আশুরার তাৎপর্য ও কারবালার শিক্ষা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ২৮ ২০২০, ২২:৪৯

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী: হিজরী বা আরবী বর্ষের প্রথম মাস মহররম। কোরআন-হাদীসে চারটি মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত বলে ভূষিত করা হয়েছে। তন্মধ্য থেকে অন্যতম হচ্ছে এ মাস। মহররম মাসের ১০ তারিখ কে বলা হয় আশুরা। `আশুরা’ শব্দটি আরবি `আশারাতুন’ থেকে এসেছে, অর্থ- দশ। এহিসেবে মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।

আমরা অনেকেই মনে করি এদিনটি কারবালার প্রান্তরে সংগঠিত নবীজি সা. এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন রা. এর শাহাদাতের কারণেই বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং তাৎপর্যমণ্ডিত। আমরা এদিনটিকে শুধু এঘটনার সাথে নির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ করে ফেলি। অথচ পৃথিবীর প্রায় সূচনাকাল থেকেই এদিনটি মহিমান্বিত এবং পরবর্তীতে আরোও অনেক বিষয়াবলী এটিকে বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ করেছে। যেমন, এদিনেই আল্লাহ তায়ালা আসমান-যমীন এবং আদিপিতা হজরত আদম আ. কে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। হজরত মূসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়কে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেছেন। হজরত নূহ আ. এর নৌকাকে মহাপ্লাবন থেকে কুলে লাগিয়েছেন। হজরত ইউনূস আ. কে মাছের পেট থেকে মুক্ত করেছেন। হজরত ইবরাহীম আ. কে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। হজরত ইয়া`কূব আ. কে পুনর্বার চক্ষুজ্যোতি দিয়ে সৌভাগ্যবান করেছেন। হজরত ঈসা আ. কে দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে নিরাপদে আকাশে তুলে নিয়ে সুরক্ষিত রেখেছেন। হজরত আইয়ূব আ. কে কঠিন ব্যাধি থেকে সুস্থতা দান করেছেন। হজরত ইউসুফ আ. কে কূপ থেকে উত্তোলন করেছেন এবং আরোও নানান দুর্লভ ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে।

ইসলামে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজার বিধানের মাধ্যমে আশুরার রোজার ফরজ বিধান রহিত করে এটিকে নফল সাব্যস্ত করা হয়। হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, `রমজানের রোজার পর শ্রেষ্ঠ (নফল) রোজা হচ্ছে আশুরার রোজা।’ (তিরমিজি)

ইসলাম পূর্ব যুগে মক্কার কুরাইশ গোত্র ও মদীনার ইহুদি অধিবাসীরা এদিন রোজা রাখত। রাসূল সা. মদীনায় হিজরতের পর ইহুদিদের রোজা রাখতে দেখে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে- এদিন আল্লাহ তায়ালা মূসা আ. ও তাঁর জাতিকে অবাধ্য ফেরআউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরআউন ও তার সম্প্রদায়কে সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছেন। মূসা আ. কৃতজ্ঞতা স্বরুপ প্রতিবছর রোজা রাখতেন এজন্য আমরাও রাখি।

একথা শুনে রাসূল সা. বললেন, `মূসা আ. কে অনুসরণের ক্ষেত্রে তোমাদের থেকে আমরা অধিক ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসূল সা. রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার জন্য বলেন।’ (মুসলিম)

ইহুদিদের সাথে আমাদের রোজার পার্থক্য রাখতে রাসূল সা. আশুরা তথা ১০ মুহররম এর রোজার সাথে ৯ বা ১১ মুহররম রোজা রাখতে নির্দেশ করেছেন। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, `তোমরা ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখ।’ রাসূল সা. অন্য হাদীসে বলেছেন, `আমি যদি আগামী বছর জীবিত থাকি তাহলে মহররমের ৯ ও ১০ তারিখ রোজা রাখব।’ আশুরার দিন সাহাবায়ে কেরাম রা. কর্তৃক শিশুদের রোজা রাখতে উৎসাহিত করার কথাও হাদিসে পাওয়া যায়।

সন্দেহ নেই, কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা এ দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত সত্য-মিথ্যার লড়াই আমাদের শিক্ষা দেয়, আমরা যেন কোনও অপশক্তির কাছে মাথা নত না করে

‌আজীবন সত্যের পক্ষে লড়ে যাই। সকল প্রকার স্বৈরশাসক, জালেম-অত্যাচারীর বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে নিজেদের উৎসর্গ করি। দুঃখের কথা হচ্ছে, আমরা মহিমান্বিত আশুরা বা নির্মম কারবালা ট্রাজেডি থেকে কোনও শিক্ষা ও পাথেয় গ্রহন করি না। আবার অনেকে প্রতিবছর কিছু কুসংস্কার যেমন, শোকগাথা জারিগান, তাজিয়া মিছিল, হালুয়া-শিরনী বিতরণ, নিরামিষ ভোজন এবং এ মাসে বিয়ে-শাদি থেকে বিরত থাকার মধ্যেই কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শহীদ হওয়া হজরত হুসাইন রা. ও তাঁর পরিবারের প্রতি নিজেদের প্রেম, সহমর্মিতা প্রকাশ এবং সার্থকতা খুঁজেন। অথচ এগুলো নিছক অজ্ঞতা কিংবা স্বার্থান্ধতা আর খাহেশ পূর্ণ করা বৈ কিছু নয়। যা আদৌ ইসলাম সমর্থন করে না বরং কঠোরভাবে এগুলো থেকে বারণ করে। আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে নবীজি সা. এর দৌহিত্র হুসাইন রা. এর প্রেমের নামে এসব ভ্রান্ত শিয়া চিন্ত-চেতনা, মতবাদ ও অজ্ঞতা থেকে নিজেদের পবিত্র রাখা এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষজনকে এসব পাপাচার থেকে বের করার প্রচেষ্টা চালিয়া যাওয়া।

‌করোনাকালের এ সময়ে তাজিয়া মিছিল, লোকসমাগম নিষিদ্ধ হলেও আমাদের চারপাশের ইমামবাড়াগুলো ইতোমধ্যে তাদের তথাকথিত আদর্শ ও চেতনায় পুরোপুরিভাবে সরব হয়ে ওঠেছে। সামাজিক দূরত্ব, সাস্থ্যবিধির কোনও তোয়াক্কা না করে জারিগান, সমাবেশ, মেলা, বিভিন্ন প্রকার অবৈধ খেলাও জমে ওঠেছে। এমনকি এসব ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে শিশুরাও দেদারছে লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়গুলোতে একান্তভাবে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আসুন, যাবতীয় কুসংস্কার, স্বার্থান্ধতা, অন্যায়-ভোগবাদী মনোভাব ঝেড়ে ফেলে ত্যাগের মহিমায় জীবনকে ভাস্বর করি। জাতীয় কবি, কাজী নজরুল ইসলামের মতো আমাদেরও উপলব্ধি হোক হোক- `ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’