আরাফার রোযা কখন রাখবেন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ০৭ ২০২২, ১৯:৩৮

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দিন আহমদ: যিলহজ্বের প্রথম দশদিন অতি ফযীলতপূর্ণ। এই দশ দিনের আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে অতিপ্রিয়।বিখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা(রা.)থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন- অর্থাৎ এমন কোনো দশক (দশদিন) নেই, যার নেক আমল আল্লাহর কাছে এই দিনগুলোর চেয়েও বেশি প্রিয়।

আরজ করা হল, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি নয়? বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়, তবে যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে এবং কোনো কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)।

(এ হাদীসে যিলহজ্বের দশ দিনের আমল-ইবাদতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।) (আলমুসনাদ, আহমদ, হাদীস : ১৯৬৮ , হাদীসটি সহীহ বুখারীতে আছে। (দ্র. হাদীস : ৯৬৯, কিতাবুল ঈদাইন); (ফতহুল বারী, ইবনে রজব ৬/১১৩)

তাই রোযাও একটি নেক আমল। তবে যেহেতু ঈদের দিন রোযা রাখা নিষেধ তাই ঈদের দিন বাদ দিয়ে তার আগের নয় দিন রোযা রাখাও এ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।বিশেষ করে ইয়াওমে আরাফা তথা নয় যিলহজ্বের রোযা উল্লেখযোগ্য। যেমনটি হাদীসের মধ্যে এসেছে, রাসুলুল্লাহ(সা:)বলেন, ইয়াওমে আরাফার রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা আগের এক বছরের ও পরের একবছরের গোনাহ মাফ করবেন।(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২)

ইয়াওমে আরাফা বলতে কী বুঝায়?

‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ নয় জিলহজ্ব। এটিই সঠিক ব্যাখ্যা।কারণ এই রোযা আরাফা বা উকুফে আরাফার আমল নয়; তা ঐ তারিখের আমল। ইয়াওমে আরাফা’হচ্ছে, নয় যিলহজ্বের পারিভাষিক নাম।যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রোকন হজ্বের প্রধানরোকন উকুফে আরাফা ঐ স্থানের তারিখ হিসাবে ৯ই যিলহজ্বে আদায় করা হয় তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’। একারণে যেসব আমল আরাফা বা উকূফে আরাফার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজ্বের নয় তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট,সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’র আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইয়াওমে আরাফা অর্থ ৯ যিলহজ্ব এর আরেকটি দৃষ্টান্ত তাকবীরে তাশরীক। এটি আরাফা বা উকুফে আরাফার বিশেষ আমল নয়। এটি শুরু হয় ৯ই যিলহজ্ব ফজর থেকে। অথচ যে দলীল দ্বারা ৯ তারিখ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু হওয়া প্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দই আছে।

দেখুন:- আরবী পাঠ এই—

عن علي رضي الله عنه : أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة، إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق، ويكبر بعد العصر.(رواه ابن أبي شيبة في مصنفه وإسناده صحيح كما في الدراية.) (আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৫৬৭৭, ৫৬৭৮)

মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর। এটি প্রমাণ করে, ইয়াওমে আরাফা’একটি তারিখের নাম,আর তা হচ্ছে ৯ই যিলহজ্ব । যেমন‘ ইয়াওমুন নাহর’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে দশ যিলহজ্ব।মোটকথা হল এই যে ; আরাফার দিন বলতে বুঝায় যিলহজ্বের নবম তারিখ ।

সৌদি আরবে যেদিন আরাফা বা উকূফে আরফা সেদিনকে বিশ্বের সব দেশে আরফার দিন ধরে নিতে হবে এমনটি দাবী করার সুযোগ নেই।কারণ উদয়াচলের ভিন্নতায় তারিখের ভিন্নতা থাকায় সৌদিতে যেদিন আরফা সেদিন অনেক দেশে আট যিলহজ্ব বিদায় ঐদিন আরফার রোযা রাখা যাবেনা।

বর্তমান সময়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী লোক তাদের দাবি যেদিন সৌদিতে আরফা সেদিনই বিশ্বের সকল দেশেই আরফার দিন বিবেচ্য বিদায় ঐদিন আরফার রোযা রাখতে হবে যা নিতান্তই মূর্খতা আর বিভ্রান্তি ছড়ানো বৈ কিছু নয় । তাই দেশে দেশে অবস্থানরত মুসলিমরা নিজ নিজ দেশের তারিখ অনুসারে জিলহজের ৯ তারিখে রোজা রাখবে। আর এই রোজার সঙ্গে ‘আরাফা’র ময়দানের কোনো সম্পর্ক নেই।

এ বিষয়ে ‘সারাবিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ শরীয়াহ কী বলে’  এই লিঙ্কে ক্লিক করে বিস্তারিত জানতে পারেন।

সারাবিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ; শরীয়াহ কী বলে

উল্লেখ্য; ৯ই যিলহজ্ব যদি শুক্রবার হয় হুকুম কী? শুক্রবার রোযার জন্য নির্দিষ্ট না করার হাদীসটি কেউ উদ্ধৃত করে বলতে পারেন যে, শুক্রবার দিনে আরফার রোযা রাখতে পারবেন না ।

কারণ সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে,বাইতুল্লাহর তাওয়াফকালে হযরত জাবির (রা.) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,শুক্রবারে রোযা রাখতে কি আল্লাহর রাসূল (সা:) নিষেধ করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এই ঘরের মালিকের কসম!’

আসুন আমরা জেনে নেই হাদীসের প্রকৃত মর্ম কী ? শুক্রবার আরফা হলে ঐদিন কী রোযা রাখা যাবে?

হাদীসে শুধু নিষেধের কথা বর্ণিত হয়েছে। তার ক্ষেত্র, পর্যায় ও তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝতে হলে এ হাদীসের অন্যান্য বর্ণনা এবং এ বিষয়ের অন্যান্য হাদীস সামনে রাখতে হবে। কিছু হাদীস লক্ষ্য করুন:—

(১) আবু হুরায়রা(রা.)থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা:)বলেন, তোমরা কেউ জুমুআর দিন রোযা রেখোনা তবে যদি তার আগের বা পরের দিন রোযা রাখো (তাহলে অসুবিধা নেই)।(সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯৮৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৪৪/১৪৭, কিতাবুস সিয়াম)

(২) অন্য বর্ণনায় আবু হুরায়রা (রা.)থেকে আছে, আল্লাহর রাসুল(সা:) বলেন, ‘তোমরা জুমার রাতকে অন্যান্য রাত থেকে আলাদা করে ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করো না। এবং জুমার দিনকে অন্যান্য দিন থেকে আলাদা করে রোযার জন্য নির্ধারণ করো না। তবে তা (জুমার দিন) যদি তোমাদের কারো রোযায় পড়ে যায় তাহলে অসুবিধা নেই। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৪৪/১৪৮)

এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যারা জুমার আগের বা পরের দিনও রোযা রাখে, কিংবা জুমার দিনটি পড়ে যায় তার সাধারণ অভ্যাসের রোযার তারিখে, যেমন কারো আইয়ামে বীযের রোযা রাখার অভ্যাস আছে (আর এর কোনো দিন জুমার দিন হল) কিংবা বিশেষকোনো দিবসের যেমন ইয়াওমে আরাফার রোযা রাখার অভ্যাস আছে আর ঐ তারিখটি জুমার দিন হল, তার জন্য এ দিন(আলাদা করেও) রোযা রাখা বৈধ (হারাম নয়)। তেমনি কেউ মান্নত করল, অমুক যেদিন আসবে কিংবা অমুক যেদিন সুস্থ হবে সেদিন রোযা রাখব আর (ঘটনাক্রমে) দিনটি জুমার দিন হল, তার জন্যও (শুধু) এদিন রোযা রাখা জায়েয।(ফাতহুল বারী ৪/২৭৫)

উপরের আলোচনা থেকে অন্তত এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, ইয়াওমে আরাফা (৯ যিলহজ্ব) যদি শুক্রবার হয় আর আরফার রোযার উদ্দেশ্যে ঐদিন রোযা রাখেন তাহলে তাদের ক্ষেত্রে জুমার দিন রোযা না-রাখার আদেশ সম্বলিত হাদীস প্রয়োগ হবেনা ।অর্থাৎ শুক্রবার আরাফা তথা ৯ যিলহজ্ব হলে আরাফার রোযা রাখা যাবে শরয়ী কোন সমস্যা হবেনা।

এবছর আমাদের দেশসহ নিকটবর্তী বিভিন্ন দেশে এবার ৯ই যিলহজ্ব হবে শনিবার। তাই বাংলাদেশের মুসলমান যারা ঐদিনের রোযা রাখতে চাইবেন তারা ৮ জিলহজ্ব শুক্রবার দিবাগত রাত সেহরি খেয়ে শনিবার দিনে রোযা রাখবেন। যেহেতু ঐ দিন হবে ৯ জিলহজ্ব।

আল্লাহ পাক যেন আমাদের সবাইকে আরাফাসহ কুরবানীর সকল হুকুম আহকাম সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করেন। আমীন।

লেখক: শিক্ষাসচিব, জামেয়া ফারুকিয়্যাহ সিলেট।