আইয়ুবি প্রশাসন বনাম করোনা প্রশাসন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ১৯ ২০২০, ১৪:০১

নিজস্ব প্রতিবেদক;

বৃটিশ উপনিবেশ ভুক্ত উপমহাদেশের বাসিন্দারা বৃটিশের দুই শতকের জুলুম শোষণ ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কালো অধ্যায় পেরিয়ে স্বজাতির দ্বারে আশ্রয় পেয়ে হাপ ছেড়েছিল।জাতি তত্ত্বে দিখন্ডিত হয়েছিল উপমহাদেশ। হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে গড়ে উঠেছিল ভিন্ন দুটি রাষ্ট্রযন্ত্র। “মা হারা দুগ্ধপোষ্য শিশুর কান্না থামাতে বাবার নতুন বিয়ে, সেই মা জননী দেখা দিলো নাগিন ফনা নিয়ে” এমনি অনেকটা পশ্চিম পাকিস্তান সৎমায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের মতো দুধের শিশুর কান্না থামাতে। যার তিক্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি আজো জাতি বহন করে চলছেই না শুধু বরং ঝুলি বড় হয়েই চলছে। উপর ওয়ালাই ভালো জানেন কত শত মাসে তার গর্ভপাত ঘটবে

যে জাতি ৪৭,৫২, ৬৯ ও ৭১ এর মতো শীশা ঢালা প্রাচীর ডিঙিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে দন্ডায়মান, সে জাতি আর কবে চেতনার আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট হাতে পাবে?

উপমা স্বরূপ গ্রাম্য লোকের কথ্য গল্প বলতে হয় “আমার ভাবী কাইল রাইতে ডেলিভারিতে মইরা গেছে, আহারে! আমার দাদায়ও একি রোগেই (ডাইরিয়া) মরছে কী যে কষ্ট করছে গো…” আমরা ডাইরিয়া ও ডেলিভারির ব্যবধান না করতে পারা জাতি। তাই ঘূরে ফিরে আমাদের ঘারে একই ভুত সওয়ার হয় বারবার। গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আমলাতন্ত্র শুধু তন্ত্র মন্ত্রই আমাদের ঘারে চেপে বসে।এ যেন পুরান বউয়ের নতুন লাল বেনারসী। অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের পন্য কখনো মেয়াদ হারায় না। পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে শুধু নবায়নের সিলছাপ্পর লাগালেই মামলা খালাছ। মেয়াদ লিখা থাকে মোড়কের গায়ে,তাই মোড়ক পাল্টালেই কিচ্ছা খতম।

তাই ঘুরে ফিরে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের ধারায় উপনিত হচ্ছি। বারবার হোঁচট খাচ্ছে গণতন্ত্র। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় থাকছে পার্লামেন্ট।কার্যত জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে জনপ্রতিনিধি।করোনায় দেশ চলছে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। রাষ্ট্র প্রধান বারবার আগ্রহ হারাচ্ছেন কেন্দ্র থেকে নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের প্রতি। এটা কিসের আভাস? জনমনে প্রশ্নটা থেকেই যায়……

আকবর আলী খানের গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলা ইনসাইডার গত ২২ এপ্রিল একটা লেখা প্রকাশ করেছিল। যার শিরোনাম ছিল ‘আমলাদের ‘পাছায় লাথি’ ফর্মুলায় দুঃস্থ তালিকা’। এটা ছিল আইয়ুব আমলের ঘটনা। অথচ এখনকার দিনে ঠিক একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, কর্মহীন ৫০ লাখ মানুষের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে। আমলাতন্ত্র যে বদলায়নি এবং আমলাতন্ত্র যে ওই একই কায়দায় কাজ করে, তার বড় প্রমাণ হলো এটি।

৫০ লাখ কর্মহীন মানুষের তালিকা নিয়ে যে এখন তোলপাড় চলছে, দেখা যাচ্ছে, তালিকায় মৃত ব্যক্তি আছে। ভুয়া নাম আছে। এই তালিকা কীভাবে তৈরি করা হয়েছে। আসুন সেটাই দেখে নেওয়া যাক-

২৮ এপ্রিল জেলা প্রশাসকদের কাছে একটি চিঠি যায় যে, এখানে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকের নামের তালিকা, যারা কর্মহীন তাদের নাম পাঠাতে হবে। তালিকা পাঠানোর সময় দেওয়া হয় ৩ মে’র মধ্যে।

৩০ এপ্রিল একটি নতুন মেইল পাঠানো হয় ঢাকা থেকে, যেখানে ১৬টি ক্রাইটেরিয়া দেয়া হয়। নাম, বাবার নাম, ভোটার আইডি কার্ডের নম্বরসহ ১৬টি কলাম পূর্ণ করে ৩ মে’র মধ্যে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয় জেলা প্রশাসকদের।

জেলা প্রশাসক ওই তালিকা পেয়ে ইউএনও’দের কাছে দেন পয়লা মে। তাদেরকে বলেন যে, ২ মে’র মধ্যে এই তালিকা তাদেরকে জেলা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছাতে হবে।

ইউএনও অগত্যা কী করবেন, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ডাকেন এবং সেই ‘পাছায় লাথি’ ফর্মুলা দিয়েই বলেন, যেকোনো মূল্যে আগামী কালের মধ্যে আমার তালিকা চাইই চাই। যদি না পাই, তাহলে আপনাদের পদ হারাবেন।

বেচারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আর কী করবেন, তাদের স্টকে যে ভোটার আইডি কার্ড ছিল, তা থেকে তারা ওই ১৬ টি বৈশিষ্ট্যযুক্ত ফরম ফিল আপ করে নামের তালিকা ২ তারিখের মধ্যে ইউএনও এর কাছে জমা দেন।

ইউএনও ওই তালিকার ভেতরে কাজ করে ৩ মে এই তালিকাগুলো পাঠিয়ে দেন জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক এগুলো আর কিছু না করেই পাঠিয়ে দেন দুর্যোগ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় এই তালিকা পেয়ে আর কিছু করেনি। এই তালিকাটিই ১১ মে প্রণয়ন করেন এবং এই তালিকাটিকে তারা কর্মহীন মানুষের তালিকা হিসেবে চালিয়ে দেন এবং এই তালিকার ভিত্তিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কর্মহীন মানুষের জন্য মাথাপিছু ২৫০০ টাকা প্রদানের কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

পাঠক লক্ষ্য করুন আকবর আলি খান তার গল্পে যেভাবে বলেছিলেন, এখনকার আমলারা সেই একই পদ্ধতিতে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই, যাকে যেভাবে পেরেছে, রাতের অন্ধকারে কোনরকমে তালিকা করে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে কর্মহীন মানুষ, তেমনি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষও রয়েছে। সেইসাথে আপনারা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন এই তালিকায় মৃতদের নামও বাদ পড়েনি। বেচারা মরেও প্রধানমন্ত্রীর উপহার সদকায়ে জারিয়া স্বরূপ কবরে পেয়ে থাকবেন হয়তো। শতাধিক নামের সাথে একই মোবাইল নাম্বার দেয়ার বিষয়ে নাই বললাম। যার কারণে ইতিমধ্যে আট লক্ষ নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ার খবরও আপনারা জেনে থাকবেন। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের হাতের কাছে যে কয়টি ভোটার আইডি কার্ড পেয়েছেন, তা দিয়ে তালিকা সাজিয়েছেন। আর এই তালিকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত যে মহৎ উদ্যোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়েছিলেন, সেই উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।