জাতীয় সংগীত কেন তুলনারহিত সংগীত? 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০৮ ২০১৯, ১৭:৫৩

রিদওয়ান হাসান

লেখাটি শুরু করতে চাই একটা প্রশ্ন দিয়ে, আমাদের জাতীয় সংগীতে কি প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনো দেশঘৃণাত্মক উপাদান আছে?

যদি নাই থাকে, তাহলে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ একটি দেশের অংশ এবং ‘বাঙালী জাতি’র অস্তিত্বের একটি অংশ মানতে অসুবিধা কোথায়? খোদ প্রিন্স মাহমুদও ফেসবুকওয়ালে লিখেছেন, জাতীয় সংগীত আমাদের অস্তিত্ব।

যদিও জাতীয় সংগীতে ‘বাংলাদেশ’ এর স্পেসেফিকলি নামটি নেই। আর প্রিন্স মাহমুদ রচিত ‘বাংলাদেশ’ গানটির টাইটেল ন্যামই বাংলাদেশ। তাই বলে জাতীয় সংগীতের চেয়ে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে এই বাংলাদেশ গানটি, একথা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কি?

আপনি বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত এবং তার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ মূলত পুরো বেঙ্গল প্রদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে; বাংলাদেশকে নয়।

তাহলে ভুলে গেলে চলবে না, জেমসের বাংলাদেশ গানটির লিডলিরিক্সও কিন্তু ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তারপরে বাংলাদেশের কিছু মহামনীষীদের গুণকীর্তন ছাড়া আর কিছু নেই। এ গানটি বাংলাদেশের নির্দিষ্ট একটা ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটকে শাইন করে; কিন্তু গোটা বাংলাদেশের আবহমান চিত্রকে তুলে ধরতে অক্ষম। পক্ষান্তরে বরীন্দ্রনাথের জাতীয় সংগীত গোটা বাঙালী জাতিকে তুলে ধরলেও সেখানে সিংহভাগ বাংলাদেশের আবহমান চিত্র উঠে আসে।

তাছাড়া যখন বিশ্বব্যাপী ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজে, সবার মনে তখন বাংলাদেশের নামটি উঁকি দিয়ে যায়। গানটির শব্দও উচ্চারণ হবার প্রয়োজন হয় না, স্রেফ সুরের লহরীতেই বাংলাদেশের পরিচয় পাওয়া যায়।

বলা যায় এটি বাংলাভাষারই শক্তি। ভারতের জাতীয় সংগীতও বাংলাভাষায় রচিত। ভারতীয়রা তা সংস্কৃত ভাষায় উচ্চারণ করেন। রবীন্দ্রনাথের গান ও সুর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই ছাত্র আনন্দ সামাকুরনের ‘নমো নমো শ্রীলংকা মাতা’ শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে বরিত। বলা হয়ে থাকে, এটিও বাংলা থেকে অনুবাদ করা হয় সিংহলি ভাষায়। এমনকি অনেকে শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলে থাকেন, কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না।

কথা হলো, নোবেল বলেছে, জাতীয় সংগীতের চেয়ে প্রিন্স মাহমুদের বাংলাদেশ গানটি বেশি দেশকে এক্সপ্লেইন করে। এখানে অনেকে নোবেলের স্রেফ রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে দাবি করছেন। উদাহরণ দিয়ে বলছেন যেন সে বলেছে, তার কাছে গোশতের চেয়ে মাছ বেশি ভালো লাগে। এটা তার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার।

এখানে রুচির কিছু নেই। জাতীয় সংগীত হিসেবে যেই গানটি বিশ্বব্যাপী সাদরে বরিত। সেখানে যদি দেশপ্রেম থাকে, দেশাত্মবোধক বর্ণনা থাকে, দেশঘৃণাত্মক কোনো উপাদান না থাকে, তাহলে এর সাথে অন্য কোনো সংগীত তুলনারহিত। এরপরে অন্য কোনো সংগীত বাংলাদেশকে দেশপ্রেমের চূড়া দেখাতে পারে, দেশাত্মবোধের শিখরে নিতে পারে। কিন্তু শেকড়ে যে স্বীকৃতি ও সমাদৃতার বীজ প্রোথিত, সেটা ভুলে যাওয়া বোকামি। তাই জাতীয় সংগীতের সাথে অন্য কোনো গানের তুলনা একপ্রকার মৃদুধৃষ্টতা বৈকি! নোবেল ঠিক এ জায়গাতে এসে ভুলটা করেছেন। দেখুন, মায়ের চেয়ে খালা বেশি ভালোবাসতে পারে, কিন্তু মা সে তো মা-ই।

জাতীয় সংগীত একটি বিশ্বাসের মতো, যখন যে গান জাতীয় সংগীত হিসেবে সর্বজনমান্য। সেটাই জাতীয় সংগীত। এরপর যদি অন্য কোনো গান জাতীয় সংগীত হিসেবে বরিত হয়, তখন সেটাই জাতীয় সংগীত। লেখক যে কেউ হতে পারে, সমস্যা নাই। দেখুন, ৭ মার্চের ভাষণের পর যে তার চেয়ে বেশি জ্বালাময়ী ভাষণ দ্বিতীয়টি হয়নি, এমন নয়। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণ জনমনে এখনো সমানভাবে বরিত ও সমাদৃত, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, এটি এর তাৎপর্যকে আরো মহিমান্বিত করেছে! ঠিক তেমনি আমাদের জাতীয় সংগীতও।

এবার বাংলাদেশ গানটির প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করা যাক। সেখানে একাত্তর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা বিদ্যমান। তার মানে কি, একাত্তরের আগে বাংলাদেশ ছিল না?

বাংলাদেশ শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, যখন থেকে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম’ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এর মতো দেশাত্মবোধক গানগুলোর মাধ্যমে সাধারণ পরিভাষা হিসেবে নামটি সূচিত হয়।

দ্বিতীয়ত, কোনো জাতীয় সংগীতে কখনো নেতাদের নাম উল্লেখ হয় না। বাংলাদেশ গানটিতে শেখ মুজিব, শহিদ জিয়া, ভাষানী, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দি প্রমুখের নাম উল্লেখ রয়েছে। তাহলে কি করে প্রিন্স মাহমুদের রচিত বাংলাদেশ গানটি দেশকে বেশি এক্সপ্লেইন করে?

তাই সব কথার এককথা, যখন যেটা জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয় তখন সেটা অন্যান্য গানের তুলনা থেকে বাইরে। যে কোনো গান ভালো লাগা না-লাগা রুচির ব্যাপার। কিন্তু একটা সংগীত যখন জাতীয়তার পরিচয় বহন করে, তখন সেটায় রুচিগত দৈন্যের পরিচয় দেয়াটা বোধয় দেশ অপ্রেমের শামিল। তবে যদি জাতীয় সংগীতে দেশ ঘৃণাত্মক কোনো উপাদান থাকে, সংস্কৃতির বিকৃত উপস্থাপন থাকে, ঐতিহ্যের পরিচয় সংকটে থাকে, তাহলে সেটা প্রথমত জাতীয় সংগীত হওয়ার উপযোগী না। দ্বিতীয়ত, সেটায় রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোও বৈধ। সতুরাং আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, জাতীয় সংগীত কেন তুলনারহিত সংগীত?

 

লেখক: সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক ৷