আমাদের এপিস্টেমলজিকাল মেট্রিক্স নিয়ে কয়েকটি নোক্তা
একুশে জার্নাল ডটকম
মার্চ ০৩ ২০১৯, ১২:৩১

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত: বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মেট্রিক্স হল ইউরোপীয় মডার্নিটির কলকাত্তাইয়া ফিল্টার্ড ভার্শন। একথা বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে যাওয়ার কালেও সত্য।
কারা এদেশের সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে রুল করছেন আপনি সেদিকে খেয়াল করলেই এটা পরিস্কার হবে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়ান্ট যারা যেমন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, বদরুদ্দীন উমর, সমর দাস, আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ — এদের সবার এপিস্টেমলজিকাল মেট্রিক্স কমবেশি ইউরোপীয় আধুনিক পেরিপ্যাটেটিক বা রেশনাল-এমপিরিক্যাল ডোমেইন। অর্থাৎ গ্রেইকো-রোমান ঐতিহ্যের আলোকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্ট যে সেক্যুলার আধুনিক প্যারাডাইম তৈরি করেছে তা ইংরেজ কলোনিয়াল কলকাতার ফিল্টারে “বাংলার রেনেসাঁ” আকারে যেভাবে ধরা পড়েছিল সেটাই ঢাকাই বিদ্বৎসমাজের এপিস্টেমলজিকাল মেট্রিক্স বা জন্মভূমি। হিউম্যান রিজন-ই হল এই এপিস্টেমলজির প্রধান মেথড ও টুল।
জুডিও-খ্রিস্টান-ইসলামিক প্রফেটিক রেভেলেশন ভিত্তিক আরেকটি যে এপিস্টেমলজিকাল প্যারাডাইম রয়েছে তা কলকাতার ফিল্টারে ঢাকাই ইন্টেলেকচুয়াল মেট্রিক্সে ততটা ধরা পড়েনি। একারণে ঢাকাই বিদ্বৎসমাজে বরাবরই সৈয়দ আমীর আলী, মওলানা আকরম খাঁ, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম, আবদুল মওদুদ, মওলানা মুহম্মদ আব্দুর রহীম, হাসান জামান, আবদুল করিম, মুহম্মদ মোহর আলী, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, মুঈন-উদ-দীন আহমদ খান, এবনে গোলাম সামাদ, মওলানা মুহীউদ্দীন খান, খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, মওলানা আবু তাহের মিসবাহ, মওলানা আবদুল মালেক, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ লেখক-চিন্তক-সৃজকেরা প্রান্তিক থেকে গেছেন।
অথচ উত্তর পশ্চিম ভারতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, দেওবন্দ মাদরাসা ও লখনৌর ফিরিঙ্গি মহল ও নদওয়াতুল উলামা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় করে ইসলামিক প্রফেটিক রেভেলেশন ভিত্তিক এপিস্টেমলজি বিকাশ লাভ করেছে। আরবী-ফারসী ভাষার প্রভাবে উর্দু ভাষার উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি সূচিত সংস্কারমূলক চিন্তা ও কর্মকান্ডের ধারাবাহিকতায় সেখানে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও রচনারাশি বিকশিত হয়েছে তা উত্তর ভারতের মুসলিম বিদ্বৎসমাজকে প্রথম থেকেই আধুনিক ইউরোপীয় সেক্যুলার প্যারাডাইমকে মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলেছে। একারণে এই মেট্রিক্সে সৈয়দ আহমদ খান থেকে আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল, শিবলী নুমানী, সুলাইমান নাদভী, আশরাফ আলী থানভী, মওলানা মুহম্মদ আলী জওহর, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা হোসেইন আহমদ মাদানী, মওলানা আবুল আলা মওদূদী, আবুল হাসান আলী নাদভী প্রমুখ যুগোত্তীর্ণ চিন্তক-লেখক-সৃজকের আবির্ভাব ও বিকাশ হয়েছে। এমনকি থিওলজিকালি একটু হেরেটিক্যাল হলেও আহমদ রেজা খান বেরেলভীও এই কালচারাল-এপিস্টেমলজিকাল মেট্রিক্সের ফলাফল।
উত্তর পশ্চিম ভারতের এই বিকাশের উত্তরাধিকার বর্তমান পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মহল ষোল আনাই কাজে লাগাতে পারছে। কাজেই সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানি থেকে মুফতি মুহম্মদ শফি হয়ে আল্লামা তাকি উসমানিদের উদ্ভব ও পাকিস্তানী বিদ্বৎসমাজে তাঁদের ব্যাপক প্রভাব। অন্যদিকে একটু ভিন্ন ঘরানা থেকে ড. ইসরার আহমদ, আল্লামা সৈয়দ তাহিরুল কাদরী এবং জাভিদ আহমদ গামিদীর মত ব্যক্তিত্বও সেখানে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে পারছেন।