ঈমানের পূর্ণতার জন্য নবীপ্রেম অপরিহার্য

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

নভেম্বর ১২ ২০২০, ২০:১২

মুফতি আহমদ যাকারিয়া:
নিঃসন্দেহে মহানবী সা. কে ভালোবাসা এবং তার প্রদর্শিত পথ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ। এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারি রহ. বুখারীতে স্বতস্ত্র একটি শিরোনাম এনেছেন। যার অর্থ ‘নবী সা. এর ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ’।
এই মর্মে আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ,নবী সা. বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি এবং সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই।’(১০৭ বুখারী, হা: ১৫)
এখানে মোহাব্বাত বা ভালবাসা সেচ্ছাকৃত অর্থে বুঝানো হয়েছে, স্বাভাবিক অর্থে নয়। ইমাম নবী রাহ. বলেছেন, এখানে ‘নফসে আম্মারা’এবং ‘নফসে মুতমায়িন্না’ এর প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বস্তুত: নফসে মুতমায়িন্নার প্রভাবে প্রভাবিত ব্যক্তির স্বাভাবিক ভালবাসাই রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি অগ্রাধিকার লাভ করবে, আর নফসে আম্মার প্রভাবে প্রভাবিত ব্যক্তির স্বেচ্ছাকৃত ভালবাসাই রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি অগ্রাধিকার পাবে-স্বাভাবিক ভালবাসা নয়। অনুরুপ ভালবাসা বাস্তবরুপ পরিগ্রহ করতে পারে রাসূলুল্লাহ সা. এর সুন্নতের সাহায্য-সহযোগিতা, তাঁর শরিয়তের পাবন্দী এবং বিরুদ্ধ বাদীদের ভ্রান্তিপূর্ণ মতবাদের মূলোৎপাটনের মধ্য দিয়ে। সৎকাজের নির্দেশ দান এবং অসৎকাজ থেকে বাধা প্রদানও অনুরুপ ভালবাসারই পর্যায়ভুক্ত।
সুতরাং হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রতি ভালোবাসাকে অপরাপর ভালবাসার উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং শত্রুতা ও মিত্রতায় আল্লাহ ও তার রাসুলের হুকুমের অনুগত থাকা ঈমানের পূর্ণতা লাভের পূর্বশর্ত।
এটা শুধু একটি নীতিবাক্য নয়; বাস্তবেই প্রতিটি মুমিনকে পৌঁছাতে হবে নবীপ্রেমের এই স্তরে। সকলের উপর, সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে; এমনকি নিজের জানের উপরও।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপরে না হয় তাহলে মুমিন তার জীবনের পথ চলবে কীভাবে? আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের আদেশের সামনে সমর্পিত হবে কীভাবে? আর মুমিন তো সেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মোহাব্বাত ও নির্দেশের সামনে সবকিছু পিছনে ঠেলে দিতে জানে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, (হে নবী)! আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই-বোন, তোমাদের বংশ, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের এমন ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর; আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসুল এবং তার রাস্তায় জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় না হয়, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না। (সুরা তওবা, আয়াত: ২৪)
আয়াতের সারমর্ম হলো যে, যারা দুনিয়াবি সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহ ও তার রাসুলের সম্পর্ককে উপেক্ষা করেছে তাদের করুণ পরিণতির দিন সমাগত। দুনিয়ার মধ্যেই সে আজাব আসতে পারে। তবে আখেরাতের আজাব অবশ্যই ভোগ করতে হবে তাদেরকে।
উল্লেখিত আয়াতে সকল মুসলিমের প্রতি এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা এমন উন্নত স্তরে রাখা ওয়াজিব, যে স্তরে অন্য কারো ভালোবাসা স্থান পায় না। তাই যার ভালোবাসা এ স্তরে নেই সে অবশ্যই শাস্তির যোগ্য।
তাই মুসলিমগণ আন্তরিকভাবে রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান ও ভালবাসাকে ওয়াজিব মনে করে।
রাসূলের মোহাব্বাত প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালোবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী ও দয়ালু। (সুরা আলে ইমরান: ৩:৩১)
যার আনুগত্য করা ওয়াজিব তার বিরোধিতা বা অবাধ্যতা করা হারাম। সমস্ত কাজে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আবশ্যক।
মুসলিমগণ আন্তরিকভাবে রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান ও ভালবাসাকে ওয়াজিব মনে করতে হবে। নিচে এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করার চেষ্টা করব।
১. রাসুল সা. এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর অত্যাবশ্যক করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা কোন ব্যাপারেই আল্লাহ ও তার রাসুলের সামনে অগ্রণী হয়ো না। (হুজুরাত: আয়াত: ১)
এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসুল সা. এর অবর্তমানে তাঁর আনীত শরীয়ত ও আল্লাহর হুকুমের সামনে কারো কোন মত বা পথ গ্রহণযোগ্য হবে না।
২. আল্লাহ তায়ালা রাসুল সা. কে নেতা ও বিচারক রূপে পাঠিয়েছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব নাজিল করেছি, যাতে আপনি সে অনুসারে মানুষের মাঝে বিচার মিমাংসা করেন যা আল্লাহ আপনাকে জানিয়েছেন ।
(সুরা নিসা, আয়াত: ১০৫)
৩. আল্লাহ রাসূল সা. কে সর্বোত্তম সীরাত-সুরাত, সর্বগুণে গুণান্বিত, সৃষ্টির সেরা ও সর্বোৎকৃষ্ট মানব হিসাবে নির্বাচন করেছেন। এমন চরিত্র ও সৌন্দর্যের অধিকারীকে সম্মান প্রদর্শন করা অবশই জরুরি।
সত্যিকারার্থে রাসুল সা. এর ভালোবাসার অর্থ হলো, তিনি যে সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা।
এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, রাসুল সা. এর আনীত দ্বীনকে তোমরা আকড়ে ধর, আর যা তিনি নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর।
(সুরা হাশর: আয়াত: ৭)
রাসুল সা. এর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সুরা আহযাব: আয়াত: ২১)
সুতরাং তাকে ভালোবাসতে হবে আন্তরিকভাবে। আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে তার পরিপূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে।
নবী সা. এর প্রতি ভালোবাসা মুমিনের ঈমানের অংশ: 
মুমিনের জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মোহাব্বাতের গুরুত্ব অপরিসীম। মোহাব্বাতে রাসুল তো ঈমানের রূহ, মুমিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই মোহাব্বাত ছাড়া মানুষের না ঈমানের পূর্ণতা আসে, আর না ঈমানের স্বাদ অনুভূত হয়। আর নিছক ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং পার্থিব সমস্ত কিছুর উপর এই ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রা. বলেন- একদিন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। নবীজী ওমর রা. এর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রা. বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান তাঁর কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না,) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হব। পরক্ষণেই ওমর রা. বললেন, হ্যাঁ; এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ; ওমর! এখন হয়েছে। (বুখারী, হাদীস: ৬৬৩২)
আল্লামা আইনী আরো বলেন, ‘এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হলো, হে‘উমার! এ হাদিসে একটি কথা অনুধাবন করা উচিত যে, রাসূল সা. সত্যবাদী ও আমানতদার হয়েও কসম করে বলেন, ঈমানের পূর্ণতার জন্য মু‘মিনকে নিজেদের জীবনের চেয়েও তাঁকে ভালবাসা অবশ্য কর্তব্য। অথচ তিনি সত্য ও সততার এমন অধিকারী যে, তিনি কসম খান বা না খান তাঁর সমস্ত কথা সত্য এবং সন্দেহমুক্ত। এরপরও যদি তিনি কোনো কথা কসম খেয়ে বলেন, তাহলে সেটি কত সুনিশ্চিত? কেননা, কসম কোনো কথাকে সুদৃঢ় করে এটি আমরা সকলেই জানি।
(উমদাতুল কারী-২৩/১৬৯)।
নবী সা. এর প্রতি ভালোবাসা মুমিনের প্রধান সম্বল: 
মুমিনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ঈমান। এই মহা সম্পদের স্বাদ যার অর্জিত হয়, সমস্ত দুঃখ, কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। মোহাব্বাতের কারণে সকল তিক্ততা মিষ্টতায় পরিণত হয়। আর এই স্বাদ সে-ই পায়, যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে।
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রথম হল, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে প্রিয় হবেন।”  (মুসলিম, হাদীস:৬৭)
ঈমানের স্বাদ আস্বাদনের নগদ ও সবচেয়ে বড় ফায়দা হলো যে, ইবাদত ও আনুগত্যে আগ্রহ লাভ হওয়া। বরং ইবাদতই তখন বান্দার প্রশান্তির একমাত্র কারণ হয়ে যায়। অর্থাৎ, হৃদয়ে যখন ঈমানের মিষ্টতা সঞ্চারিত হয়, তখন ইবাদতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্যমী হয়ে ওঠে।
নবীজীর প্রতি ভালবাসা যেমনিভাবে ঈমান ও আমলে উৎকর্ষ লাভের উপায়, তেমনি তা আখিরাতে মহাসাফল্য অর্জনের সম্বল। আর প্রত্যেক মুমিনের কাঙ্ক্ষিত সে সাফল্য হলো আখিরাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভ। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেন; “ব্যক্তি যাকে ভালোবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে।
(মুসলিম, হাদীস ২৬৪০)
এ সম্পর্কে বড়ই শিক্ষণীয় ও চমৎকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন হযরত আনাস রা.। তিনি বলেছেন- অর্থাৎ, এক ব্যক্তি রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল; ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিয়ামত কবে সংগঠিত হবে? এটা শুনে নবীজী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ কিয়ামতের ব্যাপারে? সে জবাব দিল, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা ই হলো আমার সম্বল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে। হযরত আনাস রা. বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচে’ খুশির বিষয় ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা- ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কিয়ামতের দিন) তার সাথেই থাকবে।’
আনাস রা. বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি। আবু বকর ও উমরকেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাঁদের সাথেই থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল আমি করতে পারিনি।
(মুসলিম, হাদীস:২৬৩৯)
মোহাব্বাত হলো অন্তরের গোপন অবস্থা, যার কিছু আলামত আছে; অন্তরে আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি যদি মোহাব্বাত থাকে তা কিভাবে বুঝবেন? বা তার আলামত কি?
মূলত মোহাব্বাত দুই প্রকার; কামেল মোহাব্বাত ও নাকেস মোহব্বাত।
প্রথমে একটি সুত্র মনে রাখতে হবে যে, মোহাব্বাত অপূর্নাঙ্গও হয় আবার মোহাব্বাত পূর্নাঙ্গও হয়, যেমন আপনি নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত,
সবকিছু যদি করেন তাহলে সেটা আপনার অন্তরে যে মোহাব্বাত আছে তাকে পূর্নাঙ্গতা দেয়, কিন্তু আপনি যদি এসব আমল না করেন তাহলেও আপনার ভিতর যদি মোহাব্বাত থাকে
তা পূর্নাঙ্গ নয় বরং অপূর্নাঙ্গ। ঠিক তেমনিভাবে ঈমানও একই, মানুষ ঈমানদার হয় কিন্তু সে যখন আমলে সালেহ করে তখন তার ঈমান কামেল হয় অন্যথায় তার ঈমান নাকেস বলে পরিগণিত হয়।
মোহাব্বাতের আলামত:
অন্তরে মোহাব্বাত আছে কিনা সেটার
কিছু আলামত আছে; যা সাহাবাদের জীবনে প্রায় সময় প্রকাশিত হতো।
ঈমানের একটি আলামত হলো যে, সীমাহীন আদব ও সম্মান করা। আদব অনেক রকম হয়; যেমন আপনি এক জায়গায় বসে আছেন সেখানে একজন বৃদ্ধ লোক আসলে তাকে সিট ছেড়ে জায়গা দিয়ে দিলেন এটা হলো বৃদ্ধের প্রতি আদব; এই আদব মোহাব্বাত ছাড়া আদবও হতে পারে। আবার যখন আদব বর্ডার লাইন অতিক্রম করে সেখান থেকেই মূলত মোহাব্বাত শুরু হয়। আপনার অন্তরে যত বেশী মোহাব্বাত হবে তত বেশী আপনার পক্ষ থেকে আদব ও সম্মান প্রকাশিত হবে। সুতরাং বুঝা গেল যে, সম্মান বৃদ্ধিকারী বস্তু হলো ভালোবাসাময় মোহাব্বাত। তাই মোহাব্বাত কম থাকলে আপনার পক্ষ থেকে আদব-সম্মানও কম প্রকাশিত হবে। মোহাব্বাত যত বেশী হবে আদবও তত বেশী হবে। মোহাব্বাত কম হলে আদবও ততো কম হবে। মোহাব্বাত না থাকলে বিয়াদবী প্রকাশ পাবে।
মা-বাবার জন্য মোহাব্বাত সীমার ভিতর হবে, সম্মানও সীমার ভিতর হবে। মুরব্বীদের মোহাব্বাত করুন, শিক্ষককে মোহাব্বাত করুন, পীরকে মোহাব্বাত করুন, সকলের জন্যই সীমার ভিতর হতে হবে। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য যদি আপনার সম্মান সীমার ভিতর হয় সেটা হলো বিয়াদবী। আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি আদব সীমা অতিক্রম করতে হবে। আর সে আদব স্বয়ং আল্লাহ
তায়ালা শিখিয়ে দিয়েছেন সুরা
হুজরাতের ২নং আয়াতে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَن تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ
وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
মুমিনগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর তোমাদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বল, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।
(সুরা হুজুরাত ৪৯:২)
দেখুন এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু আওয়াজে
কথা বলার কারনে বান্দার সকল আমল বরবাদ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন এমনকি তার আমল যে বরবাদ হয়ে যাবে সে বুঝতেও পারবে
না। যে নবীর দরবারের আদব স্বয়ং
আল্লাহ শিখাচ্ছেন; সে দরবারের আদব কি সীমার ভিতর হবে না
সীমাহীন? অবশ্যই সীমাহীন
আদব হতে হবে।
সাহাবিদের মর্যাদা অর্জন হয়েছে শুধুমাত্র নবীপ্রেমের কারণে। নবীপ্রেমের যে নমুনা বিশ্ববাসীর কাছে তারা রেখে গেছেন, তা কোন লেখকের লেখনীতে, কোনো কবির কবিতায়, কোনো দার্শনিকের দর্শনে, কোনো বক্তার বক্তৃতায়, কোনো শিল্পীর তুলিতে, কোনো বৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানে, এমনকি কোনো গল্পকারের গল্পে প্রকাশ করা আদৌ সম্ভব নয়। সাহাবিদের সচেতন চক্ষু সার্বক্ষণিক রাসুল সা.-এর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কর্মের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকত। কোন করণীয় ও বর্জনীয় আমল প্রিয় রাসুল সা. থেকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমলে রূপান্তরিত করার জন্য তারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন।
কার আগে কে তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। শত্রু কর্তৃক প্রিয় রাসুল আক্রান্ত হোন কিনা সেদিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতেন। নবীপ্রেমে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছিলেন। যেমন সন্তান প্রিয় মায়ের স্নেহ-মমতা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, ভাই-বোনের হৃদয় নিংড়ানো দরদ, এমনকি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে স্বীয় বাপ-দাদার বসতভিটা, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন-সম্পদ এবং নিজেদের ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি পেছনে রেখে প্রিয় নবীর সংস্পর্শে লাভের আকাঙ্ক্ষায় অজানা-অচেনা পথ ধরে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। পেছনে রেখে আসা সহায়-সম্পত্তির জন্য জীবনে কখনো আক্ষেপ পর্যন্ত করেননি। হ্যাঁ, আক্ষেপ করেছেন শুধু প্রিয় রাসুলের সংস্পর্শে কিংবা তার আদেশ-নিষেধে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে। প্রিয় নবীর শুধু অঙ্গুলির ইশারায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও তারা কোনরূপ দ্বিধাবোধ করেননি কখনো।
সাহাবাগণের সীমাহীন সম্মানের উদাহারণ:
হুদায়বিয়ার ময়দানে, মক্কার কাফেরেরা উরওয়া বিন মাসউদকে গোপন সংবাদ গ্রহণের জন্য মুসলমানদের কাফেলার কাছে পাঠায়, উরওয়া বিন মাসউদ হুদায়বিয়া ময়দানে মুসলমানদের অবস্থা অবলোকন করে মক্কায় গিয়ে কাফেরদের কাছে রিপোর্ট করেন। (তিনি পরবর্তীতে মুসলমান
হয়ে যান অবশ্য।)
তিনি যখন কাফেরদের কাছে গিয়ে মুসলমানদের অবস্থা বর্ণনা করেন, তখন তিনি বলেন যে; আমি দেখেছি মুসলমানরা তাদের নবীকে এতই সম্মান করে যে, তিনি যখন অজু করেন তখন তাঁর অজুর পানি নেয়ার জন্য তাড়া কাড়াকাড়ি করে, তিনি থুথু নিক্ষেপ করলে সে থুথু মোবারক সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে কেউ না কেউ তা হাতের মধ্যে নিয়ে নিতেন এবং থুথু মোবারক মুখে ও শরীরে মালিশ করে নিতেন।”
প্রশ্ন হল- অজুর পানি ও তার থুথু মোবারক নিয়ে শরীরে মালিশ করা এটা কি সীমার ভিতরে সম্মান নাকি সীমার অধিক সম্মান ছিল? অবশ্যই সীমার অধিক সম্মান থাকলেই এমন আমল করতে পারেন তারা, নিশ্চয়ই  সাহাবাগন নবী সা.-কে সীমার অধিক মোহাব্বাত করতেন আর সে মোহাব্বাতের বহিঃপ্রকাশ হতো তাঁদের এসব আমল দ্বারা। আর নবীর প্রতি এমন মোহাব্বাতের বহিঃপ্রকাশই মূলত ঈমান।
(বুখারী: হাদীস: ২৫৮১)
যাই হোক, পরে উরওয়া বিন মাসউদ তার গোত্রের লোকদেরকে বলেন; খোদার কসম! আমি যুগের বড় বড় রাজাদের দেখেছি, তাদের প্রতি তাদের প্রজাদের সম্মানও দেখেছি কিন্তু এমন সম্মান দেখিনি; যা মোহাম্মদের সাহাবারা মোহাম্মদকে করে। সে হুদায়বিয়াতে পনেরো শত সাহাবা ছিলেন, আর পনেরো শত সাহাবার সুন্নাত এ হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি; আর তা হলো যে, নবীর প্রতি সীমাহীন মোহাব্বাত, ভালোবাসা, আদব ও সম্মান প্রকাশ করতে হবে সকল মুমিনকে।
নবীজীর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। মুমিনমাত্রই নবীপ্রেমিক। নবীপ্রেমের বিভিন্ন ঘটনায় ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল। এখানে নবীপ্রেমিক কয়েকজন সাহাবীর কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চেষ্টা করব। যারা আমাদের শিখিয়ে গেছেন-কীভাবে নবীজীকে ভালোবাসতে হয়।
১. উম্মে হাবীবা রা. নিজ পিতাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন; তুমি মুশরিক, তুমি নাপাক। এ বিছানার উপযুক্ত নও। ঘটনার পূর্ণ বিবরণ ইবনে কাছীরের বর্ণনায় নিম্নরূপ :
‘অষ্টম হিজরীর ঘটনা। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে একদিন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদীনায় হাযির। মদীনায় ঢুকেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন সঙ্গিনী তার কন্যা হযরত উম্মে হাবীবার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবু সুফিয়ান বিছানায় বসতে গেলে উম্মে হাবীবা বিছানা গুটাতে শুরু করলেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে আবু সুফিয়ান বিস্মিত হলেন। উম্মে হাবীবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মা আমি কি এ বিছানার উপযুক্ত নই? না এ বিছানা আমার উপযুক্ত নয় বলে তুমি মনে করছ? উম্মে হাবীবা বললেন, এটা আল্লাহর রাসূলের বিছানা। আর তুমি মুশরিক, নাপাক। তাই আমি চাইনা যে, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বস। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান মেয়ের কাছ থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৪৭৩ (গযওয়াতুল ফাতহ)
২. উম্মু সাদ বিনতে সাদ বলেন, আমি একদিন উম্মে আমারার নিকট গিয়ে বললাম খালা! আপনার যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন, উহুদ যুদ্ধে আমি সকালেই বের হয়ে পড়ি। লোকজন কী করছে তা আমি  দেখছিলাম। আমার সাথে একটি পানিভর্তি মশক ছিল। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যাই। সেখানে তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন। তখন মুসলমানদের বিজয়ের পালা চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন মুসলমানগণ পরাজিত হলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমি তাঁকে রক্ষার জন্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হই। তরবারি পরিচালনা করে এবং তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদেরকে দূরে তাড়িয়ে দিই। এতে আমি যখম হই। বর্নণাকারী উম্মু সাদ বলেন- ‘আমি তাঁর কাঁধে যখমের চিহ্ন দেখেছি। সেটি ছিল বৃত্তাকার গভীর গর্ত।’ কে এই আঘাত করেছিল তা আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, ওই আঘাত করেছিল অভিশপ্ত ইবনে কুমাইয়্যা। সাথীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর সে এসে বলল, মুহাম্মাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও। তখন আমি নিজে এবং মুসআব ইবনে উমায়ের ও অন্য কতকলোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন সে আমার উপর এ আক্রমণ চালায়।(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৬৪-১৬৫)
৩. ইসলামের সূচনালগ্নের কথা। তখন মাত্র ঊনচল্লিশজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতিক্রমে হযরত আবু বকর রা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। প্রথম যেদিন বক্তৃতা করলেন সেদিনই মুশরিকদের গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো, হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ল ওরা হযরত আবু বকর রা. এর উপর। ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো সারা শরীর। দীর্ঘ সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকলেন তিনি। তারপর সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্রই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন প্রিয় নবীজি কেমন আছেন? তার মমতাময়ী মা পুত্রকে কিছু খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু হযরত আবু বকর রা. শপথ করে বললেন, নবীজির সাক্ষাত লাভের পূর্বে কোন আহার গ্রহণ করবেন না। এরপর রাতে লোক চলাচল বন্ধ হলে পরম মমতাময়ী মাতা পুত্রকে নিয়ে প্রিয় নবীজির খেদমতে উপস্থিত হলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা. কে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। হযরত আবু বকরও রা. তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে জড়াজড়ি করে তারা উভয়ে খুব কাঁদলেন, কাঁদলো উপস্থিত সকল মুসলমান। এটাই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি পরম মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাও হার মানে!
৪. হযরত ওমর রা. এর বীরত্বের কথা কে না জানে? তিনি ছিলেন মানব ইতিহাসের এক লৌহমানব। অথচ সে ওমর রা. যখন নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ পেলেন তখন তিনি একদম অস্থির হয়ে উঠলেন। প্রিয়নবীর বিরহের শোক কিছুতেই তিনি সইতে পারছিলেন না, নাঙ্গা তালোয়ার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আহত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলেন- যে বলবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। প্রিয়নবী তো তাঁর বন্ধুর নিকট গমন করেছেন মাত্র। হযরত উসমান রা.ও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়লেন। দু’দিন পর্যন্ত কোন আওয়াজ বের হলো না তাঁর কণ্ঠ থেকে। হযরত আলী রা. এমনভাবে চুপসে গেলেন যে, মনে হচ্ছিল যেন তিনি অনুভূতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
পরিস্থিতি যখন জটিলরূপ নিচ্ছিল তখন হযরত আবু বকর রা. নবীপ্রেমের দাবিতেই হৃদয়-মন দৃঢ় করে ওঠে দাঁড়ালেন। সকলকে শান্তনা দিয়ে দ্বীপ্ত কণ্ঠে শোনালেন পবিত্র কুরআনের সেই অমোঘ বাণী-
‘আর মুহাম্মদ একজন রাসূল বৈ তো আর কিছু নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাওয়াব দান করবেন।’
(সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)
কুরআনের এই বাণী শুনে পরে সবাই প্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন।
৫. ওহুদ যুদ্ধের সময় যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথা মোবারকে শিরস্ত্রানের দু’টি কড়া ঢুকে পড়লো। হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উবায়দা রা. অধীর চিত্তে দৌড়ে এলেন। দাঁত দিয়ে শিরস্ত্রাণের কড়া টেনে বের করে আনলেন। হযরত উবায়দা রা. এর একটি দাঁতও ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তিনি দমলেন না অপর কড়াটিও দাঁত দিয়ে টেনে বের করে আনলেন। এতে তার আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। কড়াটি বেরিয়ে এলে নবীজির মাথা মোবারক থেকে রক্তের ফিনকি ছুটছিল। এ দৃশ্য দেখে সাহাবী মালেক ইবনে সিনান দৌড়ে এলেন এবং তার দুই অধরে নবীজির রক্ত চুষে পান করে ফেললেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘যার রক্তের সাথে আমার রক্ত মিশে গেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।’ কি গভীর ভালোবাসা থাকলে মানুষ মানুষের রক্ত পান করতে পারে! সত্যিই কি তা কল্পনীয়?!
৬. হযরত যায়েদ ইবনে দাসানা রা. কাফিরদের হাতে বন্দী হবার পর পাপিষ্ঠরা তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন করে। তামাশা দেখার জন্য সমবেত হয় অনেক লোক। আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, যায়েদ! সত্যি করে বল তো; আল্লাহর শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার পরিবর্তে মোহাম্মদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হোক আর তোমাকে হাসিমুখে তোমার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হোক। হযরত যায়েদ রা. দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ! নবীজির যাত্রাপথে একটি কাঁটা লুকিয়ে রাখা হবে আর আমি ঘরে বসে আরাম করবো, এতটুকুও আমার সহ্য হবে না। হযরত যায়েদের জবাব শুনে সেদিন মক্কার কাফেররা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। আরব নেতা আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, মোহাম্মদের প্রতি তার সাথীদের যে ভালোবাসা আমি দেখেছি, অন্য কারো প্রতি এমন ভালোবাসা আমি আর কখনো দেখিনি।
৭. নবী প্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো-আবূ ক্বাতাদার! তিনি রাসূল সা. এর নিরাপত্তা ও শান্তির ব্যাপারে  এমন গুরত্ব দেন যে, রাসূল সা. তন্দ্রার কারণে সাওয়ারীর পিঠ থেকে পড়ে যাবেন এ আশঙ্কায় তাঁর সঙ্গে সারা রাত পদচারণ করেন, যাতে তিনি নিরাপত্তায় থাকেন।
আবূ ক্বাতাদার রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা. আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, আগামীকাল তোমরা দিনের শেষ ভাগে ও রাতে পথ অতিক্রম করে পানির কাছে পৌঁছে যাবে ইনশা-আল্লাহ। এরপর মানুষ এমনভাবে যেতে থাকে যে, কেউ কারো প্রতি খেয়াল করছে না। আবূ ক্বাতাদার বলেন, আমি রাসূল সা. এর পাশে ছিলাম, মধ্য রাতে তাঁর তন্দ্রা আসে যার কারণে তিনি বাহনের পিঠে ঝুঁকে যান। এরপর আমি তাঁর কাছে আসি এবং তাঁকে জাগ্রত না করে সোজা করে দিয়েছি, তিনি সোজা হয়ে যান। এরপর তিনি যেতে থাকেন, যখন রাতের সিংহভাগ সময় কেটে যায় তখন পুনরায় ঝুঁকে যান। আমি তাঁকে না জাগিয়ে স্থির করি, তিনি স্থির হয়ে যান। এরপর যেতে থাকেন যখন রাতের শেষ প্রহর হয়ে আসে তখন তিনি ঝুঁকে যান, আর এটি ছিল প্রথম দুই অবস্থার চেয়ে বেশি মারাত্নক, মনে হচ্ছিল তিনি পড়েই যাবেন, আমি তাঁর কাছে আসি এবং স্থির করি। এরপর তিনি মাথা তুলে বলেন এ কোন ব্যক্তি? আমি বললাম, আবূ ক্বাতাদাহ। তিনি বললেন, কখন থেকে আমার সঙ্গে এভাবে এসেছ? আমি বললাম, প্রথম রাত থেকে। তিনি বলেন, আল্লাহর নবীকে হিফাজতের জন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে হিফাজত করুন।
(মুসলিম-হা: ১৫৯৪)।
৮. ইমাম ইবনু ইসহাক রাসূল সা. এর অন্য এক প্রকৃত প্রেমিকের কথা তাঁর ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন, আবূ দুজানা রা. রাসূল সা. এর জন্য নিজেকে ঢাল বানান। তিনি ঝুঁকে থাকেন এবং তীর তার পিঠে বিঁধতে থাকে, এমন কী তাঁর পিঠে অসংখ্য তীর বিদ্ধ হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে- এ অবস্থায় তিনি নড়াচড়াও করেননি। আল্লাহু আকবার! কোন বস্তু আবূ দুজনাকে রাসূল সা.-এর জন্য ঢাল হওয়া জুঁকা এবং পিঠে তীর বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নীরবে ধৈর্য ধারণ করতে উৎসাহিত করেছে? নিশ্চয় সেটি রাসূল সা. এর জন্য নির্মল ভালোবাসা। (আস সিরাতুন নাব্বীয়াহ, ইবনু হিশাম-৩/৩০, তারিখুল ইসলাম যাহাবী-১৭৪-১৭৫)।
৯. উহুদের যুদ্ধে রাসূল সা. এর প্রকৃত প্রেমিককে দেখা যায়, যিনি নিজ বুককে রাসূল সা. এর বুকের সামনে ঢালের ন্যায় রেখেছেন, যাতে শক্র পক্ষের তীর তার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং রাসূল সা. এর শরীরে যেন কোন রুপ আঘাত না হানে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন। হাদীসে এসেছে- আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উহুদের যুদ্ধে যখন কিছু মানুষ নবীজীকে সা. ছেড়ে পেছনে চলে যায় তখন হাতে ঢাল নিয়ে নিজেই তাঁর সামনে ঢালস্বরুপ দাঁড়িয়ে যান। আনাস রা. আরো বলেন, আবূ ত্বালহা বিখ্যাত তীরন্দাজ (তীর নিক্ষেপকারী ) ছিলেন। সেদিন তিনি দু‘টি অথবা তিনটি কামান ধ্বংস করেন। আনাস রা. আরো বলেন, কেউ রাসূল সা. এর সামনে তীর নিয়ে বেরিয়ে এলে তিনি তাকে বলেছিলেন, তুমি আমার তীর আবূ ত্বালহাকে দিয়ে দাও। তিনি আরো বলেন যে, নবী সা. যখন মুশরিকদের দেখার জন্য নিজ মাথা তুলে ছিলেন তখন আবূ ত্বালহা বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি মাথা ওঠাবেন না, এমন না হয় যে, মুশরিকদের তীর আপনাকে আঘাত করে। আমার বুক আপনার জন্য ঢালস্বরুপ। (সহীহ বুখারী-হা: ৪০৬৪)
১০. একজন প্রকৃত নবীপ্রেমিক রাবী‘আহ্ ইবনু ক্বা‘ব আল-আসলামীকে আবেদন করার সুযোগ দেয়া হলো তার আবেদন কী ছিল? ইমাম মুসলিম তার আবেদনের কথা তার ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন- রাবী‘আহ্ ইবনু ক্বা‘ব রা. হতে বর্ণিত, আমি রাসূল সা. এর কাছে রাত কাটাতাম। (একদিন) তাঁর কাছে ওজুর পানি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উপস্থিত হলাম। এরপর তিনি আমাকে বলেন, তুমি কিছু চাও। আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সঙ্গী হতে চাই। তিনি বললেন, এছাড়া আর কিছু? আমি বললাম, এটাই। তিনি বললেন, (এ আশা পূরণের জন্য) বেশি বেশি সাজদাহ করে আমাকে সহযোগিতা করো। ( সহীহ মুসলিম- হা:-১১২২)
এই হলো সাহাবায়ে কিরামের রাসূল-প্রেমের হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত। আল্লাহ্ পাক আমাদের অন্তরে নবী সা. এর মোহাব্বাত বেশি করে বৃদ্ধি করে দিন। আমীন।