আবুল আ’লা মওদূদী এবং আবুল হাসান আলী নাদভী: একটি তুলনামূলক পাঠ- পর্ব ০৬

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১১ ২০২০, ২৩:৫৯

।। মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত ।।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের পাঁচটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়া, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।

এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যেহেতু জাহিলিয়াতের ধারণাটি উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে বলে মনে করি। তাই আজকের পর্বে জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে মওদূদীর ধারণা নিয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ পরিবেশিত হচ্ছে। পরে যখন এই লেখাগুলি বই আকারে সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনটুকু পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত করা হবে, ইনশাআল্লাহ।

৯. পুনশ্চ: উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে

মওদূদী – আমরা জানি ইসলামের ইতিহাস শুরু হবার আগে থেকেই জাহিলিয়াতের ধারণাটি প্রচলিত ছিল। আল্লাহর তাওহিদ ও মৌলিক নির্দেশনাবলী হিশেবে সর্বশেষ অহি নাজিল হবার আগে থেকেই জাহিলিয়াত বলতে ইতিহাসের একটি কালপর্বকে বোঝাত। এই কালপর্বটিকে বলা হত অজ্ঞতা, মূর্তিপূজা এবং অংশীদারিত্বের কাল। অর্থাৎ প্রাক-ইসলাম যুগেই জাহিলিয়াত বলতে যা বোঝাত তা ছিল ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি প্রত্যয়। এভাবে ইতিহাসকে দেখা হত দুটি বিপরীতধর্মী কালের সমাবেশ হিশেবে। ইতিহাসের এই দর্শন কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে যেভাবে মানুষের নাজাতের বয়ান এসেছে এবং প্রসঙ্গক্রমে জাহিলিয়াতের কথা এসেছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। [১] জাহিলিয়াত ও ইসলাম – ইতিহাসের এই দুই পর্বের মধ্যখানে থেকে এই দুই পর্বকে সংযুক্ত করেছে মুহাম্মদ স. এর নববী দাওয়াত বা নবুওয়াত।

ইসলামের ইতিহাসে অবশ্য জাহিলিয়াত কালপর্বটিকে একটি একাট্টা কালপর্ব হিশেবে দেখা হত না। জাহিলিয়াত কালপর্বেরও রয়েছে কয়েকটি বিভাগ বা স্তর। ইতিহাসের এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন যেন কোরআনের অহিতে বিধৃত ইসলামের বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছিল। এই বয়ানে বলা হয়েছিল যে কোরআনের এই অহি পূর্ববর্তী নবী রাসুলদের কাছে নাজিলকৃত অহি সমূহের পুনরাবৃত্তি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের ৩৩ নম্বর সুরা আল-আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে আমরা “প্রথম/প্রাচীন জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আল উলা) শব্দবন্ধটি লক্ষ করি। জাহিলিয়াত পর্বটিকে এভাবে আমরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত দেখতে পাই, যেমন এর প্রথম পর্বটি হল হজরত আদম আ. থেকে হজরত নূহ আ. পর্যন্ত অথবা হজরত নূহ আ. হতে হজরত ইদরিস আ. পর্যন্ত; আর এর দ্বিতীয় পর্বটি হল হজরত ঈসা আ. থেকে হজরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত। [২] কাজেই প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে জাহিলিয়াত শব্দটি প্রচলিত থাকলেও এর সুনির্দিষ্ট অর্থ তৈরি হয়েছে ইসলামের প্রেক্ষিতেই।

জাহিলিয়াত এবং ইসলাম দুটি বিপরীতার্থক বা বিষম শব্দবন্ধ হিশেবে ইতিহাসকে একটি দ্বৈরথ বা সাংঘর্ষিক সম্পর্ক হিশেবে বয়ান করে। এর দ্বারা দুটি পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক কালপর্ব নির্দেশিত হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পরে জাহিলিয়াত যে সম্পূর্ণভাবে বিদূরিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। একারণে আশ’আরী ধর্মতাত্ত্বিক এবং কোরআনের ভাষ্যকার আবদুল্লাহ ইবনে উমার আল বায়যাভি (মৃ. ১২৮৬ খ্রি.) ৩৩ নম্বর সুরা আল-আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় একদিকে যেমন জাহিলিয়াতকে ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্ব হিশেবে দেখেছেন, তেমনি অন্যদিকে “প্রাথমিক জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আল উলা) এবং “আখেরি জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আল আখিরা) এর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। “আখেরি জাহিলিয়াত” বলতে তিনি মুহাম্মদ স. এর নববী দাওয়াতের পরেও যখন সমাজ পুনরায় বিভিন্ন রকমের সাকারবাদে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল সেই অবস্থাকে বুঝিয়েছেন। [৩] বায়যাভি এখানে সুস্পষ্টভাবে জাহিলিয়াত বলতে এমন একটি অবস্থার কথা বলেছেন যেখানে তা ইসলামের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা বা ফুসুককে নির্দেশ করে। [৪] এই মত অনুযায়ী ইসলাম এবং জাহিলিয়াত একই সময়ে বিরাজ করতে পারে কিন্তু এই দুই অবস্থান দুটি ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক স্তরকে নির্দেশ করে; যা আবার ইতিহাসের দুটি ভিন্ন ভিন্ন কালপর্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। [৫]

মুসলিমদের মধ্যে জাহিলিয়াতকে এভাবে একটি নৈতিক অবক্ষয়মূলক অবস্থা হিশেবে দেখাটা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমরা দেখতে পেয়েছি; মূলত একদল রক্ষণশীল ধর্মীয় ভাষ্যকারদের ভূমিকার ফল হিশেবে এটা দেখা গেছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় হাম্বালি আলেম খ্রিস্টীয় তের শতকের ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ১৩২৮ খ্রি.) এবং খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (মৃ. ১৭৯২ খ্রি.)। [৬] এই ধারাটি উনিশ ও বিশ শতক অবধি বহমান ছিল যা মুহাম্মদ আবদুহু (মৃ. ১৯০৫) এবং রশিদ রিদা (মৃ. ১৯৩৫)-এর রচনায় প্রভাব ফেলেছিল। পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের সেক্যুলার প্রবণতাগুলিও এদের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের উপসর্গ হিশেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। [৭] ইতিহাসের এই ধারাবাহিক সালাফি প্রেক্ষাপটেই উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত বিষয়ক নতুন ভাষ্যটিকে দেখতে হবে।

উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা উল্লেখিত ইতিহাসের ধারায় অনুস্যূত থেকেই একটি বিশিষ্ট অবস্থান অর্জন করেছে। তিনি তার পূর্বসূরিদের মত জাহিলিয়াতকে যতটা না একটি ঐতিহাসিক কালপর্ব হিশেবে দেখেছেন তার চাইতে অনেক বেশি একটি মানস-সাংস্কৃতিক অবস্থা হিশেবে দেখেছেন। তিনি ইসলামের স্বীকৃত টেক্সটগুলিকে যেভাবে একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে পুনর্পাঠ করেছিলেন তাতে জাহিলিয়াত সম্পর্কে এই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেনঃ “The meaning of jahiliyya in islam comprises every course of action which runs counter to the Islamic culture, Islamic morals and conduct, or Islamic mentality; and jahiliyyat-i ula means all those evils in which the people of Arabia and every other people the whole was involved in.” [৮]

১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রদত্ত একটি ভাষণে তিনি জাহিলিয়াতের ধারণাটিকে আরো পরিস্কার করেন। তিনি বলেন জাহিলিয়াতের প্রথম অর্থ হল “নির্ভেজাল অজ্ঞতা” (জাহিলিয়াতে খালিসা) – যার বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ নিজের ইন্দ্রিয়ের উপরে নির্ভরশীল হওয়া এবং একমাত্র এর উপরে ভিত্তি করে সকল বিষয়ে মতামত গঠন করা। [৯] জাহিলিয়াতের দ্বিতীয় অর্থটি তিনি করেন এভাবেঃ “[It] is derived from the contemplation over sensations, together with imagination and analogical reasoning.” [১০] জাহিলিয়াতের এই দ্বিতীয় ধরণের অধীনে মওদূদী বহু-ঈশ্বরবাদ, সন্ন্যাসবাদ এবং সর্বেশ্বরবাদ (pantheism — equates all with God) ও ঈশ্বরংশবাদের (panentheism — indicates we are part of God) যাবতীয় প্রবণতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। [১১]

“নির্ভেজাল অজ্ঞতা” হল, মওদূদীর মতে, এমন একটি অবস্থা যেখানে কোন আসমানি দিব্য সার্বভৌমের উপস্থিতি নেই — যিনি জ্ঞান ও পথপ্রদর্শনের উৎস হতে পারেন। এই অবস্থায় মানুষ একটি প্রাণি-প্রজাতির চাইতে আর বেশি কিছু থাকে না; এই মানুষের জন্ম ও অস্তিত্ব কেবলমাত্র আপতিক এবং তা কোন উচ্চতর অর্থ বা তাৎপর্য বহন করে না; এবং এভাবে এই ঘটনাচক্রের আবর্তে যেমন মানুষ জড়িয়ে যায় তেমনি বাকী সমগ্র বিশ্বও একই আপতিকতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু কোনো আসমানি বিধি-বিধানের অস্তিত্ব থাকে না যা মানুষের জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে পারতো, সেহেতু সে নিজেই নিজের স্বয়ম্ভূ প্রভু হয়ে বসে; তার আর অন্য কারো প্রতি দায়-দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা থাকে না। তার কর্মকান্ডের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাড়ায় তার ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা আদায় এবং কেবল নিজের চাহিদা পূরণ। [১২]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

রেফারেন্সঃ
[১] দেখুন আল-কোরআন ৩ (আল-ইমরান): ১৫৪; ৫ (আল-মায়েদা): ৫০; ৩৩ (আল-আহযাব): ৩৩; ৪৮ (আল-ফাতহ): ২৬
[২] Muḥammad ibn Jarir al-Ṭabari (1322/2001). Tafsir al-Ṭabari: jamiʿ al-bayan ʿan taʾʾwil ayat al-qurʾan, al-Turki, ʿAbdallah ibn ʿAbd al-Muḥsin (ed.). 26 vols., Cairo et al.: Dar Hajar., XIX: pp. 97–9; Ignaz Goldziher (1961). Muhammedanische Studien, Hildesheim et al.: Olms (reprint from 1888–90)., p. 220.
[৩]ʿAbdallah ibn ʿUmar al-Bayḍawi (1330h). Anwar al-tanzil wa-asrar al-taʾʾwil, 5 vols., Cairo: Dar al-kutub al-ʿarabiyya al-kubrá., IV: pp. 162f.
[৪] Ibid, IV: p. 163.
[৫] Reinhard Koselleck (1989). Vergangene Zukunft. Zur Semantik geschichtlicher Zeiten, Frankfurt/M.: Suhrkamp, p. 223.
[৬] Ibn Taymiyya (1413/1993), Iqtiḍaʾ al-ṣiraṭ al-mustaqim mukhalifa aṣḥab al-jahim, alḤaristani,ʿIṣam Faris and Muḥammad Ibrahim al-Zaghli (eds), Beirut: Dar al-jil. pp. 79–91 et passim; Esther Peskes (1993). Muḥammad b. ʿAbdalwahhab (1703–92) im Widerstreit. Untersuchungen zur Rekonstruktion der Frühgeschichte der Wahhabiya, Beirut: Steiner), p. 45.
[৭] Muḥammad Rashid Riḍa (1420/1999), Tafsir al-qurʾan alḥakim al-mashhur bi-Tafsiral-manar, Shams al-Din, Ibrahim (ed.). 12 vols., Beirut: Dar al-kutub al-ʿilmiyya., VI: pp. 422f (on 5 [al-Maʾida]: 50)
[৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯-৭২), তাফহিমুল কোরআন, লাহোর: ইদারা ই তরজুমানুল কোরআন, খন্ড ৪, পৃ. ৯১
[৯] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজে মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২২
[১০] প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২-
[১১] Annemarie Schimmel (1975). Mystical Dimensions of Islam, Chapel Hill, NC: Univ. of North Carolina Press, pp. 147f and 274–86.
[১২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজে মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৩