আলিবাবা আম্যাজন Pinduoduo বনাম ইভ্যালি: একটি নির্মোহ পর্যালোচনা
একুশে জার্নাল
আগস্ট ২৫ ২০২০, ২৩:১১
মুহম্মদ ফজলুল করিম
যখন আলিবাবা এবং আম্যাজনদের মনে হচ্ছে চিরকালই এরা অপ্রতিদ্বন্দ্বী থেকে যাবে ই-কমার্সে, তখন একটা ঘটনা ঘটল। গুগলের ইকমার্স টিমের একজন ইঞ্জিনিয়ার চাকরি ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়ে একটা ই-কমার্স সাইট বানানো শুরু করল। প্ল্যাটফর্মের নাম দিল Pinduoduo। শুরু করার মাত্র পাঁচ বছরে যে প্ল্যাটফর্মটা আজকে ৯৭০০ কোটি টাকার একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। HSBC কিংবা Shell এর মত বিশ্বখ্যাত কোম্পানির বর্তমান ভ্যালুয়েশনও এর চেয়ে কম। আজকে সেই গুগলে চাকরি ছেড়ে দেয়া ব্যক্তিটি চায়নার তৃতীয় শীর্ষ ধনী।
কিন্তু Pinduoduo’র বিজনেস মডেলটা ই-কমার্স থেকে একটু আলাদা। এ মডেলকে বিজনেসের ভাষায় অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এটাকে কেউ বলে সোশ্যাল কমার্স। কেউ বলে গ্রুপ বায়িং মডেল। কেউ বলে C2M। মানে কনজ্যুমার টু ম্যানুফ্যাকচারার। এক কথায় উৎপাদক থেকে সরাসরি ক্রেতা। হ্যাঁ, এই প্ল্যাটফর্মটা উৎপাদক থেকে পণ্য সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়। মাঝখানে কেউ থাকে না, থাকে শুধু Pinduoduo। তারা কি সুবিধা দেয়। তারা জাস্ট একটা মিডিয়াম। জাস্ট মানে জাস্টই।
আম্যাজন, আলিবাবা এরাও জাস্ট মিডিয়ামই। কিন্তু জাস্টের বাইরেও এরা আরও কিছু কাজ করে। এই সকল ইকমার্সে যেটা হয় সেটা হচ্ছে উৎপাদক থেকে পণ্য যায় সেলারের হাতে। এরা হচ্ছে আসলে সেলার এবং ক্রেতার মধ্যকার মিডিয়াম। আবার কিছু ক্ষেত্রে ইকমার্স প্ল্যাটফর্মরা করে কি, সরাসরি পণ্য বাল্ক এমাউন্টে উৎপাদক থেকে কিনে এনে মজুদ করে রাখে। এরপর ক্রেতা অর্ডার দিলে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেয়।
কিন্তু প্রায় নতুন এই বিজনেস মডেলে এই কাজটাও করা হয় না। কারণ, মজুদ রাখার খরচ এবং মজুদ রাখা সময়ের কস্ট অফ মানি এই দুইটাই তো আসলে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সো মজুদ রাখা যাবে না। এক কথায় পণ্য নিজের কাছেই আনা যাবে না। মানুষ অর্ডার দিবে। উৎপাদকের গুদাম থেকে পণ্য সরাসরি ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে।
সোজা বাংলায়, ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসার ক্ষেত্রে বিজনেস মডেল শব্দটা আমি পছন্দ করি না। কারণ সবগুলো বিজনেস মডেলই আসলে একধরণের এফিসিয়েন্সি মডেল। তাই বিজনেস মডেল না বলে এফিসিয়েন্সি মডেল বললে বুঝতে আরও সুবিধা হয়। Pinduoduo এফিসিয়েন্সি মডেল মেনে অন্যদের থেকে আরও এফিসিয়েন্ট হওয়ার চেষ্টা করেছে। পণ্য সরাসরি উৎপাদক থেকে ক্রেতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। এতে কম খরচে পণ্য ক্রেতাকে পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
কিন্তু…কিন্তু কথা হচ্ছে… উৎপাদকরা তো খুচরা ব্যবসায় করেন না। উৎপাদকরা সবসময় বাল্ক আকারে পণ্য বিক্রি করে। একশো ফ্রিজ বিক্রি করে। একটা না। কিন্তু, ক্রেতা তো অর্ডার দেয় মাত্র একটা। বিরাট সমস্যা। Pinduoduo টাইপের ইকমার্সরা আসলে এই প্রবলেমটাই সলভ করেছে। তাঁরা যেটা করেছে সেটা হচ্ছে গ্রুপ বায়িং ফিচার এনেছে। মানে হচ্ছে, আপনি যদি আপনার বন্ধু-বান্ধব সহ কিনেন, আপনারা সবাই কম দামে পণ্যটা পাবেন। যেটাকে বলে সোশ্যাল কমার্স। কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। এটা আসলে এমএলএম না। এমএলএমে যেটা হয় সেটা হচ্ছে, আপনি আপনার বন্ধু বান্ধব ডেকে এনে তাঁদের সহ কিনলে, শুধু আপনিই কম টাকায় কিনতে পারবেন। কিন্তু গ্রুপ বায়িং এ সবাই কম দামে পাবে। আপনি কাউকে রেফার করার জন্যে কোন টাকা পাচ্ছেন না।
কিন্তু কথা হচ্ছে, গ্রুপ বায়িং কিভাবে হবে। আপনার ফ্রিজ দরকার। আপনার ইয়ারি দোস্তের দরকার টিভি। হল না তো। এক্ষেত্রে তাঁরা সাহায্য নিলেন টেকনোলজির। কোম্পানিটা দুইটা বিজ্ঞাপন দিল। একটা ফ্রিজের। আরেকটা টিভির। আপনার হাতে কিন্তু কোন স্টক নাই। কম দাম দেখে অনেক কাস্টমার এসে অর্ডার দিল। একশো জন দিল ফ্রিজ, একশো জন দিল টিভি। আপনি কি করলেন, আপনি উৎপাদক থেকে একশো টিভি, আর একশো ফ্রিজ কম দামে কিনে এনে সবাইকে সামান্য লাভ রেখে কম দামে বুঝিয়ে দিলেন। আপনি যেহেতু স্টক করছেন না, সেহেতু মজুদ খরচ এবং কস্ট অফ মানি কোনটাই নাই।
এখানে ধরেন একটা সমস্যা দেখা দিল। টিভি অর্ডার দিল মাত্র ৭৫ জন। এবার আপনি কি করবেন? কিছুই করতে পারবেন না, আপনার ওয়েট করতে হবে, আরও ২৫ টা অর্ডার পাওয়ার জন্যে। ৯৯ জন হলেও হচ্ছে না। কারণ, উৎপাদককে শুধুমাত্র ১০০টা অর্ডার দিলেই কম দামে আপনাকে দিবে। তারপরই আপনি সামান্য কিছু লাভ রেখে ১০০ জনের বাসায় পৌঁছে দিবেন।
আমাদের দেশে Pinduoduo এর মতই সোশ্যাল কমার্স বা C2M মডেলটাই চালু করেছে ইভ্যালি। তবে ইভ্যালির সিইও দাবি করেন, তাঁরা গ্রুপ বায়িং ব্যাপারটা এভাবে করেন না। তবে, প্রায় ৮০ শতাংশ বিক্রিই আসে ডিরেক্ট ম্যানুফ্যাকচারার থেকে। তারপরও আমি জানি না এটাকে কেউ কেউ এমএলএম মডেল বলছেন কেন? বড় বড় পত্রিকাতেও এমএলএম শব্দের পাশাপাশি অন্তত গ্রুপ বায়িং, C2M, সোশ্যাল কমার্স শব্দের ব্যবহার দেখতে পেলে ভাল লাগত। যেহেতু বলছেই, অন্তত এভাবে বলতে পারত, সোশ্যাল কমার্স বা C2M এর আড়ালে এমএলএম ব্যবসা!
আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, ইভ্যালিতে মারাত্মক কিছু ভুল হয়েছে। এই যে কিছুক্ষণ আগে বললাম না, ১০০ টিভির অর্ডার লাগবে, কিন্তু ৭৫টা অর্ডার পেয়েছে। ইভ্যালি এখানে যেটা করে সেটা হচ্ছে, আরও ২৫টা অর্ডারের অপেক্ষায় থাকে। আর বাকি ৭৫ জনও এতিমের মত অপেক্ষায় থাকে। কমেন্টে এসে বলে, ভাই আমার একটা টিভির অর্ডার ছিল। আজকে একশো দিনেও পাই নাই। অথচ একশো দিন পরে ইভ্যালি দেখে, টিভির অর্ডার এই পর্যন্ত পড়ছে মাত্র ৯৯টা! আরও এক জন অর্ডার দিলেই ১০০টা অর্ডার হবে। তখন ইভ্যালি আরেকবার টিভির বিজ্ঞাপন দেয়, একজন ক্রেতা খুঁজে পাওয়ার আশায়। কিন্তু, সেই ৯৯ জন কমেন্টে এসে কমেন্ট করে, ইভ্যালি একটা বাটপার! আমার টিভি দেয় না। কমেন্ট পড়ে কেউ আর সাহস করে টিভির অর্ডার দেয় না। ৯৯ জনের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হয়। এদিকে কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার ৯৯ জনের অভিযোগ, রিফান্ড রিকোয়েস্ট এবং গালিগালাজে দিশেহারা। সাথে সাইড এফেক্ট হিসেবে, অন্য প্রোডাক্টেও অর্ডার কমে যায়… পুরো মডেলটা ফেইল খেয়ে যায়।
কিন্তু Pinduoduo পুরো সমস্যাটাকে অন্যভাবে ডিল করেছে। তাঁরা মার্কেট রিসার্চ, ডেটা এনালাইসিস, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং কাস্টমার বিহেভিয়ার প্রেডিকশনের মাধ্যমে আগেই ধারণা করতে পারে, আমরা যদি টিভির বিজ্ঞাপন দেই, তাহলে আসলে ১০০ টিভির অর্ডার পাবো না। কিন্তু ফ্রিজের ক্ষেত্রে পাবো। ইভ্যালির মত তাদের কোন স্টক নাই। কিন্তু এলগরিদম এই হাজার হাজার প্রোডাক্টের ক্রেতা সংখ্যা প্রেডিকশন করে, যেগুলোর অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনা কম, সেগুলো অটোমেটিক স্টক আউট দেখিয়ে দেয়। আমি Pinduoduo ইউজ করে দেখেছি, তাদের ইউজার একাউন্ট ড্যাশবোর্ড ফেসবুকের নিউজফিডের মত ইন্টারএকটিভ। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা রিকমেন্ডেশন। গুগলে কাজ করার সময় সে ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা ভাল কাজে দিয়েছে এখানে। আর কোন ক্ষেত্রে যদি আসলেই সমস্যা হয়, মানে ৭৫ জনের অর্ডার নিয়ে আর ২৫ জন পাওয়া যাচ্ছে না। তখন তাঁরা লস দিয়ে ৭৫টা পণ্য বেশি দামে কিনেই সবাইকে কম দামে পোঁছে দেয়।
ইভ্যালি আসলে যে কাজটা করেছে সেটা হচ্ছে অনেক বড় ধরণের ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই কাজটা করছে। তাঁরা অনেক টাকা খরচ করে, ৩৫ লাখ ইউজার রেজিস্টার করিয়েছে। কিন্তু, সেই টিভির ৭৫ জন ক্রেতার হাহাকারে ৩৫ লাখ লোক বলে, থাক বাবা, আমি টিভি বেশি দামেই কিনবো! ইভ্যালির এখন দরকার বড় ইনভেস্টমেন্ট। ডেটা এনালাইসিস প্রযুক্তিতে বড়সড় বিনিয়োগ, যাতে Pinduoduo লেভেলের ইন্টার্যাক্টিভিটি থাকে। প্রয়োজনে Pinduoduo’র মত লস দেয়া। যেমন ৭৫ জনকে বেশি দামে কিনে দেওয়া। ওয়েট করানো না। কারণ, একজন স্যাটিস্ফায়েড কাস্টমার জাস্ট আপনাকে ছোট করে একটা থ্যাংক য়্যু দিবে। আর ডিস্যাটিস্ফায়েড কাস্টমার আপনাকে গালি দিবে। খারাপ রিভিউ দিবে। এরপর ফেসবুক পেজ খুলবে। সেই পেজে আপনার বদনাম করবে। ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে বদনাম করবে। যাকে সামনে পাবে, তার কাছে সারাজীবন ধরে আপনার নামে বদনাম করবে। তাও তার রাগ কমবে না। এটা আমার কথা না। Mark Cuban এর কথা।
আর যদি ইভ্যালি বুটস্ট্রাপ করে নিজের টাকায় এগোতে চায়, তাহলে উচিত এগ্রেসিভ মার্কেট পেনিট্রেশন না করে, ধীরে সুস্থে আগানো। কারণ, হাজারটা স্যাটিসফায়েড কাস্টমার যে সুনাম তৈরি করবে, তা একজন ডিস্যাটিসফায়েড কাস্টমার একা ধ্বংস করে দিতে পারবে! কম দামকে ক্যাশব্যাক না বলে, জাস্ট কম দাম বললে আরও ভাল হয়। বাজারের চেয়ে ১০-১৫% কম দিলেও সেটা বিরাট ব্যাপার। দরকার হলে ভাউচার দিক। উৎপাদককে বোঝানো হোক, যে আমাকে প্লিজ কম দামে বিক্রি করার সুযোগ দিন। শুনেছি শোরুম মালিকদের কথা চিন্তা করে উৎপাদক অনেক সময় বলে দিতে বাধ্য হয়, যে কম দাম বলা যাবে না!
একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় আজকের ভাইরাল রিপোর্টের পর ইভ্যালির স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু পরিবর্তন দরকার। সিইও রাসেল সাহেব আশা করি এই কাজগুলো করবেন। Always regulate yourself before someone else regulates you! আমি ব্যক্তিগতভাবে ওয়েব টেকনোলজি নিয়ে কাজ করি। এইজন্যে টেকস্ট্যাক দেখেই বলতে পারি, তিনি বাংলাদেশের অন্য যেকোন সিমিলার স্টার্টআপের তুলনায় প্রযুক্তিতে অনেক অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছেন। এটা আশা করি আরও বাড়বে। কারণ, ব্লিডিং এজ প্রযুক্তি ছাড়া শুধু মার্কেটিং করে কাস্টমার সংখ্যা বাড়িয়ে এইসব সমস্যার সমাধান সম্ভব না। কারণ, মার্কেটিং এর সময় করা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে, উপকারের চেয়ে অপকার হয়।
আমি ইভ্যালির কেউ না। ইভ্যালিতে আমি আসলে জীবনে একটা অর্ডারও দেই নাই। কিন্তু আমি চাই ইভ্যালি থাকুক। শুধু ইভ্যালি না, ইভ্যালির মত আরও প্রতিষ্ঠান আসুক। শত শত এরকম সোশ্যাল কমার্স খোলা হোক। কারণ, এই এফিসিয়েন্সি মডেল আসলে কাস্টমারকে অর্থাৎ আমাকে কম দামে পণ্য পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আমি চাই ফ্রিজ। আমি শোরুমের কর্মচারীর বেতন, দশ হাজার স্কয়ার ফিটের ভাড়া, একশোটা বাতি, এসির হাজার হাজার টাকার বিলের ভাগ দিতে রাজি না।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)