ইতেকাফের ফাজাইল ও মাসাইল
একুশে জার্নাল
মে ১৪ ২০২০, ০৩:৫৮
।। মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী ।।
মহিমান্বিত রমাজানের অন্যতম ইবাদত ইতেকাফ। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে রমজানের শেষ দশকটি মসজিদে বিশেষ নিয়মে অবস্থান করাই হচ্ছে ইতেকাফ।
অভিধানে ইতেকাফ অর্থ- অবস্থান করা, আবদ্ধ করা, আটকে রাখা। বান্দা যেহেতু নিজেকে যাবতীয় পার্থিব বিষয়াবলী থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র মহান প্রভুর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ রাখেন, তাই এটিকে ইতেকাফ বলা হয়।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি বিধান জারি করলাম ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এর প্রতি- তোমরা পবিত্র রাখো আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীর জন্য।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)
ইতেকাফ হচ্ছে রাসুল (সা.) এর এরূপ একটি আমল, যা হিজরতের পর তিনি কখনও ছাড়েননি। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরতের পর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত প্রতি রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করেছেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পত্নীগণ ইতেকাফ করেছেন। (বুখারি, মুসলিম)
ইতেকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদে হারাম, মর্যাদার অবস্থানে দ্বিতীয় স্থান হচ্ছে মসজিদে নববী (সা.) এবং তৃতীয় বায়তুল মোকাদ্দাস। অতঃপর জামে মসজিদসমূহ, সবশেষে ওইসব মসজিদ যেগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা হয়, অর্থাৎ পাঞ্জেগানা মসজিদ।
ইতেকাফ তিন প্রকার। যথা, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়াহ ও মুস্তাহাব। বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বা এমনিতেই রমজানের শেষ দশক ইতেকাফের মান্নত করলে তাকে ওয়াজিব ইতেকাফ বলে।
প্রতি জামে মসজিদে রমাজানের শেষ দশক ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়াহ। প্রতি মসজিদে ন্যূনতম একজন পুরুষ ইতেকাফ আদায় করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। অন্যথায় ওই মহল্লার সকলেই এ ইবাদাত ত্যাগকারীর পাপকারী বলে গণ্য হবেন।
ওই দু’ প্রকার ইতেকাফ ছাড়া যেকোনো সময় মসজিদে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করা হচ্ছে মুস্তাহাব। যেমন যে কোনও সময় মসজিদে প্রবেশকালে অন্তরে এ ইচ্ছা রাখা- আমি ইতেকাফের নিয়তসহ মসজিদে প্রবেশ করছি। এটি সহজে অতিরিক্ত পুণ্য লাভের একটি সুন্দর পন্থাও। আমরা তা করতে সচেষ্ট হবো।
ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতেকাফের জন্য রোজা শর্ত। এ দু’ প্রকার ইতেকাফের জন্য ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। ইতেকাফকারী পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত ও সর্বোত্তম স্থান মসজিদে, বছরের শ্রেষ্ঠ সময়ে অবস্থান তথা ইতিকাফকালে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, মূল্যবান সময় ও স্থানে ইবাদতের জন্য যেমন কয়েকগুণ বাড়িয়ে সওয়াব দেওয়া হয়, বিপরীত ক্ষেত্রেও তাই। অর্থাৎ পাপকাজে গুনাহও বেশি হয়। সুতরাং ইতেকাফকারী সবসময় নিজেকে ইবাদতে ব্যস্ত রাখবেন। সবধরনের গুনাহর কাজ এবং অনর্থক গল্পগুজব থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবেন। মসজিদের আদব পরিপন্থী যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ইতেকাফ বিশুদ্ধ হওয়ার আবশ্যকীয় মাসাইল অনুসরণ করবেন।
ইতেকাফকারী ২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদিত হওয়া পর্যন্ত রোজাসহ মসজিদে অবস্থান করতে হবে।
কারও রোজা ভেঙে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে বা সাওমের সক্ষমতা না থাকলে অথবা রোজা অবস্থায় নিষিদ্ধ কোনো কাজ ইতেকাফকারীর পক্ষ থেকে সংঘটিত হলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
ইতেকাফকারী প্রাকৃতিক প্রয়োজন, ওজু ও ফরজ গোসলের কারণ ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন না। এ প্রয়োজনগুলোর কোনো একটির জন্য বের হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মূহূর্তকাল সময়ও বাইরে থাকতে পারবেন না। এমনকি কেউ ইতেকাফের কথা ভুলে গিয়ে বাইরে সামান্যতম সময় অতিবাহিত করলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, ইতেকাফে প্রাকৃতিক প্রয়োজন, ওজু ও ফরজ গোসল, পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতেকাফ করলে জুমার নামাজের জন্য জামে মসজিদে যাতায়াত এবং মসজিদে খাবার এনে দেয়ার মতো কেউ না থাকলে পানাহারের জন্য যাতায়াতের অনুমতি (অবশ্য তা একদম প্রয়োজন অনুযায়ী ও চুপচাপ হতে হবে) ব্যতীত ব্যক্তিগত, ধর্মীয় বা জনসেবামূলক কোনো কাজের জন্য বাইরে বের হওয়ার অনুমতি নেই।
তাই অভ্যাসগত সাধারণ গোসল, কাপড় কাঁচা, হাত-মুখ বা অন্য কিছু ধোয়া-মুছা/ পরিষ্কার করা বা ধূমপান, গল্পগুজব প্রভৃতির জন্য বাইরে বের হওয়া মাত্রই ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যায়।
ইতেকাফকারী অনুমতি ছাড়া কারও কোনো কিছুতে হাত দেবেন না, ব্যবহার করবেন বা। মসজিদ বা মুসল্লির ক্ষতি হয় এরূপ সবকিছু থেকে সর্বদা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। ইতেকাফ সঠিক ও পুণ্যময় হওয়ার জন্য ইতেকাফকারীকে বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই যত্নবান হতে হবে।
মহিলারা নিজ নিজ ঘরের নির্জন স্থানে বা একটি কক্ষে ইতেকাফ করবেন। ইবাদত, পানাহারসহ সব কাজে ওই স্থানেই নিজেকে সব সময় আবদ্ধ রাখবেন। অনর্থক ও পার্থিব কথাবার্তা, কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও ওজুর প্রয়োজন ছাড়া নির্দিষ্ট স্থান হতে বের হবেন না।
ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, রমজানের শেষ দশক ইতেকাফের সওয়াব হচ্ছে, দুটি হজ ও উমরাহ’র সমপরিমাণ। (বায়হাকি)
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন-
‘ইতেকাফের মাহাত্ম্য হলো, আল্লাহর সাথে রুহ ও অন্তরের সম্পর্ক স্থাপন করা। ইতেকাফকারীর দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো- যে কারো দরবারে হাজির হয়ে এ কথা বলে যে, আমার দরখাস্ত কবুল না করা পর্যন্ত আমি ফিরবো না।’
সুতরাং বলা যায়, ইতেকাফ প্রভুর ভালোবাসা এবং সান্নিধ্য লাভের সোপান।
নিজেকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে পবিত্র জীবন গঠনের অবারিত সুযোগ রয়েছে ইতেকাফে। যাবতীয় পাপকাজ থেকে মুক্ত থেকে একনিষ্ঠভাবে খোদাভীরু-মুত্তাকি হিসেবে যে কেউ নিজেকে গড়ে তুলার ব্যতিক্রমধর্মী অনুশীলন হচ্ছে ইতেকাফ।