্যথায় ওয়াজের দ্বারা কাংখিত ফলাফল লাভ হয় না।
বাস্তবে দেখা গেছে আগেকার ওয়াইজদের তুলনায় বর্তমান সময়ের বক্তাদের কথায় মানুষের হেদায়েত কম হচ্ছে। অথচ, কথা বলার ধরন ও স্টাইল আগের ওয়াইজদের তুলনায় এদের অনেক সুন্দর। এরপরও ফায়দার দিক থেকে এখনকার বক্তারা পেছনে কেন?
উত্তর হলো ; কুরআন হাদিসে ওয়াইজ বা বক্তার যে গুণাবলির কথা বলা হয়েছে, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ বক্তারা সে গুণাবলি বা কাংখিত সেই যোগ্যতা অর্জণ না করেই ময়দানে নেমে গেছে। ফলে ময়দান গরম হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ফলাফল কাংখিত ভাবে অর্জন হচ্ছে না।
যাক, ওয়াইজ বা বক্তার গুণাবলী বা যোগ্যতা কি হবে, সংক্ষিপ্ত ভাবে তা জেনে নেয়া দরকার। পবিত্র কুরআনে করীমের সূরা যারিয়াতের ৫৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন ; এবং তুমি ওয়াজ করতে থাক, কারণ ওয়াইজ মুমিনদের উপকারে আসবে। ইমামুল মুফাসসিরীন হযরত কাতাদা রহ. বলেন; এখানে কুরআনের আলোকে ওয়াইজ নসীহত বা উপদেশ দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর কুরআনের আলোকে ওয়াজ তাঁরাই করতে পারবে যারা কুরআন সুন্নাহের উপর গভীর পাণ্ডিত্য রাখেন। (সূত্র, তাফসীরে কুরতুবি) সুতরাং যাদের কুরআন সুন্নাহের উপর পাণ্ডিত্য নেই তারা ওয়াজ করার সেই অধিকার রাখেন না।
সূরা ইয়াসিনের ২১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন; তোমরা তাদের অনুসরণ কর যাঁরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় কামনা করেনা এবং তাঁরা নিজেরাও সুপথে চলে।
উক্ত আয়াতের আলোকে মুফাসসীরগণ বলেন যে, যাঁরা শ্রুতার কাছ থেকে বিনিময় লাভের আশায় ওয়াজ নসীহত করে, কিংবা যেইসব বক্তারা হেদায়েতের উপর চলেনা তাদের ওয়াজ নসীহত ফলপ্রসূ হবে না।
সুতরাং ওয়াজ করতে হবে বিনিময়ের আশা ছাড়া এবং বক্তা নিজে ওয়াজের উপর আমলকারী হতে হবে। অন্যথায় ওয়াজের দ্বারা শ্রুতার কাংখিত ফায়দা হাসিল হবে না।
তাছাড়া ওয়াইজের এখলাস থাকতে হবে। মানুষের হেদায়েতের জন্য নির্ভেজাল ও নিঃস্বার্থ আকাংখা থাকতে হবে। যেমনটা ছিল নবী রাসুলদের বৈশিষ্ট্য। আর নবী রাসুলদের প্রতি এটা আল্লাহর নির্দেশও বটে। একজন ওয়াইজ তাঁর শ্রুতাদের সামনে দরদমাখা কন্ঠে নসীহত করতে হবে, আর অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, ওয়াজ যেন এমন দীর্ঘ না হয়, যেকারণে শ্রুতা বিরক্ত হয়ে যায় কিংবা তা স্মরণ রাখতে অক্ষম হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বক্তাকে অবশ্যই তাঁর বক্তব্য পেশকালে স্হান, কাল এবং পাত্রের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ওয়াইজ বা বক্তার মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলি থাকা সত্বেও অনেক সময় শ্রুতার মধ্যে অপরিহার্য গুণাবলির অনুপস্থিতি থাকার কারণে ওয়াজ নসীহত ফলপ্রসূ হয় না। সূরা আ’লার ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা’লা উপদেশ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করতঃ ১০ নং আয়াতে বলেছেন; উপদেশ তারাই গ্রহণ করতে পারবে, যাঁরা আল্লাহকে ভয় করে। অতপর ১২ নং আয়াতে বলেছেন ; যারা হতভাগা তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
উক্ত আয়াতগুলোর আলোকে মুফাসসীরগণ বলেন যে, ওয়াজ থেকে উপকৃত হতে হলে শ্রুতাকেও অবশ্যই আল্লাহর ভয় নিয়ে তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ওয়াজ শুনতে হবে। তাহলে ওয়াজ নিশ্চিত ফলপ্রসূ হবে। অন্যথায় নয়। তাছাড়া শ্রুতার হতভাগ্যতার কারণেও অনেক সময় ওয়াজ থেকে শ্রুতা উপকার লাভ করতে সক্ষম হয় না।
সুতরাং ওয়াজ নসীহত বা ইসলামি বক্তৃতা থেকে সমাজে কাংখিত উপকার আসতে হলে বক্তা, শ্রুতা এবং বক্তৃতায় কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত আবশ্যিক কিছু গুণাবলি থাকতে হবে, অন্যথায় কোনো ফলাফল লাভ হবে না। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সেভাবে ওয়াজ করার এবং শুনার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক, আহমদ কবীর খলীল
শিক্ষক, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা সিলেট।