একজন আহমদ শফীর কথা কি বলে শেষ করা যায়?
একুশে জার্নাল
সেপ্টেম্বর ২০ ২০২০, ১৭:৩২
ডাক্তার মোঃ মাসিহ উল্লাহ
২০০৬ সালের এক সকাল। নয়টা বা দশটার দিকে হাটহাজারী ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে একটা মাইক্রো এসে থামলো। হাটহাজারী ডায়াবেটিক হাসপাতাল তখন হাটহাজারী কলেজ সংলগ্ন বিল্ডিংটির নীচ তলায়। সংকীর্ণ জায়গা। মানুষের অনেক ভিড়। শফি ভাই মাইক্রো থেকে নেমে এসে বললেন হুজুর এসেছেন। আপনাকে দেখাতে চান। এক জায়গায় প্রোগ্রাম ছিলো। প্রোগ্রাম শেষে এখানে নিয়ে এসেছি।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুর! আমি এক দৌড়ে মাইক্রোর নিকটে পৌঁছে গেলাম। হুজুর নামবেন, ভিড়ের মধ্যে হাসপাতালে এসে বসবেন। হুজুরের কষ্ট হবে। আমি বললাম, রোগী দেখা শেষ করেই আমি মাদ্রাসায় আসছি। ইন শা আল্লাহ হুজুরের কামরায় গিয়ে হুজুরকে দেখবো। হুজুর এখন মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে হুজুরের কষ্ট হবে।
রোগী শেষ করে মাদ্রাসায় পৌঁছলাম। হুজুরের সুগার অনেক বেশি। চারশোর উপরে। ঔষধ অনেক খান। সুগার তেমন কন্ট্রোলে থাকে না। ডায়াবেটিস পুরোনো হয়েছে। ট্যাবলেটে তেমন কাজ হচ্ছে না।
হুজুরকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। ইনসুলিন লাগবে। আর এই কয়দিন আমি ইনসুলিন নিজে পুশ করবো। ইন শা আল্লাহ প্রতিদিন সকালে এবং রাতে। খাদেম ভাইয়েরা ইন শা আল্লাহ কয়েকদিনেই শিখে ফেলবে। তেমন কষ্ট হবে না। হুজুর সহজে রাজী হলেন। অথচ রোগীরা এত তাড়াতাড়ি রাজী হয় না। হাসি হাসি চেহারায় বললেন, “ঠিক আছে। শফি! ডাক্তার সাহেবের জন্য খাবার রেডি করো। তিনি আমার সাথে খাবেন।”
হুজুরের সাথে খাওয়া। অনেক বড় সৌভাগ্য। এমন খাওয়া কে মিস করে?
এইদিনই হুজুরের সাথে প্রথম পরিচয়। প্রথম খাওয়া। এরপর কত খেয়েছি। কতবার হুজুরের লোকমার ভাগ পেয়েছি! এই মহব্বত ও এই ভালোবাসা, এই আন্তরিকতা ও এই অকপটতা কি করে ভুলা যায়!
এরপর থেকে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছলো হুজুরের ব্যক্তিগত চিকিৎসকই হয়ে গেলাম। একটু খারাপ লাগলেই হুজুর স্মরণ করেন। আমি দৌড়ে যাই। এই দৌড়ে যাওয়াকে সৌভাগ্যের মনে করি। এমন বুজুর্গের সোহবতকে নিজের জীবনের জন্য পাথেয় মনে করি।
২০০৭ এর মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল। হুজুরের কামরায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিগন এসেছেন। হুজুরের ইনসুলিন নেয়ার সময় হয়েছে। আমি কাছে থাকলে হুজুর আমাকে দিয়েই ইনসুলিন পুশ করাতে পছন্দ করেন। প্রথমবার যে আমিই দিয়েছি। আমি পুশ করলে নাকি হুজুরের ব্যথা লাগে না।
আমাদের চট্টগ্রাম শহরের এক মুরুব্বি আমাকে এখানে দেখে বললেন, ‘ মছিহ উল্লাহ! তোমার এত বড় সৌভাগ্য! তুমি আল্লামা আহমদ শফি হুজুরের চিকিৎসা করো! তুমি হুজুরের এই সংস্পর্শ ছাড়বে না!’
বাস্তবেই দ্বীনে একটু একটু অগ্রসর হওয়া আওয়াম মানুষের জন্য এই ধরনের বুজুর্গ ব্যক্তিগনের সোহবত দ্বীনের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে টনিকের মতো। সদ্য ইলমে দ্বীন হাসিলের পথে যাত্রা শুরু করেছি। ঠিক এমন সময় এমন মানুষের কাছে যেতে পারা, সোহবতে থাকতে পারা কত বড় নিয়ামত।
একদিন সকালে হুজুরকে দেখতে গিয়ে বায়আতের দরখাস্ত করলাম। হুজুর নিজের হাতে আমার হাতটা নিয়ে বড় আন্তরিকতার সাথে বায়আত করালেন। সেই হুজুরের মুখে মুখে বলা উচ্চারণগুলো মনে পড়ে। হুজুর শুধু আমাকে উদ্দেশ্য করে সবগুলো যিকর এক এক করে বলে লম্বা বয়ান করলেন। শেষে আমার জন্যখাস করে দোয়াও করলেন। এই স্মৃতিগুলো কি ভুলা যায়? একদিন নাস্তার প্লেট থেকে সবগুলো আঙ্গুর এবং কলা একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে বললেন, এই সব আপনার বিবি ও বাচ্চাদের জন্য হাদিয়া। কত আন্তরিক ও ভালোবাসায় ভরা ছিলো সেই হাদিয়া।
হুজুরকে নিজের দ্বীনি পড়াশুনার কথা শুনাই। হুজুর খুশি হন। দিল থেকে দোয়া করেন। আহ! এভাবেই ২০০৮, ২০১০, ২০১২, ২০১৩ এর সেই উত্তাল সময়! ২০১৫ তে হজের জন্য টাকা জমা দিয়েছি। ফ্লাইট নিয়ে কি অনিশ্চয়তা! বার বার আশাহত হই। হুজুরকে দিয়ে দোয়া করাই। হুজুরও খুব চিন্তা করেন। সাহস করে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢাকা চলে যাই। হজ শেষে ফেরার পর হুজুরের সাথে দেখা হওয়ার সেই দৃশ্য! কতই না খুশি হুজুর! আমি যে বায়তুল্লাহ থেকে এসেছি।
একদিন শেষরাতে হুজুরের সুগার পড়ে গেলো। হুজুর সেন্সলেস হয়ে গেলেন। এম্বুলেন্সে করে হাটহাজারীস্থ আলিফে নিয়ে গেলাম। ২৫% ডেক্সট্রোজ দিয়েও অনেকক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরলো না। এম্বুলেন্সে করে রওয়ানা দিয়েছি সিএসসিআর এর দিকে। পথে হুজুরের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ, পালস নেই, হার্টবিট নেই। এমনকি পিউপিল ডায়ালেটেড। ভয় পেয়ে গেলাম। হুজুরের খাদেম শিব্বির, নাতি ফায়সাল সাথে আমি। হুজুর কি চলেই গেলেন? গাড়িতে আমাদের কান্নার রোল আর দোয়া। সিএসসিআর এ আইসিইউতে পৌঁছতেই হুজুর চোখ মেলে তাকালেন। আমি চুড়ান্ত অবাক। এ কি দেখলাম? আমার এক্সামিনেশনে ভুল ছিলো, না সত্যিই আল্লাহ পাক হুজুরকে পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছেন?
মিশকাতের বছর এক রাতে স্বপ্নে দেখি হুজুর আমাকে ধমকাচ্ছেন। বলছেন, ” আমি অসুস্থ, তুমি আমাকে দেখতে আসছো না?” সকাল হতেই দৌড়ে গিয়ে দেখি হুজুরের চোখ উঠেছে। কনজাংটিভাইটিস। প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখে দিতে দিতে স্বপ্নের কথা বললাম। হুজুর হাসলেন। সেই হাসি যেন এখনও জীবন্ত।
হুজুরের সাথে রমজানে ইতিকাফ করার স্মৃতি। যিকর ও দোয়ায়,মুখরিত সেই জীবন্ত রমজান।
২০১৮ ইংরেজি। কয়েকদিন পরেই হাইয়াতুল উলিয়ার অধীনে আমার দাওরা পরীক্ষা। কিন্তু পেরেশানির এক ব্যাপার ঘটেছে। আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেক উস্তাদের কাছে বেনামী চিঠি এসেছে। পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত। প্রবেশপত্র হাতে পাচ্ছি না। ওমর সাহেব হুজুর পরামর্শ দিলেন মুহতামিম সাহেব হুজুরকে গিয়ে বিস্তারিত জানাতে। দৌড়ে হুজুরের কাছে গেলাম। পুরো হালত জানালাম। হুজুর শুনামাত্রই বললেন, ‘ এটি তো কারও শয়তানি। আমি আজই মিটিং ডাকবো। আপনি চিন্তা করবেন না। ‘
হুজুর মিটিং ডাকলেন। সব হুজুরদের মতামত নিলেন। মুফতি নূর আহমাদ সাহেব হুজুর, মুফতি আব্দুস সালাম সাহেব হুজুর, বাবুনগরী সাহেব হুজুরসহ সবাই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট ইত্যাদি বিবেচনায় পরীক্ষা দিতে দেয়ার পক্ষে রায় দিলেন। হুজুর সব শুনে নিজের নির্বাহী ক্ষমতাবলে সিগনেচার করে দিলেন,” অভিযোগ বাতিল, ডাক্তার মছিহউল্লাহ পরীক্ষা দেবে।’ হুজুরের দোয়া নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় মুমতায হলাম। হুজুর নিজের হাতে পূরস্কার দিলেন। কত যে খুশি হলেন। হুজুরের এত এত ইহসান কিভাবে ভুলি? কিভাবে ভুলি হুজুরের দারসের অনেক খন্ড খন্ড স্মৃতি। কত ডাক্তার, কত প্রফেসরের এসে এসে হুজুরের হাতে বায়আত হওয়া। জিন্দেগী বদলানো।
একজন আহমদ শফীর কথা কি বলে শেষ করা যায়? তিনি একটা ইতিহাস। পরিশেষে হুজুর তো একজন মানুষই ছিলেন। মানুষ তো তার সব ধরনের দূর্বলতার সাথেই মানুষ।
হে মাওলা! হুজুরকে তুমি জান্নাতে উঁচু মকাম দান করো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতে মর্যাদা বুলন্দ করো।
আমাদের হুজুরের শেখানো রাস্তায় চলার তাওফীক দাও।