ইসরায়েলের জন্ম ও ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার
একুশে জার্নাল ডটকম
অক্টোবর ০২ ২০২০, ১৪:২১
মোঃ জাফর আলী: ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝামাঝি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ একটি ভূখণ্ডের নাম ফিলিস্তিন। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই দেশটির ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চলগুলোর অন্যতম এটি। যুগে যুগে বহু ধর্ম, বর্ণ ও জাতির মানুষ এ অঞ্চল শাসন করেছে। ফিলিস্তিনের জেরুজালেম ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান এই তিন ধর্মাবলম্বীদের কাছেই পবিত্র স্থান। এটি পবিত্র ভূমি নামেও পরিচিত। এভাবে সবকিছুর বিবেচনায়ই এ অঞ্চলকে ঘিরে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বানিজ্যিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের খুবই তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। একসময় ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী বিশালায়তনের ভূখণ্ড নিয়ে ছিল এই ফিলিস্তিন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ও একটি আগ্রাসী গোষ্ঠীর জবরদস্তিমূলক বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য আজকের ফিলিস্তিন,পশ্চিম তীর ও গাজার ১৬ টি প্রদেশ নিয়ে, ২৩২০ বর্গমাইলের একখন্ড ভূমি মাত্র। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ গুগল ও অ্যাপল এর বিশ্বমানচিত্রেও এই ফিলিস্তিনের স্থান নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই সাম্রাজ্য মূলত ব্রিটিশ বিরোধী জোটে ছিল। নিজেরা যুদ্ধে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য, ফিলিস্তিনিদেরকে সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন করার আশ্বাস দিয়ে ব্রিটিশরা ১৯১৭ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন, যেটি বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
ঘোষণাটি সাধারণত আরবদের পক্ষে গেলেও পরে বুঝতে পেরেছিল যে তাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত ছিল এটি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বৃটেনের প্রয়োজনে, ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান একপ্রকার বিধ্বংসী ও দূর্লভ বোমার উপকরণ তৈরি করলে ব্রিটেন পুরস্কার হিসেবে তার স্বজাতি ইহুদিদের স্থায়ী বাসভূমি হিসেবে ফিলিস্তিনকে প্রদানের আশ্বাস দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করার পর ১৯১৮ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয় ব্রিটেন। এজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনের মাটি উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া সহজ হয় এবং একপর্যায়ে এখানে তাদের বসবাস শুরু হয়। যদিও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই ২০ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে চলে এসেছিল। এভাবে ১৯২৩ সাল নাগাদ ৩৫ হাজার, ১৯৩১ সালে এক লক্ষ আশি হাজার ও ১৯৪৮ সালে ছয় লক্ষে পরিণত হয়েছিল। যাইহোক এই ৩০ বছরে (১৯১৮-১৯৪৮) তারা ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। বিশেষ করে, ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির হিটলার ইহুদি দমন করা শুরু করলে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী হিসেবে আসা শুরু করে এবং ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয়।
এক পর্যায়ে এখানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ও আরব তথা ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে, হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাংসহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে তারা। পাশাপাশি গণহত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাট ও ধর্ষণসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে অসংখ্য ফিলিস্তিনিদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এভাবে তারা নিজেদের বসতি স্থাপন ও আরব উচ্ছেদকরণ অব্যাহত রাখে এবং এই সংবাদগুলো বিশ্বব্যাপী প্রচার হতে থাকলে তারা একটু চিন্তায় পড়ে যায়। এ জন্য নিজেদের অপরাধ ঢেকে রাখতে ও আরবদের ওপর দোষ চাপাতে ১৯৪০ ও ৪২ সালে, ইহুদি যাত্রীবাহী দুই দুটি জাহাজ ধ্বংস করে যথাক্রমে ২৭৬ ও ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে এবং সমগ্র বিশ্বের মানুষকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা চালায়।
অবশেষে ১৯৪৭ সালের ২৮শে নভেম্বর ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে ফিলিস্তিনে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি ৩৩ টি দেশের সমর্থনে পাস হয়। যদিও ফিলিস্তিনে জনসংখ্যায় ইহুদিরা চারভাগের একভাগ ছিল, তবুও উক্ত সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনের মোট ভূমির ৫৭ শতাংশ তারা ও ৪৩ শতাংশ আরবরা পেয়েছিল।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ১২ ই মে ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হলে, দশ মিনিটের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও একে একে অনেকে।
আর জাতিসংঘের ঐ সিদ্ধান্তের পর ইহুদিরা আরও হিংস্র হয়ে পড়ে। ফোনলাইন ও বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা, জোর করে ভূমি ও বাড়িঘর দখল, হত্যা ও নারী নির্যাতনসহ ইহুদি কর্তৃক সবধরনের অপরাধকর্ম বৃদ্ধি পায়। ক্রমেই সহিংসতার ব্যাপক আশঙ্কা বুঝে আরবের কয়েকটি দেশ সদ্য ঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং আরবরা এ যুদ্ধে পরাজিত হলে ইসরায়েল, ফিলিস্তিনের মোট আয়তনের ৭৮% শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। ফলে, ৭ লক্ষ ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি দেশছাড়া হয় এবং তারা পরবর্তীতে কখনোই তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। আর যুদ্ধে জয় লাভের পর সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভীত শক্ত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়।
ফিলিস্তিনে আশ্রয়গ্রহণকারী সেই অভিবাসী ইসরাইলিরা সম্পূর্ণ বাড়াবাড়ি করে, অবৈধভাবে শুধু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং ১৯৪৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার ফিলিস্তিনিসহ আশেপাশের দেশগুলোর সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এমনকি সিরিয়া, লেবানন ও মিশরের (পরবর্তীতে ফেরত দিয়েছিল) ভূমি দখল করার মত ঘৃণিত কাজও করেছে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, হিজবুল্লাহ ও জর্ডানের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এ যুদ্ধগুলোতে যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে সেগুলোর অন্যতম ভুক্তভোগী হল ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ।
আবার, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের উপর, ১৯৯৬, ২০০৪, ২০০৬, ২০০৭, ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ছোট-বড় অনেক অপারেশনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিই সকলকে ব্যথিত করে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে, সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনিদের জমি দখল, গুলি করে হত্যা, গ্রেফতার, অবৈধ বসতি স্থাপনসহ নানাবিদ সহিংসতা চালিয়ে তাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা, ফিলিস্তিনের গাজায় ২০০৭ সাল থেকে ইসরাইল ও মিশর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। বিবিসি ও অন্যান্য সূত্র অনুযায়ী, ৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ কিলোমিটার প্রস্থের এই এলাকার একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিনদিকে ইসরায়েল ও দক্ষিণ দিকে মিশরের সিনাই সীমান্ত। ছোট্ট আয়তনের এই অঞ্চলে ২০ লাখ ফিলিস্তিনিদের বসবাস। এখানে যারা বসবাস করে তারা খুবই সীমিত সংখ্যক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারে। অর্থাৎ তাদের ক্রয়-বিক্রয়ও ইসরায়েল এবং মিশরের অনুমতির উপর নির্ভর করে। গাজা উপকূলের ফিশিং জোন থেকে মাছ ধরতেও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এখানে নেই কোন প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর যে কয়টি স্কুল রয়েছে সেগুলোতে দুই শিফটে ক্লাস হয়।
তাছাড়াও গাজায় রয়েছে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট। ২৪ ঘন্টায় মাত্র ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পায় গাজাবাসী। কার্যকরী পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় গাজার পানি স্তরের ৯৫ শতাংশই দূষিত। আর বিশুদ্ধ পানি সংকটের পরিমাণও প্রকট। পাইপ লাইনের পানি সীমিত থাকায় ৯৭ শতাংশ বাড়িকেই ট্যাংকারের পানির উপর নির্ভর করতে হয়।
দীর্ঘ অবরোধে চিকিৎসাসেবা একেবারেই মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে বলা চলে। তাছাড়াও বিরাট খাদ্যসঙ্কটে গাজার মানুষ কিছু কিছু খাদ্য সহায়তা পায়। তবে ৫ লক্ষেরও অধিক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখানে দারিদ্র্যের পরিমাণ এতই বেশি যে, ৮০ শতাংশ লোকই কোনো না কোনো সামাজিক কল্যাণ ভাতার উপর নির্ভরশীল। যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ ৬০ শতাংশেরও বেশি। অবরোধের এই ১৩ বছরের দরুন ১২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। অবরোধ আরোপের পরও গাজায় ইসরায়েলের পরপর তিনবারের ভয়াবহ রকেট হামলায় হাজার-হাজার বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছে, সেই মুহূর্তে যখন অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক, তখনও গাজায় ইসরাইল কোনরকম মানবিক সাহায্য পৌঁছতে দিচ্ছে না বলে দাবি করেছেন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য খলিল আল হাইয়া।
খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান এসকল মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি, সার্বভৌমত্ব, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কঠোর সীমান্ত প্রহরা, জায়গায় জায়গায় চেক পয়েন্ট, সামগ্রিক পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সব কিছুর দিক বিবেচনায় ফিলিস্তিনের গাজা একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়পূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।
এই সভ্যতার যুগে ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরায়েলের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করাটা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায় বলে অধিকাংশ মানুষই মনে করে থাকেন। একটা নির্দিষ্ট জাতিকে এভাবে সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়ার অবৈধ চেষ্টা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ ও জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনুমোদন রয়েছে, এগুলোই মানবাধিকার। এসব অধিকারে হস্তক্ষেপ করার বৈধতা কোন শক্তির জন্য প্রযোজ্য নয়। এজন্য এসকল ন্যায্য অধিকার আদায়ে ফিলিস্তিনিরা মুসলিম বলে শুধু মুসলিমদের নয় বরং মানুষ হিসেবে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে তাদের পক্ষে এগিয়ে আসাটা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করাটাই যৌক্তিক। ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পরিপূর্ণ শান্তি ফিরে আসুক এবং ফিলিস্তিনিরা কমপক্ষে নূন্যতম মৌলিক অধিকারটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পাক, এটাই কামনা।
শিক্ষার্থী,শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।