আজ বঙ্গবীর জে. আতাউল গণি ওসমানীর শততম জন্মবার্ষিকী
একুশে জার্নাল
সেপ্টেম্বর ০১ ২০১৮, ১৬:৪১
যুগে যুগে দেশে দেশে জন্ম গ্রহণ করে কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। আবার কিছু ব্যতিক্রমী মানুষও আছেন যারা আজীবন নিঃশব্দে তিল তিল করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। নিজের সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েসের জন্য সামান্য চিন্তাও করেননি তারা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তার জীবন কর্মকালীন সময় এবং চিন্তা ভাবনা দেশ ও জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়ে হয়েছেন এই সর্বত্যাগী মহান বীরপুরুষ। যাঁর নামটি বাদ দিলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস পুরোটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এবং স্বাধীন হওয়ার পর, এমনকি উপমহাদেশ বিভাগের পূর্বেও, রাষ্ট্রের কঠিন দুঃসময়ে মানুষটিকে পেয়েছি দেশের স্বার্থে নিয়োজিত অবস্থায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বিলিয়ে দিয়েছেন এই প্রিয় দেশটিকে, বিয়েও করেননি, রয়েছেন চিরকুমার। আজ এই মহান ব্যাক্তির শততম জন্মদিন। অলঙ্করণ : জারদা
জন্ম:
১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে তাঁর জন্ম। বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান, মা জুবেদা খাতুন। বাবার কর্মস্থল ছিল সুনামগঞ্জ। পৈতৃক নিবাস অবশ্য সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানার দয়ামীরে। ওসমানী ছিলেন দয়ামীরের শাহ্ নিজামুদ্দিন ওসমানীর বংশধর। ধারণা করা হয় যে, হজরত শাহজালাল রহ. যখন সিলেটে আসেন ১৩০৩ সালে, তখন যে ৩৬০জন আউলিয়া তাঁর সাথে এসেছিলেন, তন্মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাহ্ নিজামুদ্দিন ওসমানী।
ওসমানীর পিতা মরহুম খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন উচ্চ শিক্ষিত। তিনি ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও বেঙ্গল -আ্সাম সিভিল সার্ভিসের হতে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের লিষ্টেড পদে উন্নীত হন। ১৯৩১ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট-্এর চাকুরী নিয়ে এক সময় আসামের জেলা প্রশাসক হয়েছিলেন। চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের সময় তিনি ছিলেন আসামের ল্যান্ড রেকর্ডস এর ডাইরেক্টার। সিলেট তখন আসাম প্রদেশ এর অন্তভর্’ক্ত ছিল। ১৯৫৬ সালে ওসমানীর পিতা হজব্র্রত পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে তাঁকে মক্কার আরাফাতের ‘জবলে রহমত’ নামক সুউচ্চ পাহাড়ে কবর দেওয়া হয়।
দুই ভাই আর এক বোনের মাঝে ওসমানী ছিলেন সবার ছোট। বাল্যকালে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘আতা’। ‘বঙ্গবীর’ নামেই অধিক পরিচিত। পাকিস্তান আর্মিতেও কিন্তু তাঁর একটা পরিচিত নাম ছিল; ‘Papa Tiger’।
শিক্ষাজীবন : কোনো স্কুলে ভর্তি না হয়ে, ঘরে বসে বসেই তাঁর বিদুষী মায়ের অনুশাসন এবং যোগ্য গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বাংলা ও ফার্সি ভাষায় ওসমানী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৯ সালে ১১ বছর বয়সে ওসমানীকে আসামের গৌহাটির কটনস স্কুলে ভর্তি করা হয়। কটন স্কুলে পড়াশুনা শেষ করার পর মায়ের ইচ্ছায় ১৯৩২ সালে সিলেট সরকারী পাইলট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। সমগ্র বৃটিশ ভারতে তিনি প্রথম হন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রিটোরিয়া পুরস্কার প্রদান করেছিল। সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির জন্য প্রিটোরিয়া অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ১৯৩৬ সালে আই.এ পাশ করেন। ১৯৩৮ সালে বি.এ পাশ করেন এবং ১৯৩৯ সালে ভূগোলে এম এ প্রথম পর্ব পড়ার সময় বৃটিশ-ভারতীয় সেনা বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৩৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেন তিনি।
ওসমানীর বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট, তাই তিনিও চেয়েছিলেন সেই সময়ের এত সম্মানীত পেশায় পিতার পথেই হাঁটবে পুত্র। কিন্তু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাশ করা ওসমানী সিদ্ধান্ত নিলেন সৈনিকের জীবনকেই বেছে নিবেন তিনি। ধারণা করা হয় যে, সমগ্র জীবনে শুধু মাত্র এই একবারই ওসমানী তাঁর বাবার বিরুদ্ধাচরণ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্য সিলেক্ট হয়েও এই রাজকীয় এক জীবনকে পেছনে ফেলে বেছে নেন একজন সৈনিকের কঠোর জীবন। এই হলেন আমাদের ওসমানী।
ওসমানী যখন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যান, ইন্টারভিউতে একজন বোর্ড মেম্বার প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি মনে করেন, আপনার উচ্চতা একজন সৈনিকের জন্য যথোপযুক্ত? বলাবাহুল্য যে, ওসমানীর উচ্চতা খানিক কমই ছিল, তিনি এই প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, যদি হিটলারের মতো মানুষ এই পুরো পৃথিবী নাড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে আমি কেন পারব না? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নির্ধারণ কমিটির সকলেই ওসমানীর আচরণে অভিভূত হয়ে যায়, সেই বছরেই জুলাই মাসে সিভিল সার্ভিসের যোগদানের সুযোগ বাদ দিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ওসমানী।
কর্মজীবন : ১৯৩৯ সালে তিনি রয়্যাল আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। দেরাদুনে ব্রিটিশ ভারতীয় মিলিটারি একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার হিসেবে। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। তৎকালীন সময়ে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই তিনি এক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মার রণাঙ্গনে স্বতন্ত্র যান্ত্রিক পরিবহনে এক বিশাল বাহিনীর অধিনায়কত্ব দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে ওসমানী তাঁর পিতার ইচ্ছা পূরণে আই.সি.এস পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনে। ১৯৪৭ সালে ৭ অক্টোবর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে পি.এস.সি ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫১ সালে লে. কর্ণেল ওসমানী উদ্যোগী হয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তিই ছিল ওসমানীর গড়া সেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে পূর্ব বাংলায় এসেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রাম সেনানিবাস।
ওসমানীকে ১৯৫৫ সালে ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনা সদর অপারেশন পরিদপ্তরে জেনারেল স্টাফ অফিসার নিয়োগ করা হয়। এখানে তাঁকে ১৯৫৬ সালে ১৬ মে মাসে কর্ণেল পদে পদোন্নতি প্রদান করে ডেপুটি ডাইরেক্টর এর দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। এ-সময় আন্তর্জাতিক সংস্থা সিয়াটো ও সেন্টোতে ওসমানী পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন।। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে ওসমানীর দক্ষতার সংগে ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্ণেল পদে কর্মরত থাকাকালীন ওসমানী একজন স্বাধীন চেতা বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি উন্নীত হন কর্ণেল পদে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সামরিক পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
যুদ্ধকালীন সময় : ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাতেই ছিলেন ওসমানী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বছর চারেক আগে অবসর নেয়া ওসমানীর সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে পারিস্তান সরকার অবগত ছিল। তাই ঐ রাতেই ওসমানীকে হত্যার চেষ্টায় হন্যে হয়ে খোঁজে পাকবাহিনীর এক কমান্ডো। কিন্তু একেবারেই ভাগ্যগুণে অনেকটা অলৌকিকভাবে প্রাণ বেঁচে যায় ওসমানীর। এত পরিচিত চেহারা নিয়ে তিনি নিরাপদে পালিয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে মনজুর আহমদ নামক এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকারে এই ব্যাপারে তিনিই খোলাসা করেন, বলেন যে, হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিখ্যাত গোঁফ জোড়াটি কামিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকা থেকে তিনি পালিয়েছিলেন ২৯শে মার্চ। এর আগের চারদিন ঢাকার ইস্কাটনের একটি ফাঁকা বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। সেনারা তাঁকে খ্যাপা কুকুরের মতো খুঁজছিল। তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে চালিয়েছিল হামলা। প্রতিটি ফাঁকা ঘরেই মেশিনগান চালিয়েছে। নিউ ইস্কাটনের বেশ কয়েকটি বাড়িতেও তারা হামলা চালিয়েছিল, কিন্তু ওসমানী যে বাড়িতে ছিলেন, সেটায় হানা দেয়নি। এ ব্যাপারে ওসমানী উল্লেখ করেন, পরম করুণাময়ের অশেষ অনুগ্রহ ছিল তাঁর ওপর। তা না হলে এমনভাবে কজন রক্ষা পায়! ২৯শে মার্চ, নদীপথে পালিয়ে গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধরত ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেন তিনি। শুরু হয় ওসমানীর জীবনের নতুন এক অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পাক-ভারত যুদ্ধের পর এবার শুরু হয় নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধ; যা ছিল স্বজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। নিজের সবটুকুই বিলিয়ে দেন তিনি এই যুদ্ধে।
যুদ্ধোত্তর পর্যায় : ১৯৭১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ওসমানী তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন দু’ভাবে। আপামর জনসাধারণের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, আর ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল, ওসমানীকে চার তারকাযুক্ত জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। একই সাথে জেনারেল পদটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার জেনারেল পদ বিলুপ্ত করে – সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনীকে পৃথক করে দেয়। তিন বাহিনীরই পৃথক পৃথক প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
রাজনীতি : সামরিক বাহিনী থেকে ওসমানী অবসর গ্রহণের পর ১৯৭০ সালেতিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। গড়পরতা মানুষের মতো স্ত্রী সন্তান নিয়ে সৌখিন অবসর জীবন তিনি পাননি। কারণ যুদ্ধ বিগ্রহ আর পেশাগত জীবনে নিজেকে এমনভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিয়ে করার সময় হয়ে ওঠেনি তাঁর। তিনি ভাবতেন, একজন সৈনিককে সৌখিন জীবন মানায় না। রাজনীতিতে নেমেই পেলেন ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনকারী ১৯৭০ এর নির্বাচন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের চারটি থানা নিয়ে গঠিত উভয় পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ নির্বাচনী এলাকা থেকে জয় লাভ করে তিনি জাতীয় সংসদে আসন লাভ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানের নাগরিক। অতঃপর ১৯৭১ সালে নিজের নেতৃত্বে সব শত্রু বিতাড়িত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন। জীবনের পাঁচ দশক অতিক্রম করা এই বঙ্গবীর কখনোই ভাবেননি যে, স্বাধীন দেশে তাঁর দায়িত্ব শেষ হতে চলেছে। সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না, কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাঁর অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে, এমনটাই ভাবতেন তিনি।
১৯৭৩ সালে, স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়ে “ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়-এর দায়িত্ব নেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে তিনি যুগপৎ সংসদ সদস্য পদ এবং আওয়ামী লীগ সদস্য পদ ত্যাগ করেন। সে বছরই ২৯শে আগস্ট রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁকে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। কিন্তু ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের অব্যবহিত পরেই তিনি পদত্যাগ করেন।
১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী জাতীয় জনতা পার্টি নামে নতুন এক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সনের ২৫ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে একদলীয় শাসন ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠাকালীন ওসমানী তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং বিফল হয়ে সংসদ সদস্য পদ, মন্ত্রীত্ব এবং আওয়ামীলীগ হতে পদত্যাগ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর স্বপ্ন সংসদীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় জনতা পাটি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বিস্তারিতভাবে তিনি গণনীতির রূপ রেখা নামে প্রণীত বইতে লিখেছেন।
সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গণ, দুর্নীীতমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই । গণতন্ত্রের বিকল্প হচ্ছে সেনা শাসক। উর্দিপরা সেনা শাসকরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র ধ্বংশ করেছে। বাংলাদেশেও যেন এর উদ্ভব না হয়-বলেছেন ওসমানী। একজন সেনা শাসক হয়েও গণতন্ত্রের প্রতি তার এমন অবিচল আস্তা গোটা জাতিকে একটি সুনিদিষ্ট লক্ষ্য ও আর্থসামাজিক নীতির ভিত্তিতে সুসংহত করে নতুন দল গঠন করে হতাশামুক্ত করার জন্য গণতন্ত্রের প্রতি তার আকৃষ্ঠ করেছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এবং অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে। ইহা ওসমানীরই অবদান। নির্বাচনে হেরে গেলেও এটি তার রাজনৈতিক বিজয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যে চার ধরণের সম্মাননা প্রদান করা হয়েছিল যোদ্ধাদের, তার প্রাথমিক তালিকা ওসমানী নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ আনা হয় যে, ওসমানী পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে এই তালিকাটি তৈরি করেছেন। ওই সময়ে তালিকা বাতিল ঘোষণা করা হলেও, পরবর্তীতে এই তালিকা অনুযায়ী বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বীক্রম আর বীর প্রতীক সম্মান ধারীদের নাম ঘোষিত হয়।
ওসমানী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা : ১৯৭৬ সালের ১৮ই মে এ বাড়ির ২ বিঘা জায়গা দিয়ে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের নামে গঠন করেন জুবেদা খাতুন-খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডির রোড-১০-এ, বাড়ি নং ৪২-এর সুন্দরবন নামক ওসমানীর নিজস্ব বাড়ির সম্পত্তি দিয়ে আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে গঠন করা হয় ওসমানী ট্রাস্ট।
এরশাদ সরকার ১৯৮৭ সালে সিলেটে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই লক্ষ্যে, জুবেদা খাতুন-খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্টের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য ধোপাদীঘির পাড়ের বাড়িটি লীজ নেয় সরকার। ১৯৮৭ সালে ৪ মার্চ এ বাড়িতে ওসমানী জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেই থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এটি।
তাঁর স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ওসমানী উদ্যান ও স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মেমোরিয়াল হল। সরকারী উদ্যোগে সিলেট শহরে তাঁর নামে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ওসমানী নগর থানার দয়ামীরে ওসমানী স্মৃতি যাদুঘর ও গ্রন্থাগার। বালাগঞ্জ উপজেলাকে ভেঙ্গে যে থানা ঘোষণা করা হয় তাঁরই নামে “ওসমানী নগর থানা”। নামকরণ করা হয়েছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। সিলেটে বঙ্গবীর রোডসহ অসংখ্য স্বীকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।
ইন্তেকাল : ১৯৮৩ সালে ৬৫ বছর বয়সে ওসমানীর ক্যান্সার ধরা পড়লে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হলে ১৯৮৪ সালে তাঁকে লন্ডনের সেইন্ট বার্থোলোমিও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনে অধিকাংশ সময়ই তিনি তার ভাতিজা-ভাতিজীদের সাথে কাটিয়েছেন। ১৬ই ফেব্রুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃতদেহ দেশে নিয়ে এসে সম্পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটের দরগাহতে তাঁর মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়, এই ছিল তাঁর অন্তিম ইচ্ছা।