অমরাবতী ~ বনশ্রী বড়ুয়া
একুশে জার্নাল ডটকম
মে ২৬ ২০১৯, ১৩:১০
কতবছর হয়ে গেল তোমাকে দেখি না,সেই মুখ!!সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখ,স্বর্গের আভা যেন,,,,,যেন দেবী,প্রতিমা।আজ পঁচিশ বছর তেইশ দিন হয়ে গেল তুমি চলে গেছ।শুনেছি এক্সিডেন্টে তোমার মুখ থেঁতলে গিয়েছিল পুরাটায়।মুখের অবয়ব দেখে চেনার উপায়ও নাকি ছিল না।
না,সেদিন আমি তোমাকে দেখতে যাইনি।তোমার ওই রক্তাম্বর মুখ দেখার ইচ্ছে হয়নি আমার।যাকে হৃদয় নিঃশেষ করে ভালবেসেছি,যার প্রতিমার মত মুখ আমি অপলক চেয়ে থেকেছি,যার গোলাপি রংয়ের ঠোঁট জ্বরে পুড়েছে অসংখ্যবার আমার ভালবাসার ঝড়ে সেই তোমাকে আমি কি করে দেখি একদলা মাংসপিন্ডে,,,রক্তের ভাসাভাসিতে,,?মাদুরে মোড়ানো সেই তুমি কত অচেনা,,,
আমাদের ভালবাসা জাত পাত এসব মেনে হয়নি।আমরা ভালবেসেছি জাতের উর্ধ্বে গিয়ে। তুমি বরাবরেই একটু বেশীই সাহসী, নির্ভীক ছিলে,,তোমার নির্ভীকতায় মুগ্ধ হতাম আমি।আমার মত নিচু জাতের মানুষকে সমাজ মেনে নিবে না জেনেও ভালবেসেছ তুমি,,,
অবশ্য শেষতক আমাদের ভালবাসা সংসারের সুখ ছুঁয়ে দেখতে পারেনি,জড়াজড়ি করে জীবন কাটানো হয়নি আমাদের,,,
বিধাতার কী নিঠুর খেলা!! তিনি ধরাধাম থেকে দেবীকে নিয়ে চলে গেলেন,,,,আর আমি পড়ে রইলাম একা,,,।
জানো আজ পঁচিশ বছর এই শ্মশানে পড়ে আছি।সবাই আমাকে চন্ডাল নামে ডাকে।এই শহরের সমস্ত মৃতদেহ সৎকার করি।রোজ রোজ কত মৃতদেহ আসে,,,কারো মুখ বাঁকা,কারো চোখ বেড়িয়ে আসছে যেন গিলে খাবে আমায়। আবার কারো রক্তে মাখা শরীর,,কারো কারো শুধু মাংসপিন্ড।আমার এসবে কোন ভাবাবেগ হয় না,,মাংস পোড়া গন্ধে যখন আকাশ পাতাল ভারী হয়ে আসে তখনো আমার ইন্দ্রিয়রা সাড়া দেয় না,,,আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি,,, পুড়ে ছাই হয়ে যায় জাত পাত,,,হায় জাত!!
চারদেয়ালের ঘরটাতে কখনো ফিরি কখনোবা না,,ফিরলেও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি,,কিছুই মনে থাকে না, দিব্যি ভুলে গেছি তোমাকে,,,ভুলে গেছি তোমার গায়ের গন্ধ,,,
আচ্ছা কেমন ছিল সেই গন্ধ?পোঁড়া লাশের সেই বিদঘুটে,, উৎকট গন্ধটার মত!!নাকি শিউলির মত পাগলপারা,, ভুলে গেছি সব,,,
ভুলে গেছি তোমার ঠোঁটের স্বাদ,,,
আচ্ছা সেটা কি এলকোহলের বোতলের ঘোলাটে পানির নোনতা স্বাদের মত?কি জানি,,,আমি ভুলে গেছি, সব ভুলে গেছি,,,
ভুলে গেছি অতীত,,বর্তমান,,ভবিষ্যৎ,,
জানো, আজ এলকোহলের বোতলটা সামনে পড়ে আছে,ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে না। বহুদিনের নিয়মকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সন্ধে না হতেই ফিরে এসেছি ঘরে।সেই ভোর থেকে এগারোটা মৃতদেহ পোড়ালাম রোজকার মত।দুপুরের দিকে পুলিশ ভ্যানে করে আরেকটা মৃতদেহ এল শ্মশানঘাটে,,খুব তাড়াহুড়ো করছিল ওরা।ডাক পড়ল আমার,,,গেলাম।মৃতদেহটাকে খুব দ্রুত পুড়িয়ে ফেলতে হবে তাই তাড়াহুড়া করেই লাশের মুখ খুললাম,,,,হঠাৎ করেই কোন দিন ভাবান্তর না হওয়া এই আমি, আমার সকল বোবা ইন্দ্রিয় সচল হতে শুরু করল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।একি দেখলাম আমি!!এ কার মুখ!!সেই পঁচিশ বছর আগে দেখা স্মৃতিতে অস্পষ্ট ওই মুখটা মুহুর্তেই সামনে এসে গেল।কে এই মেয়ে??হতবিহব্বল হয়ে পরিচয় জানতে চাইলাম।কেউ কিছু বলতে পারল না,,রেজিস্টার খুলে দেখলাম,তাতে লেখা “বেওয়ারিশ “।পুলিশ বলল,নদীতে ভেসে এসেছে,,,হয়ত দুরের কোন গাঁ থেকে,,
জানো,অনেকক্ষণ বসেছিলাম মেয়েটার পাশে,,,সেই মুখ,,সেই মায়াবী চেহারা,,,সেই গোলাপি ঠোঁট,,, সব কি করে এক রকম হয় আমি জানি না,,,
বিধাতার এ কেমন খেলা?
পুলিশকে বললাম, কিছুটা সময় লাগবে।তারপর খুব যত্ন করে পারুল মাসীকে স্নান করাতে বললাম।স্নান শেষে শাখা-পলা আর সিঁদুরে খুব করে সাজালাম মেয়েটাকে।
কি অপরুপ লাগছিল,,,যেন সেই দেবী,,,যাকে দেখা হয়নি বহুবছর।আমার রোজকার এলকোহলের নেশাকে ছাড়িয়ে আজ নেশা কেমন বেড়েই চলছে,,আমি নেশাতুর হয়ে যাচ্ছিলাম।
চারপাশটায় অদ্ভুত শিউলির গন্ধ,, পঁচিশ বছর পোড়া গন্ধে আমি শিউলির গন্ধ খুঁজেছিলাম।মেয়েটার দেহ যখন একটু একটু করে পুড়ে ছাই হচ্ছিল তখনই কী ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আমার,,
কাঁদলাম অঝোর ধারায়।জমে থাকা মেঘপুঞ্জ আজ বারি ধারায় ভাসিয়ে শান্ত করে দিল আমায়।এ জীবনের সমস্ত কান্না বিসর্জনের দিন আজ,,,এ যেন দেবী বিসর্জন,,,
খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।অনেকগুলো বছর পর এই নির্ঘুম চোখ আজ শান্তিতে ঘুমাবে।তোমাকে জড়িয়ে স্বপ্নের ভিতর এক স্বর্গপুরী বানাবো।এক শ্মশানচারী চন্ডালের সাথে স্বর্গের প্রতিমার দেখা হবে দীর্ঘ পঁচিশ বছর তেইশদিন পর।আবার তোমাতে ডুব দেব আমি ভালবাসায়। চন্ডাল!



