অধুনা চ্যালেঞ্জ মুকাবেলায় প্রয়োজন ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়সাধন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ২৪ ২০১৯, ০৬:১৭

সাঈদ আল মাহদী: সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. জাগতিক শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে শুধু ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে যে কওমী সিলেবাস প্রণয়ন করেন তা ছিল সেই সময়ের জন্য সময়োপযোগী, সঠিক ও মকবুল সিদ্ধান্ত। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, কৃষ্টি-কালচার ও চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা নতুনত্ব ও ভিন্ন প্রয়োজনীয়তার আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। কুফুরী শক্তি নতুন রূপ ও কৌশলে আত্মপ্রকাশ করেছে। সাম্রাজ্যবাদীরা শারীরিক গোলাম বানানোর পরিবর্তে মানসিক গোলাম বানানোর প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। অধুনা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দাবি অনুসারে মাকসাদ ও মানহাজ ঠিক রেখে শিক্ষা ও দাওয়াতের পথ ও পন্থার মধ্যে নতুনত্ব আনা জরুরি হয়ে পড়েছে, ঠিক যেমনটি হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. এনেছিলেন সেই সময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।

সেই সময়টি ছিল ইংরেজদের শাসনামল ৷ তখন দুনিয়াবি শিক্ষার পরিবর্তে ঈমান আমল হেফাজত করে দেশকে ইংরেজ মুক্ত করাই মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ঈমান আমল হেফাজত করার সাথে সাথে মুসলিম ভূখন্ডের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-কানুন ইসলামী করণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তার জন্য প্রয়োজন ইসলামী চিন্তা-চেতনাপূর্ণ অনুসরণযোগ্য মানুষ তৈরী করা। ইংরেজদের সাথে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায়, বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে অগ্রসর ও ইংরেজদের রেখে যাওয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-কানুন, ধ্যান-ধারণার মোকাবেলায় ময়দানে নতুন কর্ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করার আবেদন এসে হাজির হয়।

ইসলাম একটি জীবন বিধান ৷ মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের যত প্রয়োজনীয়তা আছে সব কিছুর দিকনির্দেশনা ইসলামে রয়েছে। তাই যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত কথা হলো, মানুষের বৈধ জীবন ধারণের জন্য যা যা জরুরী সেসব শিক্ষা করাও ইসলাম জরুরী মনে করে।

ইসলাম যেমন ব্যাপক, তার শিক্ষাও ব্যাপক। এখানে ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মের রয়েছে অনেক ব্যবধান। অন্যান্য ধর্ম শুধু ধর্মীয় কিছু আচার-অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ । কিন্তু ইসলাম দিয়েছে পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।ইহকাল ও পরকালীন জীবনের সফলতার পূর্ণ রূপরেখা।

দ্বীনি ও দুনিয়াবি শিক্ষার সমন্বয়ের নাম হলো ইসলামি শিক্ষা। জাগতিক শিক্ষা বাদ দিয়ে শুধু দ্বীনি শিক্ষা যেমন পূর্ণাঙ্গ হয় না, তেমনি এটি পরিহার করে সুষ্ঠু-সুন্দর কল্যাণময় ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। অপর দিকে ঈমান ও আমল, কুরআন ও সুন্নাহ তথা দ্বীনি শিক্ষা পরিহার করে ভোগবাদী শিক্ষার মাধ্যমেও সফলতা লাভ করা যাবে না।

রূহ ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে মানুষ গঠিত হয়। হাত-পা, নাক, চোখ শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রূহ না থাকলে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন মূল্য নেই। মানুষের দেহ থেকে রূহ বাহির হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব কবর দেওয়া হয়। অন্যথায় গলিত দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়ে পরিবেশ দূষণ হয়, যা মানব জীবনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তেমনই মানব শরীরের রূহ আছে ঠিকই কিন্তু হাত, পা, চোখ বা অন্য কোন অঙ্গ যদি না থাকে তখন তাকে বলা হয় বিকলাঙ্গ।মানুষের কাতারে তাকে শামিল করা হয় ঠিকই কিন্তু অপূর্ণাঙ্গ মানবরূপে।

কর্মহীন ধর্ম শিক্ষাব্যবস্থা তথা প্রচলিত দ্বীনি বা মাদরাসা শিক্ষা হলো মানুষের দেহের রূহের মত। রূহ না থাকিলে যেমন মানুষের দেহের কোন মূল্য নেই, তেমনই কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা না থাকলে তাওহীদবাদীদের জন্য ভোগবাদি শিক্ষায় দুনিয়া ও আখেরাতে কোন উপকার নেই। তাকওয়াবিহীন শিক্ষা দুর্নীতিবাজ, হিংসুক, অপরাধপ্রবণ করে তুলে, মানব সভ্যতাকে অবুঝ শিশু বানিয়ে তুলে, ভালো মন্দ বুঝার অযোগ্য করে ফেলে। যার ফলে তাওহীদের জায়গাতে জাহালাত প্রবেশ করে, ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের জায়গাতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, কল্যাণকামিতার জায়গাতে শত্রুতা প্রবেশ করে।

জাগতিক শিক্ষা হলো দেহের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গের মতো। মানব শরীর পূর্ণাঙ্গ হতে যেমন রূহ ও অঙ্গের সমন্বয় হওয়া প্রয়োজন তেমনি মানব জাতিকে পরিচালনা ও পূর্ণ সফলতা এনে দেওয়ার জন্য ইসলামি শিক্ষা প্রয়োজন। আর ইসলামী শিক্ষা পূর্ণ হতে হলে দ্বীনি ও দুনিয়াবি শিক্ষার সমন্বয় প্রয়োজন। আজ ইসলামী শিক্ষা অঙ্গহানির ব্যাথায় ভুগছে। তার কুফল ও অভিশাপ আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

ইংরেজরা দুনিয়াবি শিক্ষার মাঝে ভাইরাস যুক্ত করে পচন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. মানব দেহের ঐ রূহকে বাঁচাতে গিয়ে পচনশীল অঙ্গকে কেটে দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, ঐ পচনশীল অঙ্গকে সুস্থ করে গড়ে তোলার জন্য বাস্তবিক কর্ম-কৌশল নির্ধারন করা। নিজেদের কর্ম পরিধি বিস্তৃত করা।

ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই উভয় শিক্ষা একত্রে ছিল, দ্বীনি শিক্ষা বা দুনিয়াবি শিক্ষা বলে কিছু ছিল না। যে বিদ্যাপীঠ থেকে মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, ফুকাহা আর ইমামগণ বের হতেন, সেখান থেকেই সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিকিৎসক, ইতিহাসবিদ,গণিতবিদ, রসায়নবিদ, সেনাপ্রধান, রাজনীতিবিদসহ অন্যরা বের হতেন। খোদ কাসেম নানুতবী রহ. ছিলেন একজন জ্ঞানসাধক, একজন দক্ষ পরিচালক ও সংগঠক, একজন সমাজ-সংস্কারক, একজন প্রাজ্ঞ লেখক, দার্শনিক, গণিতবিদ; আবার সম্মুখ সমরের একজন সাহসী সিপাহসালার।

স্বাধীনতার পর আমাদের উচিৎ ছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, উভয় শিক্ষার সমন্বয় করা। যার মাধ্যমে ঈমান-আমল ঠিক রেখে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করবে। হারিয়ে যাওয়া সেই মুসলিম সোনালি যুগের ইতিহাস পূরুদ্ধার করবে। জ্ঞান সাধনা শুরু করবে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার “ইকরা” শব্দের নির্দেশ পালনার্থে। যেমনটি ছিল পূর্বের মুসলিম শাসনামলে।

কিন্তু আমরা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে চিন্তার মাঝে পরিবর্তন আনিনি। যুগের আবেদনে সাড়া দিয়ে কর্মের ময়দানে হাজির হইনি।ইজতিহাদ ও গবেষণায় অগ্রগামী হয়নি। আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা মৌলিকশিক্ষা পরিহার করে রূহ শূণ্য হয়ে পড়ে। নাস্তিক্যবাদী ও সেক্যুলারদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেটিকে আধুনিক শিক্ষা বলে ইসলামকে প্রতিপক্ষ ও সেকেলে বানিয়ে দেয়। ইসলামের উপর অযৌক্তিক আপত্তি তুলে।প্রেম-প্রীতি, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতাসহ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে আধুনিক ও অনুসৃত মডেল হিসেবে পেশ করে।এর বিপরীতে ধার্মিকতা, শালীনতা, হিজাব-বোরকা পরিধান, দাঁড়ি রাখা ইত্যাদিকে সেকেলে, বর্বর, জঙ্গি, আনকালচারাল হিসেবে পেশ করা হয়। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে যেসব ছেলে-মেয়েরা ধর্ম-কর্ম পালন করে তাদেরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা ও হেয় প্রতিপন্ন করা হয়ে থাকে। কিয়ামত, হাশর, নশর, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়ে এমন এমন ব্যাখ্যা শিক্ষা দেওয়া হয় যা সরাসরি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-‘র এর আনীত শরীয়তের পরিপন্থী ও বিকৃতির শামিল। এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম সন্তানরা ইসলামী চেতনা পরিহার করে অর্থলোভী, সেক্যুলার, নাস্তিক, সংশয়বাদী, বামপন্থি, ইসলাম বিদ্বেষী ও প্রবৃত্তিপূজারী হয়ে ওঠে।এসব ছাড়াও বিভিন্ন বাতিল ফিরকা শিয়া, হিযবুত তাওহীদ, রাজারবাগী, দেওয়ানবাগীর মত ভ্রান্তপীর, কাদিয়ানীসহ অগণিত ফিতনার দাওয়াত প্রকাশ্যে ও গোপনে পরিচালিত হয়। সাম্রাজ্যবাদীদের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের কবলে পরে মুসলিম সন্তান বিকৃত ইতিহাস পড়ে ইসলামি চেতনা শূণ্য হয়ে পরে।ধর্মহীন শিক্ষা পড়ে সেক্যুলার ও নাস্তিক হয়ে উঠে। অনৈতিক শিক্ষা পড়ে নীতিবোধ নষ্ট করে পেলে।চেতনা,ধর্ম ও নৈতিকতা শূণ্য হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের গোলামে পরিণত হয়। এদের দুনিয়া ও আখেরাত যেমন নিরাপদ নয়, তেমনই এদের হাতে দেশ ও দশ নিরাপদ নয়।পচনশীল অঙ্গের ভাইরাসে মানব সভ্যতা ধ্বংসের প্রান্তরে পৌছে গিয়েছে।

আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ তারা বিনা বাঁধায় পরিচালনা করছে। আমাদের প্রয়োজন অগ্রসর হয়ে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করা। পচনশীল অঙ্গকে সুস্থ করে গড়ে তোলা। নতুবা পচনশীল অঙ্গের যন্ত্রণায় মানব দেহ থেকে রূহ বের হয়ে যাবে। তেমনই ধর্মহীন কর্ম শিক্ষার কুপ্রভাব কর্মহীন ধর্ম শিক্ষার উপর পড়বে। এজন্যই কালজয়ী ব্যক্তিত্ব আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-‘র উক্তি- “কর্মহীন ধর্ম শিক্ষা ও ধর্মহীন কর্ম শিক্ষা জাতির জন্য অভিশাপ”। উভয় শিক্ষার সমন্বয় হলো জাতির জন্য রহমত ৷